ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

সময় মানুষকে অনেক জিনিস শেখায়
প্রকাশ: রবিবার, ৬ অক্টোবর, ২০২৪, ২:০২ এএম  (ভিজিট : ১৭২)
আমরা যারা চল্লিশে জন্মেছি, তারা অনেক কিছু দেখেছি, দেখেছি বদলে যাওয়া সময়। সময় মানুষকে কত দ্রুত বদলে দেয়। একেকটি কাল চলে যায়, রেখে যায় কিছু পুরোনো দিনের স্মৃতি, কিছু অম্ল -মধুর অভিজ্ঞতা। যারা দীঘদিন বাঁচেন তাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার বিকশিত হয়! বেশি দিন বেঁচে থাকা মানুষের আজন্ম বাসনা। মানুষের জীবনে সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিঃসন্দেহে। বয়স বাড়লেই কি অভিজ্ঞতা বাড়ে? এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে অনেক। সময় কি মানুষকে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়। এ কথা অবশ্য সত্য, সময় মানুষকে অনেক জিনিস শেখায়। আশি ছুঁইছুঁই বয়স যাদের তিন-তিনটে আমল দেখার সুবর্ণ সুযোগ হয়েছে তাদের-ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। ব্রিটিশ শাসনামলে একবারে ছোট ছিলাম। মা-বাবার কাছে শোনা কিছু জিনিস ছাড়া নিজের দেখা, মনে রাখার মতো কোনো স্মৃতি নেই। লেখাপড়ার পাট চুকিয়েছি পাকিস্তান আমলেই। বেশ কয়েক বছর চাকরিও হয়ে গেছে বাংলাদেশ সৃষ্টির আগেই। সে সময়ের চাকরির অভিজ্ঞতা আজও আমাকে ভাবায়। ভালো-মন্দ দুটো দিক জীবনের পাশাপাশি চলে সবসময়।

অনেকের মতো আমার পিতামহকে আমি চোখে দেখিনি। বাবার মুখে শুনেছি তার কথা, কল্পদৃষ্টিতে আঁচ করেছি দীর্ঘদেহী, স্বাস্থ্যবান এক মানুষের প্রতিকৃতি। তিনি নাকি ছিলেন ভীষণ রাশভারী। বিশাল শক্তিধর মানুষটির জীবন ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। সময়মতো আহার-নিদ্রা, বাজারঘাট নিজের হাতে করা-এর কোনো ব্যত্যয় ঘটতে দেননি তার জীবদ্দশায়। আগের দিনের মানুষগুলো হয়তো এমনই ছিল। আমার দাদা সম্পর্কের মানুষটি শেষ জীবনে হজব্রত পালন করেছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে দেড়-দুই মাস জাহাজে চড়ে পৌঁছে ছিলেন জেদ্দা বন্দরে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে পবিত্র মক্কা নগরীতে। আবার একগাল শুভ্র দাড়ি নিয়ে ফিরেও এসেছিলেন সুস্থ শরীরে। তবে তিনি দীর্ঘ জীবন পাননি। ষাট না পেরোতেই মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাকে। সরকারি চাকরিজীবী আমার বাবাও ছিলেন ঠিক তার পিতার অনুগামী।

নিজের জীবনযাপনের কোথাও অনিয়ম ছিল না তার। পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে যাওয়া-আসা, বাজার সদাই করা, ঘরের রান্না ছাড়া বাইরের খাদ্য বর্জন-এসব ছিল তার প্রাত্যহিক জীবনের সহজ-সরল চলার পথের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে যাওয়া, পরিমিত ব্যয়ে জীবনযাপনে কারও কাছে হাত পাততে হয়নি তাকে। তিনি তার উত্তরসূরিকে এমন শিক্ষাই দিয়েছেন। কিন্তু এন্ট্রান্স পরীক্ষায় মেধাস্থান ছিনিয়ে নেওয়া বাবার মতো তার সন্তানরা কেউই হতে পারেনি। আমাদের কাউকে প্লে, কেজি বা শিশুশ্রেণিতে স্কুলে পড়তে হয়নি। আগের দিনে এর তেমন প্রচলনও ছিল না। এসব স্তরের পড়া মা-বাবা ঘরে বসেই শিখিয়েছেন অল্প কয়েক দিনের মধ্যে। কাজেই কম বয়সেই সরকারি স্কুলে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ভালো রেজাল্ট করে কলেজ, ভার্সিটির শিক্ষা পর্ব শেষ করে কর্মজীবনে ঢুকে পড়া ছিল সহজসাধ্য ব্যাপার। তাই বলে সবাই যে একই রকম উচ্চশিক্ষিত হতে পেরেছে তা কিন্তু নয়। যে যার মেধা-মনন আর একাগ্রতা দিয়ে নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে হয়েছে।

