ই-পেপার সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
ই-পেপার

সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

শরতে জোছনার জন্য বসে আছি
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২:১২ এএম  (ভিজিট : ৪৭৬)
কয়েক দিন ধরে অনবরত, অবিরাম, অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সকাল নেই। বিকাল নেই। রাত্রি নেই। কিংবা সময় অসময় নেই, বৃষ্টি পড়ছে। কখনো মুষলধারে। কখনো বা টাপুরটুপুর। অথচ এই বৃষ্টি যখনই খানিক বিরাম নেয়, ঘড়ি কিংবা ক্যালেন্ডারের দিনে না তাকিয়ে বলে দেওয়া যায়, এখন শরৎকাল। ঋতুর রানী তার আগমনের সব চিহ্নই ছড়িয়ে রেখেছে সর্বত্র। 
যদিও বলা হয়, বাংলার বুক থেকে ষড়ঋতু বিদায় নিয়ে এখন তিনটি ঋতুই শুধু প্রত্যক্ষ- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত। আসলেই কি তাই? সরল এবং সোজা উত্তর-না। তা হলে এই ভাদ্র আশ্বিনে অকাল বর্ষা কেন? প্রতিউত্তরে বলা যায়, কেন নয়? উত্তরটা হয়তো গোলমেলে ঠেকতে পারে। ব্যাপারটা শারদ আকাশের মতো পরিষ্কার করার আগে বিদ্যাপতির সাহিত্য-সরোবর থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। বিদ্যাপতি-মধ্যযুগের মিথিলার রাজদরবারের কবি। ব্রজবুলি ভাষায় লিখে গেছেন রাধা-কৃষ্ণের হৃদয়ার্তি। বিদ্যাপতি- সেই পদকর্তা যার ব্রজবুলি ভাষার মোহন মায়া পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আধুনিক যুগে রচনা করেছেন ‘ভানুসিংহের পদাবলি’। কৃত্রিম কাব্যভাষা ব্রজবুলিতেই। বিদ্যাপতির একটি বিখ্যাত পদের কয়েকটি পঙক্তি হলো-
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর॥
সরলার্থ করলে দাঁড়ায়, ‘ওগো সখি, আমার দুঃখের সীমা নেই। ভাদ্র মাসের এই ঘোর বাদলে আমার ঘর বা মন্দির শূন্য।’ যা বলতে চাচ্ছি, ভাদ্রে তথা, শরৎকালে বর্ষার প্রাদুর্ভাব শুধু এখনই নয়, মধ্যযুগেও ছিল। এখনও আছে। তা হলে এখনকার কবি-সাহিত্যিক কেন শরৎকালে বৃষ্টির গাথা, কথা কেন রচনা করে না? উত্তর-কে বলেছে করে না? হেলাল হাফিজ লিখেছেন, ‘ভাদ্রের বর্ধিত আষাঢ়ে সখ্য হয়েছিল, সে প্রথম, সে আমার শেষ!’ তার মানে বর্ষা শরৎকালে তখনো হানা দিয়েছিল, এখনও দেয়। আর তা কবি হৃদয়কে করে তোলে রসসিক্ত, বেদনাভারাতুর।
ভাদ্রে বৃষ্টির চিত্র আমরা কথাসাহিত্যেও পাই। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালি’ উপন্যাসের পঞ্চদশ পরিচ্ছেদে এমনই এক চিত্র এঁকেছেন। দুর্গা তার মাকে বলছে-‘মা শিগগির শিগগির ভেজে নাও। বড্ড মেঘ করে আসচে, বিষ্টি এলে আর ভাজা হবে না,-ঘরে যে জল পড়ে!-সেদিনকার মতো হবে কিন্তু-দেখিতে দেখিতে চারিধার ঘিরিয়া ঘনাইয়া-আসা মেঘের ছায়ায় বাঁশবনের মাথা কালো হইয়া উঠিল। খুব মেঘ জমিয়া আকাশ অন্ধকার  হইয়াছে, অথচ বৃষ্টি এখনো নামে নাই,-এ সময় মনে এক প্রকার আনন্দ ও কৌতূহল হয়-না জানি কী ভয়ংকর বৃষ্টিই আসিতেছে, পৃথিবী বুঝি ভাসাইয়া লইয়া যাইবে-অথচ বৃষ্টি হয় প্রতিবারই, পৃথিবী কোনোবারেই ভাসায় না, তবু এ মোহটুকু ঘোচে না। দুর্গার মন সেই অজানার আনন্দে ভরিয়া উঠিল, সে মাঝে মাঝে দাওয়ার ধারে আসিয়া নিচু চালের ছাঁচ হইতে মুখ বাড়াইয়া মেঘান্ধকার আকাশের দিকে চাহিয়া দেখিতেছিল।’
