বন্যাপরবর্তী সময়ে নোয়াখালীর বাজারে বিরাজ করছে অস্থিতিশীলতা। সবজি থেকে শুরু সব নিত্যপণ্যের দাম ক্রেতাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিক্রেতারা বলছেন, বন্যায় পুরো জেলা আক্রান্ত হয়েছে। ফলে মাছের ঘের, খামারসহ ফসলের মাঠ পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সরবরাহ কমে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে দামের ওপর। অপরদিকে ক্রেতারা বলছেন, বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য থাকলেও সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে বেশি দামে বিক্রি করছেন।
এ বিষয়ে জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক কাউসার মিয়া বলেন, অভিযোগ পেলেই অভিযান চালাই। তা ছাড়া আমাদেরও নিয়মিত বাজার মনিটরিং চলছে।
জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে বাজার অস্থিতিশীল করতে না পারে সে জন্য আমরা মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দিয়েছি।
জেলা শহরের বাসিন্দাদের জন্য একমাত্র ভরসা হচ্ছে নোয়াখালী পৌর বাজার। এটি নোয়াখালী পৌরসভা নিয়ন্ত্রিত। এখানে মুদি পণ্যের দোকান থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, মাছের বাজারে প্রচুর ক্রেতার ভিড়। কিন্তু ক্রেতার ভিড়ের তুলনায় পর্যাপ্ত মাছ নেই বাজারে। কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলায় প্রায় ৮৫ হাজারেরও বেশি মাছের ঘের এবং খামারসহ পুকুর বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় চাষ করা বহু মাছ উন্মুক্ত জলাশয়ে ভেসে গেছে। ফলে আগে স্থানীয়ভাবে যেসব মাছ সরবরাহ হতো তা না আসায় বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য জেলা থেকেও যেসব মাছ আসত তা কমে যাওয়ায় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। ভরা মৌসুমেও ইলিশ নেই বাজারে। যা আছে তাও বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দামে। ইলিশ এখন সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে।
অন্যদিকে সবজির বাজারে দেখা যায়, বাজারে মৌসুমি সবজির সরবরাহ কম থাকায় ক্রেতারা বাড়তি দামে সবজি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। তুলনামূলকভাবে বাজারে সবজি কম থাকাকেই এর পেছনের কারণ বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। নোয়াখালীতে পাশের জেলা কুমিল্লার সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এবারের বন্যায় কুমিল্লাও আক্রান্ত হওয়ায় বিস্তীর্ণ সবজির মাঠ তলিয়ে যায়। কুমিল্লায় সবজির ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার প্রভাব নোয়াখালীর বাজারেও পড়েছে। জেলার শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত সুবর্ণচর উপজেলার কৃষি খাত সম্পূর্ণ বন্যার কবলে পড়ায় বাজারে সবজির ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। সর্বনিম্ন ৭০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সবজি।
মুরগির বাজারে দেখা যায়, গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজি প্রতি ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা থাকলেও এই সপ্তাহে তা বেড়ে ২২০ থেকে ২৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি দরে। প্রতি কেজি কক মুরগির দাম হাঁকা হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা।
মুদি পণ্যের বাজারও রয়েছে অস্থিতিশীলতা। প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ, চাল, ডালসহ অন্যান্য যেসব মুদি পণ্য রয়েছে সব কিছুর দামই বাড়তি। ফলে বিড়ম্বনায় রয়েছে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরাও।
কথা হয় বাজার করতে আসা ব্যাংকার হাবীবের সঙ্গে। এ সময় তিনি বলেন, যে বেতন পাই তা দিয়ে বাসা ভাড়া, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, প্রাইভেট শিক্ষকের খরচসহ সাংসারিক অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে বাজার খরচ রাখতে হয়। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় দেখা যাচ্ছে সাধ্যের ভেতরেও বাজার করতে হিমশিম খাচ্ছি। একটি পণ্য কিনতে গেলে অন্য পণ্য কেনার টাকা থাকছে না। বাসা থেকে বলেছে ইলিশ কিনতে। কিন্তু যে দাম তাতে কেনার সাহস পাচ্ছি না। ইলিশ কিনতে গেলে অন্যান্য বাজার আর করা হবে না।
ইকবাল আহম্মেদ নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী বলেন, দুই ছেলে ভার্সিটিতে পড়ে। মাসের শুরুতেই তাদের খরচ পাঠাতে হয়। তারপর বাসা ভাড়া দিয়ে অন্যান্য খরচের তালিকা করতে হয়। তাতে দেখা যায়, বাজারের জন্য যে খরচ রাখি তা দিয়ে সংকুলান হয় না। বাজারে প্রতিটি পণ্যের যে বাড়তি দাম তাতে আমরা মধ্যবিত্তরা পিষ্ট। এক কেজি ওজনের রুই মাছ ৪০০ টাকার ওপর চাচ্ছে। তেলাপিয়া চাচ্ছে ২২০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি। ছোট ছোট ইলিশ যেগুলো আগে কিনতাম ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় সেই ইলিশ এখন ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা কেজি। ডিমের হালি ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা।
কিছুদিনের জন্য দেশে এসেছেন প্রবাসী কবির হোসেন। তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, কষ্ট করে প্রবাসে কাজ করি। সন্তানরা ভালো স্কুলে পড়ে। তাদের জন্য শহরে বাসা ভাড়া নিয়েছি। যে টাকা আয় করি তার কিছু অংশ নিজের জন্য রেখে প্রায় পুরোটাই দেশে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু বাজারের দামের যে অবস্থা তাতে আমার পরিবার কীভাবে চলে তা আমি বাজারে না এলে বুঝতে পারতাম না।