আগের দিনে কাছাকাছি মানুষজনকে সাহায্য-সহযোগিতা করা ছিল এক মামুলি ব্যাপার। বাবা সবসময় আমাদের কোনো কাজিনকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য বাসায় রাখতেন। অর্থাভাবে যারা লেখাপড়া করতে পারে না, তাদের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার বাইরে বাবার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো নিজ সন্তাদের মাঝে সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধ সঞ্চারিত করা। নিজের পরবর্তী প্রজন্মকে আদর্শবান করে গড়ে তোলা আগের দিনের মানুষের যেন এক সহজাত প্রবৃত্তি ছিল। জীবনের অন্য অতি প্রয়োজনীয় দিকগুলো মা-বাবারা সন্তানদের সমানভাবে রপ্ত করাতে ব্যস্ত থাকতেন। 

কন্যাসন্তানদের রান্না-বান্না করা থেকে শুরু করে সংসারজীবনের যাবতীয় কাজকর্মের প্রশিক্ষণ দিতেন ছোটবেলাতেই। ছেলেদের বাজার করা থেকে শুরু করে বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করা, গাছগাছালি লাগানো, সাঁতার কাটা-সবই শিখতে হতো সেই ছেলেবেলায়। শরীর সুস্থ ও সবল রাখার জন্য পরিমিত খাদ্যাভ্যাস শরীর চর্চাও দিনপঞ্জির তালিকায় বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে।

আগের দিনের মা-বাবারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন সন্তানের মানবিক গুণাবলি বিকাশের ওপর। সত্য কথা বলা, সৎজীবনযাপনে ব্রতী হওয়ার একটি বীজ বপন করে দিতেন সেই শিশুকালেই। ভালো লেখকের বইপড়া, ভালো সিনেমা দেখা, ধর্মনির্বিশেষে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতেন মা-বাবা। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্কের আনন্দ পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায় আজীবন। ছেলেবেলা থেকে প্রচুর খেলাধুলা করা, গায়ে কাদাজল মাখার আনন্দের পাশাপাশি প্রাণশক্তির জোগান দেওয়ার ফলাফল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত উপভোগ করা যায়। 

ছেলেবেলা থেকে খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা রাত না জেগে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া, সূর্যাস্তের পূর্বেই ঘরে ফেরা-এ ব্যাপারে সন্তানকে কোনো ছাড় উচিত নয়। মা-বাবার শাসন ও অকৃত্রিম স্নেহ আর শাসনের মধ্যে সন্তান তরতর করে বড় হয়ে যাবে। তাদের বেড়ে ওঠার পেছনে মা-বাবার এই আত্মত্যাগ যেযন সন্তান কখনো ভুলে না যায়।

কিন্তু আগের দিনের মা-বাবার মতো আজকের দিনের মা-বাবারা তাদের সন্তানদের গড়ে তুলতে পারেননি। পারেননি তাদের মনের মতো মানুষ করে তুলতে। তাদের বড্ড বেশি আদরে বড় করা হয়েছে। তাদের গায়ে কাদা মাখতে দিইনি, সাঁতার কাটা, খেলাধুলা তেমন শিখাইনি। শুধু বইয়ের পাতায় দৃষ্টি রাখতে শিখেছে তারা। বাস্তব জীবনের কঠিন দিকগুলোর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়নি। তারা বাজারে যেতে চায় না, ঘরের কাজকর্মে উৎসাহী নয়। অনেক নিকটাত্মীয়কে তারা চেনেই না। পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে নেই তেমন কোনো যোগাযোগ। বাইরের মানুষের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রাখার সুযোগ করে দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠার অনাবিল আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে তাদের। তাই তারা হয়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিক। ঘরের চেয়ে বাইরের জগতের গড়ে উঠেছে তাদের সখ্য। ফলে মা-বাবা, ভাইবোনের প্রতি আকর্ষণ, দায়িত্ববোধ তেমনটা গড়ে ওঠেনি। অতিরিক্ত পাওয়ার নেশা তাদের চেপে ধরেছে। অল্পতে তারা তুষ্ট থাকতে রাজি নয়। অফুরন্ত পাওয়ার নেশায় তাদের বিরামহীন ছুটে চলা তাদের কোথায় নিয়ে যাবে জানি না। তারাও তো একদিন বুড়ো হবে।