এখানে গরিবের গৃহের অবস্থার পাশাপাশি এক কিশোরীর মনোলোকের সত্যও উন্মোচিত হয়েছে।
বর্ষার পরে শরতের আগমন চড়া সুরে, কড়া দাগে না হলেও বোঝা যায়। শ্রাবণের কালো মেঘে ঢাকা আকাশ ঠিক ঠিকই একদিন নীল হয়ে ফুটে ওঠে। মনে হয় মস্ত নীল সাগর মাথার ওপর। এতটা আকাশ নীল আর কখনো দেখা যায় না। কালো মেঘগুলো বুড়ো হয়ে সাদা হয়ে যায় তাদের অবয়ব। শ্রাবণের তারুণ্যময় গর্জন থাকে না তাদের শরীরে। চলে আসে এক স্থিরতা। একদিন শরতের এই আকাশ দেখেই জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন,
‘এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল
ফুটে থাকে হিম শাদা-রং তার আশি^নের আলোর মতন;
আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ
রৌদ্রের দুপুর ভ’রে;’
শরতের আলাদা এক মাধুর্য আছে। সুরভি আছে। বাতাসে তা টের পাওয়া যায়। শরৎ আসার সঙ্গে সঙ্গে নদীগুলোও শান্ত হয়ে ওঠে। কাশফুলে ভরে দুই ধার। ওই যে বললাম শরতের আলাদা এক ঘ্রাণ আছে। এই ঘ্রাণটাকেই সলিল চৌধুরীর কাছে গন্ধ বলে মনে হয়েছে। তিনি লিখেছেন,
‘ও-ও -ও আয় রে ছুটে আয়
পুজোর গন্ধ এসেছে।
ঢ্যাম্ কুড়কুড়, ঢ্যাম্ কুড়াকুড়
বাদ্যি বেজেছে।
গাছে শিউলি ফুটেছে
কালো ভোমরা জুটেছে।
আজ পাল্লা দিয়ে আকাশে
মেঘেরা ছুটেছে।’
সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরে এই গানটি প্রথম রেকর্ড করেন সলিল চৌধুরীর মেয়ে অন্তরা চৌধুরী। গানটি পুজোর গান হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। যদিও পুজোর গান হিসেবেই এটি লেখা হয়েছিল বা এর জনপ্রিয়তা, তবু বলতে হয়, খুব চমৎকারভাবে এই গানে শরতের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। 
শরতে হিন্দু বা বৌদ্ধধর্মের ধর্মীয় উৎসব থাকলেও মুসলমানদের কোনো ধর্মীয় উৎসব এই সময় নেই। তবে শরতের শেষদিন অর্থাৎ আশি^নের শেষদিন এবং কার্তিকের শুরুর দিন নিয়ে এক লৌকিক উৎসবের প্রচলন মুসলমানের ঘরেও প্রচলন ছিল। আশি^নে রাঁধে, কার্তিকে খায়। এই উৎসবের জন্য নানা উপাচার সংগ্রহ করতে হতো। এই উৎসব পালনের নিয়ম ছিল সূর্য উঠার আগে গায়ে বাটা হলুদ-নিমপাতা মেয়ে গোসল করতে হতো। কাক ডাকার আগেই আগের দিন কেটে রাখা চালতা পাতায় জিভ দিয়ে লেহন দিতে হতো। বিশ্বাস করা হতো এত জিভে কোনো ঘা হবে না সামনের এক বছর। খাবার জন্য শালুক, এক ধরনের আলু, নারিকেল, খইসহ আরও কিছু রাখা হতো। খেসারি ডাল রান্না করা হতো তেঁতুল দিয়ে। গোসল করে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে তেঁতুলের খেসারি ডাল দিয়ে ভাত খাওয়ার ছিল অন্যরকম অনুভূতি। ওদিকে মা চুলোয় বসে যেতেন ভাপা পিঠা বানানোর জন্য। 
