ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে পঙ্গু
পা হারিয়েও সুদূরযাত্রার স্বপ্ন
প্রকাশ: শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২:১০ এএম আপডেট: ২৮.০৯.২০২৪ ৩:০৯ এএম  (ভিজিট : ৩০৫)
আমার এক পা নেই, তবু কোনো দুঃখ নেই। আমার চোখের সামনে অনেককেই মরে যেতে দেখেছি। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গুলিতে তো প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গেছে। আমার নামও সেই তালিকায় থাকতে পারত। এক পা কেটে ফেলা হয়েছে। এখন আমি পঙ্গু হয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছি। কবে সুস্থ হয়ে স্কুলে যেতে পারব জানি না। আর স্কুলে গেলে বন্ধুরা হয়তো টিটকারি করে ল্যাংড়া বলেও ডাকবে। দুই পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে পারব না-তাতে কী? তবুও তো বেঁচে আছি। এরচেয়ে বড় আর কিছু হয় না। এই এক পা নিয়েই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখি, নতুন উদ্যমে আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাই। আমি হারতে রাজি নই। আমি আমার সিএনজিচালক বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।
এসব কথা এক নিশ্বাসে বলছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পা হারানো নবম শ্রেণির ছাত্র আল আমিন। তার বাড়ি পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার আমিনপুর এলাকায়। বর্তমানে সে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন।

আল আমিনের মতো পা কাটা না পড়লেও পা হারানোর শঙ্কা নিয়ে হাসপাতালে মরণ যন্ত্রণা ভোগ করছে আরও দুই শিক্ষার্থী। তারা হলো পটুয়াখালীর অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মো. হাসান ও ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ক্লাস নাইনের শিক্ষার্থী মো. শাহীন। তাদের তিনজনই অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান ও আন্দোলনের সময় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়। এর মধ্যে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে তাদের পুরো পরিবার। এমনকি তাদের পড়াশোনাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। 

তবে তারা পঙ্গুত্ব বরণ করলেও জীবনের কাছে হার মানতে রাজি নয়। সুস্থ হয়ে নব উদ্যমে নতুন করে বাঁচতে চায় এবং পরিবারের হাল ধরতে চায়-এমনই দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনজন। 

পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পা হারানো আল আমিনের বাবা সিএনজিচালক বাবুল হোসেন রাজধানীতে সিএনজি চালান। স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন বাড্ডা এলাকায়। কিন্তু আল আমিন গ্রামের বাড়িতে দাদার সঙ্গে থাকে আমিনপুরে। সেখানে স্থানীয় একটি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। আন্দোলন শুরুর দিকে ঢাকায় বাবা-মার কাছে এসেছিল। পরে আন্দোলন শুরু হলে আল-আমিনও তাতে জড়িয়ে যায়।

পরিবারের সদস্যরা জানান, মাসব্যাপী ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের বিজয়ের দিনে গত ৫ আগস্ট দুপুরে ছাত্র-জনতার সঙ্গে মেরুল বাড্ডা এলাকায় পতাকা হাতে বিজয় মিছিলে যোগ দিতে যায়। কিছুদূর এগোতেই তাদের মিছিল পুলিশের সামনে পড়ে। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। পরে এক পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। পুলিশও এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। পুলিশের ছোড়া গুলিতে পা, বুক, হাত ও পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয় অনেকেই। তাদের মধ্যে আল আমিনও গুলিবিদ্ধ হয়। সেখান থেকে ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে বাড্ডা এলাকায় একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করে। পরে সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর পায়ে গুলি লাগার কারণে মাংসে পচন ধরা শুরু করে। পরে চিকিৎসকরা আল আমিনের বাম পা কেটে ফেলেন। এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসা চলছে তার। এখন পর্যন্ত চিকিৎসায় তাদের লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। সব টাকাই ধারদেনা করা। 

আল আমিন সময়ের আলোকে বলেন, আমি ৫ তারিখ সকাল থেকেই মেরুল-বাড্ডা এলাকায় আন্দোলনের সঙ্গে ছিলাম। আমি ঘটনাস্থলে অনেককেই মারা যেতে দেখেছি। তাদের অনেককেই গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু আমি বেঁচে গেছি। প্রথমে পা কাটার পর খুব খারাপ লাগত। বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো আমার পা নেই। কিন্তু এখন লাগে না। আমি সুস্থ হয়ে আবার স্কুলে যেতে চাই। আমরা গরিব মানুষ। মা-বাবা আমার জন্য খুব কষ্ট করছে। আমি পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হতে চাই ও বাবা মার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।

তার বাবা বাবুল হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, আমার ছেলে পা হারিয়েছে। তবু শুকরিয়া। মারা যায়নি। প্রথম দিনই ২০ ব্যাগ রক্ত লেগেছে। কিন্তু আমি এক ব্যাগও জোগাড় করতে পারিনি। সবই ছাত্ররা ও বিভিন্ন মানুষে দিয়েছে। তবু আমার ছেলেটার যে এই অবস্থা করেছে আমি তার বিচার চাই। কেন গুলি করে পঙ্গু করে দিল।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার মা আছিয়া বেগম বলেন, ছেলেটার মুখের দিকে তাকালে বুক ফেটে যায়। চিকিৎসায় প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। আমার যা কিছু ছিল সব শেষ হয়ে গেছে। জানি না ভবিষ্যতে কীভাবে ছেলেকে সুস্থ করে তুলব।

