বাল্যপ্রেম এসএসসি পরীক্ষার মাত্র ১০ দিন আগে বৈবাহিক সম্পর্কে রূপ নিল। বর ছিলেন সাইপ্রাস প্রবাসী। কিশোরী মেয়েটি বিয়ের আগে একেবারেই রান্নাঘর মাড়াতেন না। বিয়ে-সংসার নিয়ে একটু ভীতই ছিলেন। কিন্তু ভয় কেটে গিয়েছিল শ্বশুর আর শাশুড়ির মমতায়। বিয়ের পর শাশুড়ির কাছ থেকে রান্না শিখেছেন। সেই থেকে আশপাশের মানুষকে রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসতেন ওই কিশোরী মেয়েটি। বিয়ের ৩ বছর পর মেয়েটির বর মো. রাকিবুল ইসলামের কাছে সাইপ্রাসে চলে আসেন। আড়াই বছরের প্রবাস জীবনে সাইপ্রাস, দুবাই, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে ঘুরে হরেক রকমের খাবার দেখে খাবার নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করার আগ্রহ জাগে তার। বলছি ফরিদপুরের উদ্যোক্তা লাকী ইসলামের কথা।
ফরিদপুরের মানুষ যখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যবসার কথা চিন্তা করেনি ঠিক সেই সময়ে শ^শুর আবদুল গনি মিয়ার পরামর্শ ও সহায়তায় পোস্টার ছাপিয়ে হাতে তৈরি খাবার বিক্রির প্রচার চালান। পোস্ট মাস্টার শ্বশুর ছিলেন লাকীর কাজের বিশেষ ভক্ত। কাজেই পুত্রবধূর কাজের প্রয়োজনে সব ধরনের সহায়তায় তিনি ছিলেন এক পায়ে খাড়া। কাজের উপযোগী পরিবেশ এবং সবরকম সহযোগিতায় শ্বশুরবাড়িকে সবসময় পাশে পেয়েছেন বলে জানান লাকী। পরিবার নারীর কাজে সহযোগিতার হাত বাড়ালে নারীর কর্মস্পৃহা বাড়ে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উদ্যোগ শুরুর গল্প জানতে চাইলে লাকী বলেন, মেয়ে বড় হয়ে যাওয়ার পর হাতে কাজ করার অফুরন্ত সময় ছিল। একাকিত্ব ঘোচাতে ও নিজেকে ব্যস্ত রাখতে কী করা যায় তা ভাবছিলাম। নিজের একটা পরিচয়ের খোঁজে ছিলাম। সব শুনে শ্বশুর-শাশুড়ি আর বাদ সাধেননি। আমার শুরুটা অফলাইনে। অনলাইন আসায় এখন তো সব সহজ হয়ে গেছে। এক দশক আগে যখন কাজ শুরু করেছিলাম তখন স্থানীয়ভাবে পোস্টার আর লিফলেটই ছিল প্রচারের উপায়। নানা দেশ ঘুরে খাবারের নানা উদ্যোগ দেখে মনে হতো বাংলাদেশে ফিরলে আমি খাবার নিয়েই কাজ করতে চাই।
নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতে নিজের রান্নাঘর ঘুরে দেখান লাকী। কর্মীরা সেখানে রান্নার কাজে ব্যস্ত।
লাকী জানান, আগে অফলাইনে কাজ করলেও বর্তমানে তার কাজ চলে অনলাইনে। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে ক্রেতা ও শুভানুধ্যায়ীরা তাদের প্রয়োজন অনুসারে খাবার অর্ডার করেন। বর্তমানে লাকীর উদ্যোগে ৩ জন কর্মী রয়েছে। গড়ে প্রতি মাসে অর্ধলাখ টাকার খাবার বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, আমার টার্গেট কাস্টমার ছিলেন কর্মজীবীরা। জেলায় বহু কর্মজীবী লোকের বাস হলেও তাদের বেশিরভাগ মানুষকে হোটেলের অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হয়। তাদের জন্যই প্রথম রান্নার উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু রান্নার চেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল খাবার পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি। এটি নিয়ে শ্বশুর আবদুল গনির সঙ্গে আলোচনা করেন। পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটি শ্বশুর নিজের কাঁধে তুলে নেন এবং লাকীকে পোস্টার ছাপিয়ে প্রচারের পরামর্শ দেন। শহরের বিভিন্ন অফিস আদালত ও মহল্লার দেয়ালে টাঙিয়ে দেওয়া হয় সেগুলো। ৫ দিনের মাথায় ১১৭ জনের জন্য তিনি চিকেন ফ্রায়েড রাইসের একটি বড় অর্ডার পেয়েছিলেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এত বড় অর্ডার ডেলিভারির পর সাহস বাড়ে তার।
করোনার প্রথম দিকে লাকীর ব্যবসা কিছুটা স্থবির হয়ে পড়ে। ফরিদপুরের মানুষ যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। এদিকে সেই রোগীদের পথ্যের ভার পড়ে তার ওপর। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্যুপসহ নানা ধরনের খাবারে মেনু সাজাতে হয় তাকে। লাকীর খাবারে স্বাদ ঠিক রাখতে গুঁড়া মসলা কম ব্যবহার করেন, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাটা মসলায় কাজ সারেন তিনি। রান্নায় নির্দিষ্ট কাজের জন্য কর্মী রয়েছে। কেবল সবজি কাটা ও মসলা বাটার কাজটা তারা করে থাকেন, রান্না লাকী নিজ দায়িত্বে করেন।
অফলাইনের পাশাপাশি মায়ের ছোঁয়া রান্নাঘর নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলেন। তার মজাদার খাবারের তালিকায় রয়েছে ইলিশ পোলাও, চিংড়ি বিরিয়ানি, কৈ পোলাও, ইলিশ পাতুড়ি, কৈ ভাপা, কাবাব কারী, মাংসের আচার, মিষ্টি কুমড়ার লাড্ডু, হট চিলি চিকেন, সাগুর পায়েস, মুলার পায়েস, বাঁধাকপির পায়েস, ফুলকপির রোস্ট, দেশি-বিদেশি নানা ধরনের মাছের কোরমা। এ ছাড়া সতিন মোচন, নবাব নন্দিনী, ঝগড়া পিঠাসহ অর্ধশতাধিক রকমের পিঠা ও শতাধিক মিষ্টান্ন রয়েছে তার ডেলিভারির তালিকায়। এসব ছাড়াও বিয়ের ডালা সাজান তিনি। তবে অনলাইনের মাধ্যমে খাবার সরবরাহ করে লাকী বসে থাকেননি। বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত মেলায়ও তিনি খাবারের স্টল দিচ্ছেন। মেলায় আগত দর্শনার্থীরা তার খাবার খেয়েও প্রশংসা করেছেন।
উদ্যোক্তা লাকী বলেন, উদ্যোগের পরিসর বাড়াতে নানা ধরনের কাজ করছি। প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে চাই। নারীদের নিয়ে আরও বড় পরিসরে কাজ করার ইচ্ছে আছে। সমাজের অসহায় নারীদের বিনামূল্যে খাবার তৈরি প্রশিক্ষণ দিতে চাই। এর মাধ্যমে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।
সময়ের আলো/জিকে