ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

রাষ্ট্র সংস্কারে ভিন্নমতকে গুরুত্ব দিন
প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ অক্টোবর, ২০২৪, ২:০০ এএম আপডেট: ০৫.১০.২০২৪ ৩:১৮ এএম  (ভিজিট : ৩২৭)
মাজার ও খানকা নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের পুরোনো। বিগত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর অস্বাভাবিক পরিস্থিতির অন্যতম ঘটনা মাজার খানকায় হামলা। এতে ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেকটা বেকায়দায় ফেলার নতুন ষড়যন্ত্র বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। যেহেতু সুফিবাদ বা মাজার খানকার অনুসারীরা কোনোক্রমেই সরকারের জন্য হুমকি নয়, তাই এখানে অনেকেই ইসলামি মৌলবাদের গন্ধ পাচ্ছেন। কিন্তু আসলেই কি তাই?

সুফিবাদ ধর্মীয় একটি মতবাদ। সুফিবাদকে কেন্দ্র করেই মাজারের উদ্ভব। এ দেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস বহু পুরোনো। প্রচলিত মতে, হাক্কানি পীর-আউলিয়ারাই এ দেশে যুগে যুগে ইসলামের মূল শিক্ষা প্রচার ও প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এবং এখনও করছেন। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল ৩৬০ আউলিয়ার দেশ এবং চট্টগ্রাম বারো আউলিয়ার দেশ হিসেবে পরিচিত। বহু পীর-সাধকের পুণ্যভূমি হচ্ছে রাজশাহী অঞ্চল। এভাবে হিসাব করলে পুরো বাংলাদেশে বহু পীর-আউলিয়ারা ইসলামের প্রচার করেন এবং তাদের রয়েছে অসংখ্য ভক্ত। ফলশ্রুতিতে পীর-আউলিয়া এমনকি ভক্তদের নামেও বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠেছে মাজার খানকা। তাও সত্য যে, ইসলামকে পুঁজি করে বহু ভণ্ড মুরিদ-ভক্তরা নামসর্বস্ব মাজার তৈরির মাধ্যমে ধর্ম ব্যবসা করে যাচ্ছে।

সুফিবাদ অনুসারে আল্লাহর নৈকট্য লাভের একমাত্র উপায় পীর-আউলিয়াদের শ্রদ্ধা, মাজার জিয়ারত তথা মাজারে প্রার্থনা করা। সুফি মতবাদের গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী সময় একাদশ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। এ সময় মাজারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে মাজার মুসলিমদের একটি পবিত্র স্থান এবং আধ্যাত্মিক কেন্দ্র হিসেবে প্রসার লাভ করে। হযরত আবদুর কাদের জিলানী (রহ.), খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.), হযরত শাহজালাল (রহ.), হযরত শাহ পরান (রহ.), হযরত খান জাহান আলী (রহ.), সুলতান বায়োজিদ বোস্তামী (রহ.), হযরত শাহ মখদুম (রহ.) এসব পীর-আউলিয়াদের নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে তাদের মাজার ঘিরে ভক্ত আশেকানদের ইবাদতের পদ্ধতিকেন্দ্রিক বিতর্কই চলমান একটি সমস্যা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন জায়গায় হামলার রেশ ধরেই মাজার, খানকা বা পীরের আস্তানাকে টার্গেট করে কিছু দুষ্কৃতকারী এ অবস্থার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের কিছু বিখ্যাত আলেমদের বিভিন্ন সময়ে মাজার নিয়ে আলোচনার অংশবিশেষ, মাজার ভাঙার বা গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিভিন্ন ফতোয়া এবং বেশ কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মাজার ভাঙার পক্ষে নিয়মিত ভাইরাল পোস্টগুলোই মাজার ভাঙার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা যায়। তা ছাড়া বিভিন্ন মাজার-দরগায় ভাঙচুরের ছবি ভিডিও পোস্ট দিয়ে শুকরিয়া আদায়ে ব্যস্ত একদল লোক। মাজারে হামলা জায়েজ করার কারণ হিসেবে মাজারকেন্দ্রিক ব্যবসা, প্রতারণা, মাদকের ব্যবহার ইত্যাদি অভিযোগ একেবারে অমূলক নয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু সত্যতা থাকলেও সবাইকে ঢালাওভাবে ভ- বলা সমীচীন হবে না।

ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পত্রিকা, ফেসবুক তথ্য বা সংবাদ বিশ্লেষণ করে যতদূর জানা যায় এ পর্যন্ত গাজীপুরের শাহ সুফি ফসি পাগলার মাজার, ঠাকুরগাঁওয়ের ৩০০ বছরের পুরোনো বিবি সখিনার মাজার, নারায়ণগঞ্জ, ত্রিশালে দেওয়ানবাগ মাজার, সিরাজগঞ্জের আলী পাগলার মাজার, ইসমাইল পাগলার মাজারসহ বিভিন্ন মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগ এমনকি লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। জুমা নামাজের পর অনেকটা পরিকল্পিতভাবে সিলেটে হযরত শাহপরান (রহ.) উরস চলাকালেই মাজারে হামলা চালিয়েছে একদল দুর্বৃত্ত। উরসে অংশগ্রহণকারী অনেকেই আহত হয়, পুলিশের ওপরও চড়াও হয় হামলাকারীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে তা নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে কাউকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। তৌহিদী জনতা নাম দিয়ে মাজার উৎসবে কারা মেতেছে তা ভিডিও ফুটেজ থেকে সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব। 

এমন অবস্থায় গোলাপ শাহ মাজার ভাঙচুর ঠেকাতে শত শত ভক্তরা মাজারেই অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু কেন মন্দিরের মতোই মাজার পাহারা দিতে হবে?
কবি ও দার্শনিক ফরহাদ মজহার রাজধানীর শাহবাগে মাজারে হামলার প্রতিবাদে বলেন, ইসলাম কখনো আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়নি, বড়জোর ফতোয়া দিতে পারেন। যারা মাজার ভাঙছেন তাদের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই এমনকি তাদের দিল্লির দালাল বলেও উল্লেখ করেন। অর্থাৎ তিনি এখানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পান। মাজারে হামলার গুরুতর অভিযোগের মধ্যে রয়েছে মাজার হচ্ছে শিরক-বেদাতের আখড়া। যারা মাজার ভাঙছেন বা ভাঙার পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন তারা মূলত মাজারকেন্দ্রিক গান-বাজনা, গাজার আসর, নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মাজারকেন্দ্রিক ব্যবসা, প্রতারণা, মাদকের ব্যবহার ইত্যাদি অভিযোগ তুলছেন। মাজার নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, ভ- পীর, ভ- মুরিদ তা চিহ্নিত রাষ্ট্রেরই কাজ, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর নয়। কিন্তু কারা মাজার হামলায় এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলছে? তাদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না? কোথাও গান-বাজনা, মদ-গাজার আসর বন্ধকরণসহ নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণকে বন্ধ করার জন্য মাজার কর্তৃপক্ষের কাছে জোর করে অঙ্গীকার আদায়ের খবর পাওয়া গেছে। তাদের অভিযোগ আমাদের প্রতি ভুল বার্তা দিচ্ছে বিভিন্ন আলেম-ওলামারা।

ধর্ম উপদেষ্টা মাজারে হামলাকারীদের মানবতার শত্রু এবং সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো বিক্ষিপ্তভাবে কিছু প্রতিবাদ করলেও কোনো কর্মসূচি পালন করেনি। মাজার ভাঙার প্রতিবাদটা মিছিল-মিটিংয়ে যত না হয়েছে তার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই বেশি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে মাজারপ্রেমিক পাগল, সুফি, পীর-ফকির প্রতিবাদে বেশ সরব দেখা গেছে। সাধারণ জনগণ ও সুধী সমাজও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রতিবাদ করেছে জোরেশোরেই।

একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আওয়ামী সরকারের পতনের পর ধর্মীয় গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে এ ক্ষেত্রে অনেকেই একমত হবেন। তা ছাড়া এতদিন তারা সরাসরি কথা বলতে না পারার বেদনায় অতি উৎসাহী হয়ে হামলা করে থাকতে পারে। বিগত সরকারের আমলে হিন্দুত্ববাদীদের বড় কোনো সংগঠনের বা সম্মিলিতভাবে ধর্মীয় সমাবেশ দেখা না গেলেও ইদানীং তা দৃশ্যমান। দুর্বৃত্তরা সে সুযোগ নিতেই পারে। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন দেড় মাসের সরকারেই তার বেশ কিছু নমুনাও দেখা গেছে। কেউ কেউ ভবিষ্যতে সংঘাত এড়াতে অত্যন্ত সতর্ক অবস্থানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। কোনো অবস্থাতেই যেন কেউ বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে না পারে সে ক্ষেত্রে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

