জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার সোমবার জানিয়েছেন, ইসরাইলের চলমান হামলার মুখে প্রায় এক লাখ সিরীয় এবং লেবানিজ নাগরিক লেবানন ছেড়ে সিরিয়ায় পালিয়ে গেছেন। ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি এক্স-এ লিখেছেন, ‘ইসরাইলি বিমান হামলা থেকে বাঁচতে লেবানন থেকে সিরিয়ায় যাওয়া মানুষের সংখ্যা এক লাখে পৌঁছেছে। যাদের মধ্যে লেবানিজ এবং সিরীয় উভয় দেশের নাগরিক রয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘নবাগতদের সহায়তা করার জন্য জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং সিরিয়ান আরাব রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে চারটি সীমান্ত পয়েন্টে কাজ করছে।’
উল্লেখ্য, গত ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ইসরাইল লেবাননে ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে। লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই হামলায় এখন পর্যন্ত ৯০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ২ হাজার ৭০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। শুক্রবার বৈরুতে ইসরাইলি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হন। এ ছাড়া হামলায় হিজবুল্লাহর আরও বেশ কয়েকজন কমান্ডার নিহত হয়েছেন। গত বছর ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের সীমান্ত হামলার পর থেকে ইসরাইল গাজায় যুদ্ধ শুরু করে। এরপর থেকে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ চলছে।
গাজা যুদ্ধে এ পর্যন্ত প্রায় ৪১ হাজার ৬০০ মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, লেবাননে ইসরাইলের হামলার ফলে গাজা সংঘাত আরও বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ৮ ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছে বলে ২ অক্টোবর বুধবার ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একটি ভিডিওতে শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমরা ইরানের অশুভ অক্ষের বিরুদ্ধে একটি কঠিন যুদ্ধের মধ্যে রয়েছি। এই শক্তি আমাদের ধ্বংস করতে চায়।
এটি কখনোই ঘটবে না। কারণ আমরা একসঙ্গে এদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। সৃষ্টিকর্তার সাহায্যে আমরা একসঙ্গে জয়ী হব।’ গত বছরের ৮ অক্টোবর থেকে ইসরাইলি বাহিনী এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে লড়াইয়ে প্রথমবার এত বেশিসংখ্যক ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বলেছে, লেবাননে স্থল অভিযানে নিয়মিত পদাতিক এবং সাঁজোয়া ইউনিট যোগ দিচ্ছে। ইরান ইসরাইলে ১৮০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার একদিন পরে এই তথ্য প্রকাশ করল সামরিক বাহিনী। এদিকে হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তার যোদ্ধারা লেবাননের অভ্যন্তরে ইসরাইলি বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি লড়াই করেছে। ইসরাইলি বাহিনী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে লেবাননে প্রবেশের পর প্রথমবারের মতো স্থল সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেল।
হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তারা ইসরাইলের অভ্যন্তরে সামরিক চৌকিতে রকেট নিক্ষেপ করেছে। সীমান্ত শহর মারুন আল-রাসের কাছে রকেট দিয়ে তিনটি ইসরাইলি মেরকাভা ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছে।
বুধবার ইরান জানিয়েছে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আপাতত শেষ হয়েছে। তবে নতুন করে উসকানি দিলে আবার হামলা করা হবে। তবে ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কঠোরভাবে পাল্টা আঘাত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
১ অক্টোবর মঙ্গলবার ইসরাইলে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৩৮ বছর বয়সি সামেহ খদর হাসান আল আসালি নামের একজন ফিলিস্তিনি নিহত হন। সে সময় তিনি অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর একটি কম্পাউন্ডে অবস্থান করছিলেন। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মারা যান তিনি। বুধবার তাকে দাফন করা হয়েছে। গত বছরের ৮ অক্টোবর থেকে ইসরাইলি হামলায় লেবাননে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৯৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফিরাস আলাবিয়াদ। আহত হয়েছেন আরও ৯ হাজার ৩৮৪ জন। ৯ অক্টোবর বুধবার রাজধানী বৈরুতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।
মন্ত্রী বলেন, ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত ১২৭ শিশু নিহত হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক ডজন হাসপাতাল ও ক্লিনিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং চিকিৎসা ও জরুরি সেবা টিমের ৪০ জন কর্মী নিহত হয়েছেন। উল্লেখ্য, গত বছরের ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। পরের দিনই লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে তারা। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে লেবাননে ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে ইসরাইল। বিশেষ করে হিজবুল্লাহর অবকাঠামো লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হচ্ছে বলে দাবি করেছে তারা। গত ২৭ সেপ্টেম্বর হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরাল্লাহসহ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডার নিহত হন।
