ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

জাতিসংঘে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়াল প্রধান উপদেষ্টার ভাবমূর্তি
আলো ছড়ালেন ইউনূস
প্রকাশ: রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৩:১৬ এএম আপডেট: ২৯.০৯.২০২৪ ১০:৩৯ এএম  (ভিজিট : ৪০২)
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কারণেই ৭৯তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ। অধিবেশনে ভারত ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিশ্বের সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে নতুন করে রাষ্ট্র গঠনে বাংলাদেশকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। চিরাচরিত নিয়ম ভঙ্গ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অধিবেশনের সাইড লাইনে বৈঠক করেন। সহযোগিতার অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাংক সহজ শর্তে বাংলাদেশকে সাড়ে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ মুদ্রা ঋণ দেওয়ার বার্তা দিয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা নিউইয়র্ক সময় শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টায় জেএফকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর রাত ২টা ১৫ মিনিটে (ঢাকা সময়) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাদের পৌঁছানোর কথা রয়েছে। জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে অধ্যাপক ড. ইউনূস অধিবেশনের সাইড লাইনে প্রায় ৪০টি বড় অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অধ্যাপক ড. ইউনূস গত ২৬ সেপ্টেম্বর সর্বোচ্চ ১৬টি অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ অন্তত ১২ জন বিশ্ব নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসব অনুষ্ঠানে সবার জন্য স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাম্প্রতিককালের ঘটনা প্রবাহগুলো বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে সবার কাছে সহযোগিতা চান। এর আগে ২০২৩ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াশিংটন সফরে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু ওই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রাজনৈতিক নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। অথচ এবার জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইড লাইনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টসহ দেশটির একাধিক নেতা নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ায় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বৈঠকে দুই নেতা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এগিয়ে নিতে নিশ্চয়তা দেন। দুই দেশের এই সম্পর্কের মূলে রয়েছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও দুই পক্ষের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব। দুই দেশের সরকারের মধ্যে যোগাযোগ আরও দৃঢ় হবে বলে জো বাইডেন বৈঠকে বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচিতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে যুক্তরাষ্ট্র।

অধ্যাপক ড. ইউনূসের সঙ্গে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির বৈঠক শেষে ইতালি সরকার এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইড লাইনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচিতে সহযোগিতা করার কথা জানিয়েছে ইতালি। যাতে বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়। বৈঠকে অভিবাসন নিয়েও দুই নেতা আলোচনা করেন। অনিয়মিত অভিবাসন প্রতিরোধে দুই দেশ দ্বিপক্ষীয়ভাবে কাজ করবে।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন দার লিয়েনের সঙ্গে অধ্যাপক ড. ইউনূস গত শুক্রবার বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে উরসুলা ভন দার লিয়েন বলেন, বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করতে চাই যে দেশটির সংস্কার প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয় কমিশনের সমর্থন ও সহযোগিতা থাকবে। ইইউর গ্লোবাল গেটওয়ে প্রকল্পের আওতায় আমাদের দুই পক্ষের অংশীদারত্ব আরও শক্তিশালী ও স্থিতিশীল হবে।
ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাস জানিয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে জাতিসংঘে বাংলাদেশের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে নিউইয়র্কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ যোগ দেন। এই সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সঙ্গে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার, শিক্ষামন্ত্রী ড. খালেদ মকবুল সিদ্দিকী ও বিশেষ সহকারী তারিক ফাতেমি উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলকে ড. ইউনূস অনুষ্ঠানে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানান। দুই পক্ষের বৈঠকে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও বাড়াতে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।

নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গত বুধবার চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইড লাইনে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও নিবিড় করতে চায় চীন। বেইজিং ঢাকার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার মাধ্যমে কৌশলগত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চায়।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত শুক্রবার জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইড লাইনে সংস্থাটির মহাসচিব অ্যান্থনি গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠক করেন।

জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় জানিয়েছে, শান্তিরক্ষী মিশনসহ জাতিসংঘের সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ায় বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রশংসা করেন জাতিসংঘ মহাসচিব।

অ্যান্থনি গুতেরেস বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ এবং সংস্কার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে জাতিসংঘ। বৈঠকে দুজন রোহিঙ্গা সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও কথা বলেন।

এ ছাড়া কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক, ইউএনইউচসিআরের প্রধান ফিলিপো গ্রান্ডি, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুইজ্জু, যুক্তরাষ্ট্রের হুইপ সিনেটর ডিক ডারবিন, নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কুফ, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন, এইচএসবিসির গ্লোবাল সিইও নোয়েল কুইনসহ একাধিক বিশ্ব নেতা ও সংস্থা প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের মঞ্চেও বক্তব্য দিয়েছেন ড. ইউনূস। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নিজেও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

জাতিসংঘ সম্মেলনে অধ্যাপক ড. ইউনূস শুধু বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া নিয়েই কথা বলেননি, একই সঙ্গে ড. ইউনূস বৈশি^ক উত্তেজনা প্রশমনের বিষয়েও কথা বলেছেন। যেখানে রোহিঙ্গা সংকট, মধ্যপ্রাচ্য সংকট, ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশি^ক অর্থনৈতিক সংকট নিয়েও কথা বলেছেন।

এইচআইভি সংক্রান্ত জাতিসংঘের সাবেক সিইও এবং সমন্বয়ক, ভিয়েনায় বসবাসরত মনিকা বেগ এক্স হ্যান্ডেলে বলেন, শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয় ইইউ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, রাশিয়া ও প্রতিবেশী দেশগুলো (ভারত ছাড়া) ড. ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে এসব সংস্কার অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। অবাক লাগে যে ভারত ও কতিপয় ব্যক্তি বাংলাদেশের সংস্কারের বিপক্ষে এবং এসব ইস্যুতে তারা মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, এবারের জাতিসংঘ অধিবেশন অন্যরকম ছিল। অধিবেশনে অধ্যাপক ড. ইউনূস বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেন, যাকে বিশ্বের সবাই জানেন এবং বিশ্ব অঙ্গনে তার প্রভাবও রয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সার্বিক বিষয়ে যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে সবাই সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। অধ্যাপক ড. ইউনূসের ওপর আস্থা রেখেই বিশ্ববাসী নতুন বাংলাদেশকে দেখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে চলমান টানাপড়েনও এই সফরের মাধ্যমে ইতি ঘটবে বলে প্রত্যাশা করছি। অর্থনৈতিক খাতে স্বচ্ছতা ও বিনিয়োগের নতুন দিগন্তের সূচনা দেখতে পাচ্ছি। অনেক বেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা দেখতে পাচ্ছি। তবে বাংলাদেশ সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেষ পর্যন্ত এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা না হলে স্থিতিশীলতা আসবে না।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, জাতিসংঘে বাংলাদেশের এবারের সফর অনেক সফল হয়েছে, অনেক বছর এমন সাফল্য দেখা যায়নি। এবারের অধিবেশনের মধ্যমণি ছিলেন অধ্যাপক ড. ইউনূস। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের নেতারা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য লাইন ধরেছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আশ্বস্ত করেছে। তিনি অধিবেশনে যে ভাষণ দেন তাতে বৈশি^ক সব সমস্যা উপস্থাপন করেছেন। যে কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও ফিলিস্তিনের জনগণ তার ভাষণকে হাইলাইট করেছে। তবে ভারতের যে ক্ষতি হলো তা ভারতীয়রা এখনও বুঝেনি। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের জন্য ড. ইউনূস হাত বাড়িয়ে দিলেও ভারত ধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close