এদিকে মন্দির পাহারা দিয়ে একশ্রেণির মাদরাসার ছাত্র অসাধারণ প্রশংসায় ভাসছেন। আসন্ন দুর্গাপূজাতেও ঘোষণা দিয়েছে তারা পাহারাদারের দায়িত্ব নিতে চায়? কিন্তু স্বাধীন দেশে মন্দির পাহারায় মাদরাসা ছাত্রদের কেন দায়িত্ব নিতে হবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কি ব্যর্থ? এরপর মাজারে সুফিরা কার পাহারায় সাধনা করবেন? এ দেশে বসবাসকারী হিন্দু সম্প্রদায়সহ সব ধর্মের লোক তাদের ধর্মীয় উপাসনা যেন নির্বিঘ্নে কোনো ধরনের পাহারা ছাড়া করতে পারে তার ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। তা না হলে রাষ্ট্র সংস্কারের যে ব্রত তারা নিয়েছে সেটি শুরুতেই ভেঙে পড়বে। নির্ভয়ে সব ধর্মের লোকেরা ধর্ম পালন করবে এটিই জাতির প্রত্যাশা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কে বা কারা মাজার ভাঙছে? মাজার ভাঙলেই মাজার পূজার অবসান হবে? যারা মাজার ভাঙছে তাদের কি অধিকার রয়েছে মাজার ভাঙার? ইসলাম কি এই অধিকার তাদের দিয়েছে? প্রচলিত আইনকে যারা তোয়াক্কা না করেই নিজেরা আইন হাতে তুলে নিচ্ছে তাদের কতজনকে এ সরকার গ্রেফতার করেছে? সরকার কঠোর ব্যবস্থার কথা বললেও দৃশ্যমান তেমন কিছু কি দেখাতে পেরেছে যাতে সুফিবাদ অনুসারীরা আশ্বস্ত হতে পারে?

মনে রাখতে হবে বাঙালিদের রয়েছে প্রায় ৪ হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতি। ধর্মীয় বৈচিত্র্যের সঙ্গে এখানে বিদ্যমান রয়েছে উন্নতমানের সাহিত্য, দর্শন, সংগীত, নৃত্য, স্থাপত্য, মৃৎশিল্প, চলচ্চিত্রসহ নানা বর্ণের নানা উৎসব। মাজার সংস্কৃতি এ রকম একটি ঐতিহাসিক সত্য যা অবজ্ঞা করা যায় না। ভিন্ন মতবাদ বা সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানলে পরে একই পথ অবলম্বন করতে পারে অন্য কেউ যা কাম্য নয়। ভিন্ন মত ভিন্ন পথকে সম্মান ব্যতীত রাষ্ট্রীয় সংস্কার অসম্ভব।

গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে নানা ধর্মের ভিন্নমত ও বিশ্বাসের মানুষের প্রতি অভিযোগ থাকতে পারে, তা নিয়ে যুক্তিতর্ক হতে পারে। কিন্তু মাজার ভাঙা বা তাদের ওপর হামলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সাম্প্রদায়িক শক্তি যেন কোনোভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে, তাদের ওপর অতর্কিত হামলা না করতে পারে তার আইনানুগ প্রয়োগ থাকতে হবে। 

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন বাংলাদেশ গড়তে মাজার, খানকা ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থানের নিরাপত্তায় কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারে তা দেখার অপেক্ষায় অনেকেই। শান্তিকামী সুফিবাদে বিশ্বাসীরা যেন কোনো আশঙ্কা ছাড়াই ধ্যান-সাধনায় মগ্ন থাকতে পারেন তার ব্যবস্থা গ্রহণে সরকার কঠোর হবে সাধারণ নাগরিক হিসেবে এমনটাই প্রত্যাশা।


এমফিল গবেষক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close