এদিকে লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সাম্প্রতিক ইসরাইলি হামলায় ১ হাজার ১০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ ঘোষণা করেছে ইসরাইল। ইসরাইলের অভিযোগ, ইরানের হামলার স্পষ্ট নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন গুতেরেস। বুধবার এক বিবৃতিতে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাটজ বলেন, ‘যে ইরানের জঘন্য হামলার স্পষ্ট নিন্দা জানাতে পারে না, ইসরাইলি ভূমিতে তার পা রাখার অধিকার নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ইসরাইলবিরোধী মহাসচিব সন্ত্রাসী, ধর্ষক এবং খুনিদের সমর্থন দিয়ে আসছেন।’
কাটজের অভিযোগ, গুতেরেস হামাস, হিজবুল্লাহ, হুথি এবং এখন বিশ্বসন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক ইরানের ‘খুনিদের’ সমর্থন করেন। ‘তিনি আগামী প্রজন্মের কাছে জাতিসংঘের ইতিহাসে কলঙ্ক হিসেবে স্মরণীয় থাকবেন’, যোগ করেন তিনি। মঙ্গলবার রাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর, গুতেরেস ‘মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত বৃদ্ধির’ নিন্দা জানান এবং এই অঞ্চলে ‘ক্রমাগত উত্তেজনা বৃদ্ধির’ সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘এটি বন্ধ করতে হবে। আমাদের অবশ্যই যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন।’
ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরেই জাতিসংঘের সমালোচক। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে আন্তর্জাতিক এই সংস্থার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আরও তিক্ত হয়ে ওঠে। গুতেরেস গাজা ও লেবাননে যুদ্ধ বন্ধের জন্য বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। দক্ষিণ লেবাননে হিজবুল্লাহর তীব্র প্রতিরোধের মুখে ইসরাইলি বাহিনী চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। হিজবুল্লাহ দাবি করেছে, গত ২৪ ঘন্টায় তাদের হামলায় ১৭ জন ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছে।
ইসরাইল তাদের উত্তর সীমান্তে দক্ষিণ লেবাননে স্থল হামলা চালালেও হিজবুল্লাহর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। হিজবুল্লাহ যোদ্ধারা তাদের পরিচিত ভূ-প্রকৃতির সুবিধা নিয়ে ইসরাইলি বাহিনীকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করছে। সূত্র জানায়, হিজবুল্লাহর পাল্টা হামলায় মারুন আল-রাস গ্রামে একটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে ১৭ ইসরাইলি সেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। আহতদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হতাহতদের হেলিকপ্টারযোগে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে বৃহস্পতিবার ইসরাইলি বাহিনী দাবি করে, তারা লেবাননের বিভিন্ন স্থানে হিজবুল্লাহর দুই শতাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ চালিয়ে ১৫ হিজবুল্লাহ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। তবে হিজবুল্লাহ এ দাবি অস্বীকার করেছে।
গত শুক্রবার ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ নিহত হওয়ার পর থেকে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত তীব্রতর হয়। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, ২০০৬ সালের মতো এবারও ইসরাইল হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সুবিধা করতে পারবে না।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তাৎক্ষণিক নিন্দা না করায় ইসরাইল জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসকে ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ ঘোষণা করার পর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য- ব্রিটেন, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্থায়ী ১০ সদস্য দেশ জানিয়েছে, ‘জাতিসংঘের সব রাষ্ট্রের জন্য মহাসচিবের সঙ্গে গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ সম্পর্ক বজায় রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।’
পরিষদ আরও জানায়, সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে ‘মহাসচিব এবং তার দফতরের কাজকে যা ক্ষুণ্ন করে- এমন যেকোনো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে’ বলা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জাতিসংঘ মহাসচিব বা জাতিসংঘের সঙ্গে যোগাযোগ না করার যেকোনো সিদ্ধান্ত বিপরীতমুখী, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির এই প্রেক্ষাপটে।’
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের এক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইসরাইলের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্ক ৭ অক্টোবর ২০২৩ হামাসের হামলার পর থেকেই ক্রমশ টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই হামলাই গাজায় যুদ্ধ শুরু করে। গত বুধবার ইসরাইলি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাটজ গুতেরেসকে ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’ ঘোষণা করে বলেন, ‘যে ইরানের জঘন্য হামলার স্পষ্ট নিন্দা করতে পারে না, তার ইসরাইলের ভূমিতে পা রাখার অধিকার নেই।’
কাটজ জাতিসংঘ মহাসচিবকে ‘সন্ত্রাসী, ধর্ষক এবং খুনিদের সমর্থনকারী ইসরাইলবিরোধী মহাসচিব’ বলেও আখ্যা দেন। এর আগে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার বিষয়ে আলোচনা করা হয়। ইরান ও ইসরাইল উভয়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গুতেরেস বলেন, ‘আমি আবার ইসরাইলে ইরানের ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তীব্র নিন্দা করছি।’ তবে তিনি একই সঙ্গে সব পক্ষকে সহিংসতার ‘বিষাক্ত সংঘাত’ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এটি পুরো অঞ্চলকে ‘সরাসরি ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’ গুতেরেস গাজা ও লেবাননে লড়াই বন্ধের জন্য বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
সাংবাদিক
সময়ের আলো/আরএস/