রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমদানি বাড়লেও রিকন্ডিশন্ড (একবার ব্যবহৃত) গাড়ির বিক্রি কমে গেছে। আমদানিকারকদের দাবি অনুযায়ী শোরুমগুলোতে বিক্রি কমে গেছে ৬০ ভাগেরও বেশি। রিকন্ডিশন্ড গাড়ির মধ্যে ছোট আকারের গাড়ি অল্প কিছু বিক্রি হচ্ছে। বিলাসবহুল গাড়ির বিক্রি একেবারেই নেই। পটপরিবর্তনের পর ক্রেতাদের মনে নানা ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে বলে মনে করেন আমদানিকারকরা। আবার ক্রেতাদের একটি বিশেষ শ্রেণি একেবারেই ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে গেছে বলেও ধারণা অনেকেরই। তাই শোরুমমুখী ক্রেতার দেখা মিলছে না। তবে পরিস্থিতি খুব সহসাই উন্নতি হবে বলে মনে করেন আমদানিকারকরা।
কাস্টমস সূত্র জানায়, বিক্রি কমলেও চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে বেড়ে গেছে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি। গত বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর তিন মাসে গাড়ি আমদানি হয় ৫ হাজার ৯৯৬ ইউনিট। চলতি বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর তিন মাসে গাড়ি আমদানি হয়েছে ৭ হাজার ৫৯ ইউনিট। গত বছর জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসের চেয়ে চলতি বছর একই সময় আমদানি বেড়েছে ১ হাজার ৬৩ ইউনিট। তবে আমদানি বাড়লেও আমদানিকারকরা খুশি নন। তারা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে ব্যাংকে এলসি করা গাড়িগুলোই বন্দরে এসেছে। নতুন করে আমদানির জন্য এলসি খোলা কমে গেছে। ক্রেতাদের কম চাহিদার কারণে এলসি কম হচ্ছে। শোরুমগুলোতে গাড়ির বিক্রিও কমে গেছে।
সূত্র জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত গাড়ি আমদানি হয়েছে ২১ হাজার ৫১৯ ইউনিট। এর মধ্যে খুলনার মোংলা বন্দর দিয়ে গাড়ি আমদানি হয়েছে ১২ হাজার ৯৪৮ ইউনিট। একই সময় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ৮ হাজার ৫৭১ ইউনিট। চলতি বছর মে মাসে সর্বোচ্চসংখ্যক গাড়ি আমদানি হয়েছে। ওই এক মাসেই আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৯৫৯ ইউনিট। চলতি বছর সর্বনিম্ন গাড়ি আমদানি হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে। ওই মাসে মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি হয় ৫৫১ ইউনিট। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে মাত্র ১৭৫ ইউনিট গাড়ি।
গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারবিডার সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন সময়ের আলোকে বলেন, ঢাকা এবং চট্টগ্রামসহ দেশের শোরুমগুলোতে গাড়ির বিক্রি অস্বাভাবিক রকম কমে গেছে। অন্তত ৬০ ভাগ গাড়ি বিক্রি কমে গেছে। এটা নিয়ে আমরা চিন্তিত।
কী কারণে বিক্রি কমেছে-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, মানুষের মধ্যে বিশেষ করে গাড়ির ক্রেতাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। তাই গাড়ি বিক্রি হঠাৎ করেই কমে গেছে। এখন প্রাডোর মতো বিলাসবহুল গাড়ির ক্রেতা নেই বললেই চলে। কেবল কার মাইক্রেবাসসহ ছোট আকারের যানবাহনই কোনোভাবে বিক্রি হচ্ছে। আমরা মনে করি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সামনের সময়ে বিক্রি আবার স্বাভাবিক হবে।
বারভিডার সাবেক সভাপতি আবদুল হক বলেন, সমাজের যে শ্রেণির লোকজন গাড়ি কিনত এক কথায় বলা যায় তারা এখন নিরুদ্দেশ। অনেকে ভয়ে আতঙ্কে গাড়ি কিনছেন না। যাদের কাছে প্রচুর অর্থ আছে এমন ব্যবসায়ী, আমলা ও পুলিশ অফিসাররা গাড়ি কিনছেন না। তারা এখন সতর্কতা অবলম্বন করছেন। তাই গাড়ির আমদানি বাড়লেও বিক্রি একেবারেই কমে গেছে।
বারভিডার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক চৌধুরী বাবর সময়ের আলোকে বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গাড়ি বিক্রি কমে গেছে। শোরুমগুলোতে ক্রেতা নেই। গাড়ি আমদানিও কমে যাচ্ছে।
পটপরিবর্তনের পর আমদানির পরিসংখ্যানে আমদানি বেশিই দেখা যাচ্ছে-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমদানি আসলে কমছে। চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর তিন মাসে আমদানি করা গাড়িগুলো রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে এলসি করা। বর্তমানে নতুনভাবে এলসি করার হার কমে গেছে। তাই আগামী কয়েক মাসজুড়ে আমদানির প্রবাহ কমতেই থাকবে।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর দিয়ে সাবেক সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধার আমদানি করা গাড়ির সরবরাহ পৌঁছে গেছে। এসব গাড়ির কিছু ছাড় হলেও বেশিরভাগ ছাড় হয়নি।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, বন্দরে আমদানির পর জট এড়াতে ৪৫ দিনের মধ্যে নিলামে তোলা হবে সব ধরনের গাড়ি।
শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিলুপ্ত সংসদের সাবেক সংসদ সদস্যদের যেসব গাড়ি আমদানি হয়েছে তা নিলামেই তোলা হবে। এসব গাড়ি নিলামে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমদানি করা গাড়ির সরবরাহ বন্দরে পৌঁছলেও পলাতক সংসদ সদস্যরা ছাড় করতে যোগাযোগ করছে না। তাই নিলামে এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার (নিলাম) সেলিম রেজা সময়ের আলোকে বলেন, ৩০ দিন পার হলেই আমরা নিলামের প্রক্রিয়া শুরু করি। আমদানির জন্য কিছু ডকুমেন্ট তৈরি করা ছাড়াও কিছু প্রক্রিয়া আছে। সেসব কাজ সম্পন্ন হতে দেরী হলে নিলাম আয়োজনেও দেরী হতে পারে। তবে আমরা নিয়ম অনুসরণ করে নিলাম আয়োজনের জন্য প্রস্তুত।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পাওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৪ হাজার ইউনিট ধারণক্ষমতার গাড়ির শেড ইয়ার্ডে বৃহস্পতিবার গাড়ি ছিল ৯৬২ ইউনিট। তিন হাজার ইউনিট গাড়ি রাখার জায়গা ছিল খালি। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার গাড়ি ডেলিভারি নেওয়া হয় ৬৪টি। বর্তমানে নিলামে তোলার জন্য নিলাম ইয়ার্ডে আছে ৩৯১টি ইউনিট গাড়ি। তবে নিলাম ইয়ার্ডে এখনও সাবেক সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা বিলাসবহুল গাড়িগুলো পাঠানো হয়নি।
চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা পণ্য খাতে কাস্টম বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণ করে গাড়ি খাতে। গাড়ি আমদানি বাড়লে রাজস্ব বাড়বে। আর আমদানি কমলে রাজস্ব আদায়ও কমবে। জুলাই বিপ্লবের পর কাস্টমসের রাজস্ব আদায় কার্যক্রমে বিরূপ পরিস্থিতি কাটাতে নানা নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দুদিন চট্টগ্রাম সফর করেন এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান। এ সময় তিনি চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন।
সময়ের আলো/আরএস/