শরতের কাশফুল-শিউলি ফুলের সঙ্গে রয়েছে আমাদের শৈশব-কৈশোরের অপার বিস্ময়, যা সারাজীবনই বয়ে চলেছি। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালি’ সেলুলয়েড ফিতায় বন্দি করতে গিয়ে সত্যজিৎ অপু-দুর্গার রেলগাড়ি দেখতে যাবার জন্য কাশফুলের মাঝ দিয়ে যে ছুটে চলার যে দৃশ্য দেখিয়েছে, তা যেন আমাদেরই সবার কৈশোর। কাশফুলের ক্রেজ অব্যাহত থাকলেও অব্যাহত গাছ কাটার কারণে এখন কোনো গৃহস্থ বাড়িতে খুব কমই শিউলি গাছ দেখা যায়। অথচ নব্বই দশকেও যারা শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছে, তাদের সবারই শিউলি কুড়ানো ভোরের স্মৃতি আছে। 
শিউলি-মালা নিয়ে চমৎকার একটি গল্প লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। গল্পটি ‘শিউলী-মালা’ গ্রন্থের নাম গল্প। গল্পের শুরুর দিকেই কয়েক বাক্যে নজরুল শরতের একটি চিত্র এঁকেছেন। লিখেছেন, ‘একটু আগের বর্ষা-ধোওয়া ছলছলে আকাশ। যেন একটি বিরাট নীল পদ্ম। তারির মাঝে শরতের চাঁদ যেন পদ্মমণি। চারপাশের তারা যেন আলোক-ভ্রমর।’ এই গল্পে দেখি তরুণ ব্যারিস্টার আজহারের সঙ্গে দাবা খেলার সূত্রে পরিচয় হয় শিউলির। আজহার যতটুকু গান জানতো, সবটুকু তুলে দেয় শিউলির গলায়। তারা ভালোবেসেছিল পরস্পরকে কিন্তু মিলনের কথা তাদের মনে আসেনি। আজহার শিউলির স্মৃতিটুকু মনে ধারণ করে প্রতি বছর পহেলা আশি^নে নদীর জলে শিউলি ফুলের মালা ভাসিয়ে দেয়।
গল্পের শেষ স্তবক হলো, ‘আর তার সাথে দেখা হয়নি-হবেও না! একটু হাত বাড়ালেই হয়তো তাকে ছুঁতে পারি, এত কাছে থাকে সে। তবু ছুঁতে সাহস হয় না। শিউলি ফুল- বড় মৃদু, বড় ভীরু, গলায় পরলে সে দুদণ্ডে আউরে যায়! তাই শিউলি ফুলের আশি^ন যখন আসে-তখন নীরবে মালা গাঁথি আর জলে ভাসিয়ে দিই।’
শিউলি ফুলের মতোই যেন এই গল্পের কোমলতা। ভীষণ মৃদু। নরম। 
শরতের চাঁদ সবচেয়ে ফুটফুটে জ্যোৎস্না ছড়ায়। শরতের মতো এমন পূর্ণিমার চাঁদ অন্য কখনো দেখা যায় না। যদিও ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর নায়িকার রূপের বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন,
‘কে বলে শারদ শশী সে মুখের তুলা
পদনখে পড়ি তার আছে কতগুলা॥’
কবির দৃষ্টিতে প্রিয়ার রূপ শারদশশীর চেয়ে যতই সুন্দর হোক না কেন, আমরা এই শারদ পূর্ণিমাতেই কোজাগরি পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমার উৎসব হতে দেখি। এই পূর্ণিমাতেই গৌতম বুদ্ধ গৃহ ছেড়ে ছিলেন। 
হুমায়ূন আহমেদ কবিতায় লিখেছেন,
‘আমি সিদ্ধার্থের মত
গৃহত্যাগী জোছনার জন্য বসে আছি।
যে জোছনা দেখা মাত্র গৃহের সমস্ত
দরজা খুলে যাবে।
ঘরের ভেতর
ঢুকে পড়বে বিস্তৃত প্রান্তর।’
হয়তো একদিন আমরাও ব্যক্তিগত শারদ পূর্ণিমার রাতে সিদ্ধার্থের মতো গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার ডাকে জীবন থেকে বেরিয়ে পড়ব।


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close