ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

সাইবার নিরাপত্তা আইন বিষয়ে বিশিষ্টদের অভিমত 
বাতিল নয়,পরামর্শ সংশোধনের
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪, ৭:১৯ এএম আপডেট: ০৪.১০.২০২৪ ১:১৮ এএম  (ভিজিট : ৪২৬)
সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ বাতিল নয় বরং মত প্রকাশের যে ধারাগুলো নিয়ে মামলা হয়েছে অর্থাৎ মত প্রকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত ও সংবিধান পরিপন্থী যে ধারাগুলো রয়েছে সেগুলো সংশোধন  করা দরকার বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। এ সংশোধনের জন্য সব ধরনের স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে কথা বলারও পরামর্শ দেন তারা।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ সময়ের আলোকে বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে ধারাগুলো বাকস্বাধীনতা রোধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ওইসব ধারা বাদ দেওয়া বা সংশোধন করা দরকার। চ্যালেঞ্জ দিয়ে এই আইনজীবী আরও বলেন, পুরো আইন বাতিল করে কেউ রাষ্ট্র চালাতে পারবে না। আইন ছাড়া দেশ চলে কীভাবে, ডিজিটাল আইনে অপরাধ হচ্ছে না? অপরাধীকে সাজা দিতে না পারলে অপরাধ কমবে কীভাবে?

এ আইনে শুধু মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং যেগুলো মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী আছে সে ধারাগুলো সংশোধন কিংবা বাদ দেওয়া যেতে পারে। অধিকাংশ লোকের মাধ্যমে সেই দাবিটাই করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এভাবে চাইলেই আইন বাদ দেওয়া যায় না। আইন পরিবর্তন করতে পার্লামেন্ট লাগে। এখন তো পার্লামেন্টও নেই। এগুলো বলা যায়, ইচ্ছে করলেই সবকিছু করা যায় না। এখানে মূলত মত প্রকাশের যে ধারাগুলো নিয়ে মামলা হয়েছে অর্থাৎ মত প্রকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত যে ধারাগুলো আছে সেটিই প্রধানত সংবিধান পরিপন্থী। এগুলোই সংশোধন করা দরকার।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, আমার মতে এই আইনটাকে পুঙ্খানোভাবে দেখা উচিত। এই আইনের ভেতর অনেক ত্রুটি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার আছে। আমি মনে করি, এগুলো আলোচনায় আসতে হবে। সেখান থেকে যদি ডিমান্ড তৈরি হয় তা হলে সংশোধন করতে হবে। সে জন্য এখানে এমন একটা আইন হতে হবে যে, এই আইনের ভেতরে প্রতিরোধমূলক কিছু জিনিস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এখানে মানুষের প্রাইভেসি ইস্যুসহ অনেক বিষয় আছে। যখন একজন নারী ভিকটিম থানায় কোনো মামলা করতে যায় তখন অনেক গোপন ও ব্যক্তিগত তথ্য পুলিশকে দিতে হয়। তখন কিন্তু তারা মামলা না করে পিছিয়ে যায়। এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে মামলা না করে অনেক মেয়ে দেশত্যাগ করেছে।  আর যারা মামলা করছে তারা বারবার অন্যায় আচরণের শিকার হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক বিষয় আছে। যেমন ব্ল্যাকমেইলিংয়ের বিষয় আছে। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিংবা কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করে ব্লাকমেইলিংয়ের শিকার হচ্ছে। এখানে সাইবার বুলিংসহ অনেক বিষয় আছে। এই সংশোধন বা পরিবর্তনটা অনেক আগের ডিমান্ড ছিল। তবে এক দিনের মিটিং করে এই আইনের সংশোধন সম্ভব নয়, সিরিজ মিটিং করতে হবে। সেখানে সুনির্দিষ্ট একটা পরিবর্তন দরকার। আমি মনে করি, এই আইন একবারে বাতিল না করে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সংশোধন হতে পারে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, মাত্র ৫ বছরে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮ বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, সরকার যুগোপযোগী আইন না করে শুধু কণ্ঠরোধ করতে আইন প্রণয়ন করেছিল। ইতিমধ্যে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-২০১৮-এর অধীন হাজার হাজার মামলা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩ পূর্বের আইনের চেয়ে কঠোর করা হয়েছে। এই আইনগুলোর অপব্যবহারের কারণে জনগণকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। যার অন্যতম উদাহরণ খাদিজা। তিনি বলেন, সাইবার নিরাপত্তা আইন-২০২৩-এর ৪২ ধারায় তদন্তের সময় পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যা হয়রানিমূলক এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এটা বন্ধ হওয়া জরুরি। তা ছাড়া মিথ্যা অভিযোগকারী বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে হয়রানিমূলক মামলাকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, এমন কোনো বিধান সাইবার নিরাপত্তা আইনে নেই। যার ফলে আইনটির অপপ্রয়োগ হওয়া থেকে নিরপরাধ ব্যক্তির রক্ষাকবচ নেই।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট তানজিলা রহমান জুঁই বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-কে রহিতকরণের মাধ্যমে ২০২৩ সালে সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়। যদিও এই আইনটির  অনেক ধারা এবং সংজ্ঞা মানবাধিকারকে, বাকস্বাধীনতাকে লঙ্ঘন করে তদুপরিও এই আইনটি পুরোপুরি বাতিল নয় বরং সংশোধন প্রয়োজন। আমাদের দেশে বিশেষ করে নারীরা বিভিন্নভাবে সাইবার বুলিং, সোশ্যাল মিডিয়া বা অনলাইনে বিভিন্নভাবে প্রতারিত হয়ে থাকে সেগুলোকে প্রতিহত করার জন্য বা উপযুক্ত বিচার এবং অপরাধ দমনের জন্য সাইবার আইনটি থাকা জরুরি। এ ছাড়া অন্যান্য সাইবার অপরাধ প্রতিহত করার জন্যও আইনটি প্রয়োজন। আবার এই আইনটিতে পুলিশকে অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মামলা ও গ্রেফতারের ব্যাপারে। তারা এই আইনের আওতায় অনুভূতির কথা বলে যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারে। আবার যেকোনো সংবাদমাধ্যমের প্রকাশনা বা সম্প্রচার কৌশলে বন্ধ করে দিতে পারে।