বয়স বেড়ে গেলে, মানুষ বুড়ো হলে জীবনের হিসাবের খাতা তুলে ধরে। দেনা-পাওনার মতো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কষতে চায়। আমার প্রিয় এক বন্ধু সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসরে গেছেন বছর পনেরো আগে। তার সঙ্গে নাইজেরিয়ার একসঙ্গে অনেক দিন চাকরি করেছি। ফলে তার সঙ্গে আলাদা একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দেশে ফিরেও সে বাঁধনে এতটুকু চিড় ধরেনি। বন্ধুটির স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে কয়েক বছর হলো। তিনি এখন একটি ছোট্ট জেলা শহরে একা থাকেন। তার দুটো ছেলেই উচ্চশিক্ষিত, ভালো চাকরি করে। তারা কেউ খারাপ নন। পুত্রবধূরাও যথেষ্ট ভালো। বউ-বাচ্চা নিয়ে ছেলেরা ঢাকায় ভালোই আছে। এ নিয়ে আমার বন্ধুর মনে রয়েছে অনন্ত সুখ। সন্তানের সুখ দেখে কোনো পিতা-মাতা আনন্দিত না হন। তবে আজ তিনি তার জীবনের যোগ-বিয়োগের ফলাফলকে বিশাল একটা শূন্য হিসাবে দেখেন। তার দুই পুত্রই উচ্চশিক্ষিত, ভালো চাকরি করে। একই শহরে থাকে দুই ভাই। অথচ ঢাকায় আলাদা বিশাল বাড়ি, গাড়ি তাদের। ভীষণ কর্মব্যস্ত জীবন তাদের। তারা বিয়ে করেছে, সন্তানও রয়েছে। শিশুসন্তানদেরও ভর্তি করিয়েছে স্কুলে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে। সন্তান পালন করে কাজের লোক। তারা অনেক রাত জেগে থাকে, কম্পিউটার আর সেলফোন নিয়ে মেতে থাকে। ওঠে দেরি করে। সকালে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাত করে। দুপুরে বাইরে খায়। বাজার করা, রান্না-বান্না সব চলে কাজের লোক দিয়ে। ছেলেরা একদম হাঁটাচলা করে না। দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছে তারা। ঘর থেকে বেরিয়েই পা রাখে গাড়িতে। বাইরের খাবার খেয়ে দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছে। নানা অসুখে ভুগছে তারা। বড্ড কষ্ট আর মায়া হয়।

আমার মনে একটি প্রশ্ন বারবার উঁকি দিয়ে যায়, দুই দুটো যোগ্য সন্তান থাকার পরও একজন পিতাকে কেন নিঃসঙ্গ জীবন মফস্বলের নিভৃত এক শহরে? আজকের সন্তানরা পিতা-মাতাকে দূরে রেখে কেমন ভালো থাকে-এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন। সত্তরোর্ধ্ব বয়সের একজন মানুষের এমন নিঃসঙ্গ জীবন কাটানো কি আনন্দের হতে পারে? সন্তানের সান্নিধ্যবঞ্চিত প্রবীণ জীবনের শোকগাথা আজ কম-বেশি সবার একই রকম। নতুন প্রজন্মের আগামী দিনগুলো কেমন যাবে? তাদের সন্তানদেরই বা ভবিষ্যতে কী হবে! ক্যারিয়ার, অর্থবিত্তের দুর্দমনীয় আকর্ষণ আজ কেড়ে নিয়েছে হৃদয়ের কোমল জায়গাটুকু, সেখানে সবার প্রবেশাধিকার নেই! প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কি এমনই চলতে থাকবে! এ থেকে বেরিয়ে আসার কি আশু কোনো সম্ভাবনা নেই? শুধু একা কি সত্যি ভালো থাকা যায়? নির্জনতা কি মানুষকে কখনো সুখ এনে দিতে পারে। মানুষের জন্য মানুষ, জীবনের জন্য জীব-এমনটাই তো হয়ে এসেছে, হওয়ারও কথা চিরকাল।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close