অন্যদিকে পুলিশ সরাসরি অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে এমন অভিযোগ করে গুরুতর আহত মো. হাসান সময়ের আলোকে বলেন, আমি ৫ আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর মিছিল নিয়ে বের হই। পরে জুরাইন এলাকায় এলে পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে। আমার ডান পায়ে পুলিশ গুলি করে। শুধু আমাকে নয়, আমার সঙ্গে অনেককেই সরাসরি গুলি করে এবং আমার গুলি বের হয়ে আরেকজনের মাথায় লাগে। সেও গুরুতর আহত হয়। আমি জানি না সে কি এখন বেঁচে আছে না মরে গেছে। তবে আমি অনেক কষ্টে আছি। সারা শরীরে গুলির ক্ষত রয়েছে। পায়ের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা। পায়ে লোহার রড লাগানো। মনে হয় মরে যাওয়া এর চেয়ে ভালো। হুইল চেয়ার আমার ঠিকানা। কারও সাহায্য ছাড়া চলতে পারি না। দু’চোখের পাতা এক করতে পারি না। জানি না সুস্থ হতে পারব কি-না। নাকি আবার পা-টা কেটে ফেলতে হয়। তবে জীবনযুদ্ধে হারতে রাজি নন বলেও জানান তিনি। নতুন করে লড়াই করে রিকশাচালক বাবার দুঃখ ঘোচাতে চান তিনি।

তার বাবা আ. মজিদ সময়ের আলোকে বলেন, আমার ছেলেকে এমনভাবে গুলি করেছে যে হাঁটুর নিচে হাড় ভেঙে ৬ ইঞ্চি গর্ত হয়ে গেছে। সারাক্ষণ পুঁজ পড়ে। খুব চিন্তায় আছি ছেলের পাটা যেন কাটতে না হয়।

ছেলেকে এখানে ভর্তি হওয়ার পর তার আয় রোজগার সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি রিকশা চালিয়ে দিন আনি, দিন খাই। ছেলের খরচ চিকিৎসার ব্যয় জোগাতে সব কিছু বিক্রি করেছি। ছেলের চিকিৎসায় সহায়তা করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই। সন্তানের করুণ অবস্থা দেখে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন মা হাসি বেগম।

তিনি সময়ের আলোকে বলেন, জানি না আমার ছেলে আদৌ সুস্থ হবে কি-না। আর সুস্থ হলেও ঠিকভাবে হাঁটতে পারবে কি? আর সুস্থ হলেও কীভাবে পড়ালেখা করবে। আর কেমনে ওষুধের টাকা জোগাড় করব সেই দুশ্চিন্তায় সারাক্ষণ কান্নাকাটি করি আমি।

গত ৫ আগস্ট ঢাকার উত্তরা এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় মো. শাহীন। পরিবারের সদস্যরা জানান, শাহীনরা দুই ভাই। তারা দুজনই দাদার বাড়ি ফুলবাড়িয়া উপজেলার স্থানীয় এক স্কুলে পড়াশোনা করে। আর বাবা আ. জব্বার প্যারালাইসিসের রোগী হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী। তার মা শিউলি বেগম উত্তরা এলাকায় মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার এবং তাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালান। আন্দোলনের মাঝখানে মা-বাবাকে দেখতে ঢাকায় আসে শাহীন। পরে গণঅভ্যুত্থানের দিন শাহীন বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়। আহত হওয়ার পরে কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরলেও কোনো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি বলে অভিযোগ করে শাহীন।

 সে সময়ের আলোকে বলে, প্রথমে চিকিৎসা নিলে আজকে আমি আরও ভালো থাকতাম। আমার পায়ের অবস্থা এত খারাপ হতো না। তবুও বেঁচে আছি। আমার সঙ্গের একজনের বুকে গুলি লাগে, আরেকজনের শরীরে বেশ কয়েকটা গুলি লাগে আমার সামনেই। আমার পায়ে যখন গুলি লাগে তখন আমি পড়ে যাই। এরপর আর কিছু বলতে পারি না।

শাহীন বলে, আমরা গরিব মানুষ। খুব কষ্ট করে বড় হচ্ছি। আমার জন্য আমার মা অনেক কষ্ট করছেন। জানি না পা কি কেটে ফেলতে হবে নাকি। ডাক্তাররা বলেছেন, আরেকটি অপারেশন হবে, সেটার পর জানা যাবে ভালো হবে কি-না। তবে যত কষ্টই হোক, সুস্থ হয়ে মায়ের কষ্ট এবং বাবার স্বপ্নই পূরণ করতে চাই।

শাহীনের পাশেই বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন তার দাদি লাইলি বেগম। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, ছোট থেকেই ওরা দুই ভাই আমার কাছে থাকে। আমিই অনেক কষ্টে লালন পালন করে বড় করেছি। কখনো ভাবিনি এই অবস্থায় নাতিকে দেখতে হবে। আমরা গরিব মানুষ। তার মায়ের যৎসামান্য আয়ে টানাটানি করে সংসার চলে। এখন তার মা চিকিৎসার টাকা জোগাড় করবে, না কাজে যাবে? আর এভাবে কত চালাবে। 

তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত শাহীনের চিকিৎসায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সবই ধার-দেনা ও আত্মীয়স্বজনের সাহায্য করা টাকা। তাই আমার নাতিকে যারা পঙ্গু করেছে, বর্তমান সরকারের কাছে তাদের বিচার চাই ও সাহায্য কামনা করি।

সময়ের আলো/আরএস/





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close