সাধারণ মানুষের মোবাইল ফোন চেক করতে পারে, যা একেবারেই মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতার লঙ্ঘন। সুতরাং সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কিত আইনটি সংশোধন এবং এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। এর মধ্যে ডাটা সুরক্ষা ও সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন আইন অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। সাইবার হুমকি মোকাবিলায় সরকারি সংস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বেসরকারি খাতের সংস্থাগুলোর ভূমিকা ও দায়িত্বগুলোও আইনি কাঠামোয় সংজ্ঞায়িত করতে হবে। তবে আইনটি সংশোধনের সঙ্গে সঙ্গে আর এর অপব্যবহার যাতে না হয়, সেই বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে।  সর্বোপরি কোনো আইন রাতারাতি বাতিল কোনো সমাধান নয় বরং যুগোপযোগী এবং প্রযুক্তির সঙ্গে মিলিয়ে অপরাধ দমনের জন্য প্রণয়ন করাটাই মুখ্য।

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, কিছু কিছু জায়গা আছে যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। অনেক ধরনের কথা বলছে। এটা কিন্তু এখন বেড়ে গেছে। এই সম্পর্কে কিন্তু অন্য কোনো আইনে অর্থাৎ যেসব চলমান আইন আছে সেখানে কিন্তু ওই ভাবে কিছু বলা নেই। আমরা এগুলো ক্রিমিনাল সলিউশনে আনিনি বা আনতে পারিনি। না করে আমরা একটা নতুন আইন করেছি। যেটা আমি বলব  নিপীড়নমূলক আইন হয়ে গেছে। 

উল্লেখ্য, চারটি ধারা জামিন অযোগ্য রেখে জাতীয় সংসদে গত বছর ১৩ সেপ্টেম্বর পাস হয় সাইবার নিরাপত্তা বিল-২০২৩। বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এতে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। যেখানে ১৪টি ধারা জামিন অযোগ্য ছিল।

বিল অনুযায়ী, পুলিশ পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে কোনো পরোয়ানা ছাড়াই কাউকে তল্লাশি ও গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ধারা-১৭-তে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অবকাঠামো ও অন্য ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ-সংক্রান্ত অপরাধের বিধান, ধারা-১৯-এ রয়েছে কম্পিউটার ও কম্পিউটার সিস্টেমের ক্ষতিসাধনের বিষয়টি। ধারা-২৭-এ রয়েছে সাইবার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের বিষয়টি এবং ধারা-৩৩-এ রয়েছে হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধের বিষয়। বিলের ৪২ নম্বর ধারায় পুলিশকে পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি ও গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ধারায় সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পরিবর্তে পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি ও গ্রেফতারের ক্ষমতা রয়েছে তাদের। এই ধারাটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ছিল। বিলের ধারা-৮ ডিজিটাল মিডিয়া থেকে ডাটা অপসারণ এবং ব্লক করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close