ময়মনসিংহের গৌরীপুরে গোবিন্দ জিউর মন্দিরের নির্মাণাধীন শারদীয় দুর্গাপূঁজার প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিশোরকে হাতেনাতে আটক করা হয়েছে। তার নাম ইয়াসিন মিয়া (১৭)। সে গৌরীপুর ইউনিয়নের গজন্দর গ্রামের মো. আব্দুল হান্নান ও মোছা. মিনি বেগমের ছেলে।
বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দিবাগত ভোররাতে গৌরীপুর পৌর শহরের গোবিন্দ জিউর মন্দিরে এ ঘটনা ঘটে। আটক ইয়াসিনের বাড়ি গৌরীপুর শহরের ঘটনাস্থল ওই মন্দির থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। বাবা মো. আব্দুল হান্নান মানসিক ভারসাম্যহীন বলে এলাকাবাসি জানিয়েছেন।
ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার আজিজুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, গৌরীপুর মধ্যবাজার পূজা উদযান কমিটির উদ্যোগে প্রতিবছর মধ্যবাজারে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। এসব পুঁজা মণ্ডপের প্রতিমা বানানো হয় উপজেলা কৃষি অফিস সংলগ্ন গোবিন্দ বাড়িতে অবস্থিত গোবিন্দ জিউর মন্দিরে। গত ২০ দিন ধরে মন্দিরটিতে প্রতিমা বানানোর কাজ চলছিল। এখন শুধু প্রতিমার রঙ করা সাজশয্যা বাকি ছিলো। পূঁজা শুরুর একদিন আগে মন্দির থেকে মণ্ডপে প্রতিমা নেওয়ার কথা ছিলো।
গোবিন্দ জিউর মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক স্বপন এস জানান, গোবিন্দ জিউর মন্দিরে শারদীয় দুর্গাপূঁজায় বিভিন্ন মণ্ডপের জন্যে প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন মৃৎশিল্পীরা। প্রায় সব প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এখন শুধু রঙের কারু কাজ বাকি রয়েছে। এরই মধ্যে বুধবার দিবাগত রাতে শহরের মধ্যবাজার পূজা মণ্ডপে প্রতিমা ভাঙচুর করে ইয়ামিন নামের এক কিশোর।
তিনি জানান, আটক ওই ইয়াসিনকে সন্ধ্যা থেকেই মন্দিরের আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন অনেকেই। রাতে মন্দিরের প্রধান ফটক তালাবন্ধ থাকায় সে মন্দিরের পেছনের ছোট একটি গেইট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে এবং প্রতিমা ভাঙচুর করে।
মধ্যবাজার পূজা কমিটির সাবেক সভাপতি পীযুষ রায় গণেশ সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার ভোররাতে মন্দিরে হামলা করে এক যুবক। সে তিনটি প্রতিমার মাথা, কয়েকটি প্রতিমার শরীরের বিভিন্ন অংশ ভেঙে ফেলে। ভাঙচুর শেষে একটি কালি প্রতিমা কাঁধে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। ভোররাত সাড়ে ৪টার দিকে মন্দিরের পাশের বাড়ির ডলি রানী কাঁধে করে প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে চিৎকার শুরু করেন। ওই সময় প্রতিবেশী গোবিন্দ চন্দ্র বিশ্বশর্মা ও ডলি রাণীর ছেলে প্রত্যয় দাস এসে যুবকটিকে হাতেনাতে ধরে ফেলে এবং তাকে একটি খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে।
প্রত্যক্ষদর্শী গোবিন্দ জিউর মন্দির এলাকার ভাড়াটিয়া লিটন দাসের স্ত্রী ডলি রানী জানান, প্রকৃতির ডাকে তিনি ঘরের বাইরে গেলে দেখতে পান একজন কিশোর নির্মাণাধীন শারদীয় দুর্গা প্রতিমাগুলো ভাঙচুর করছে। তখন তিনি ডাকচিৎকার শুরু করেন। তার ডাক চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে ওই কিশোরকে হাতেনাতে আটক করে।
পূজা উযদাপন কমিটির সভাপতি রতন চন্দ্র সরকার জানান, ইয়াসিন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। তার নামে সমাজসেবা অধিদফতরের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী পরিচয় পত্র রয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসেনর লোকজনের সেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কার্ড তাদের দেখিয়েছেন। ঘটনার পেছনে কারো ইন্দন থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন তিনি। এসময় উপস্থিত হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই বলছেন ইয়াসিনের বাবা মো. আব্দুল হান্নান মানসিক ভারসাম্যহীন।
গৗরীপুর থানার ওসি মির্জা মাজহারুল আনোয়ার জানান, প্রতিমা ভাঙচুরের অভিযোগে ইয়াসিনকে থানায় আনা হয়েছে। তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা হলে জানা যায় মো. ইয়াসিন মিয়া বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয় থেকে নিয়মিত ভাতা দেয়া হয় তাকে। প্রাথমিক তদন্ত এসংক্রান্ত একটি ভাতার কার্ড পেয়েছে পুলিশ।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাহফুজ ইবনে আইয়ুব জানান, গজন্দর গ্রামের মো.আব্দুল হান্নানের ছেলে মো. ইয়াসিন মিয়া জন্মের পর থেকেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়ের আওতাধীন সমাজ সেবা অধিদফতরের ২০১৭ সালেই প্রতিবন্ধী জরিপে তালিকাভুক্ত হয়েছে। সে ২০২১ সাল থেকেই জিটুপির মাধ্যমে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হিসেবে ভাতা পাচ্ছে।
এদিকে জনৈক জয় বিশ্বাসের পোষ্ট শেয়ার করে দুপুর ১২টায় অভিনেত্রী জোতিকা জ্যোতি নিজের ভেরিফাইট ফেসবুক টাইম লাইনে লিখেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত আমার গৌরীপুরেও...আহারে আমার শান্ত শ্যামল গৌরীপুর !!!’
এরপর দুপুর আড়াইটায় তিনি লিখেছেন, “ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর, আমার উপজেলা। উন্নয়নে অবহেলিত এই জনপদ নানান সমস্যায় জর্জরিত থাকলেও এখানে কোন ধর্মীয় উগ্রবাদ নেই, কোন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ নেই। এখানে সকল ধর্ম আর রাজনৈতিক দলের লোকেরা মিলেমিশে থাকে। এখানকার মানুষেরা সরল ও সহজ।
সাম্প্রদায়িক হামলা বা মূর্তি ভাঙার ইতিহাস এই অঞ্চলে ছিলনা কোনদিন। আজ ২০২৪ সালের এই সেপ্টেম্বরে প্রথম দূর্গা মণ্ডপের মূর্তি ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। শুধু হিন্দু সম্প্রদায় নয়, সকল ধর্মের সাধারণ মানুষের এই ঘটনায়
স্তভিত, উৎকণ্ঠিত। আমি এই সাম্প্রদায়িক হামলায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছি। কারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে সঠিক বিচারের মাধ্যমে এমন শাস্তি দেওয়া হোক যেন এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এবং মূর্তি পুনঃস্থাপনসহ অন্যান্য সব ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। গৌরীপুরের মানুষদের বলবো, আপনারা একসাথে এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন-ক্ষতিপূরণ দাবি করুন। হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের বলছি, আপনার ভয় না পেয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানান, নিজের
অধিকার আদায় ও রক্ষা করুন। এই দেশ, এই মাটি আমাদের মা- আমরা দেশ ছেড়ে যাব না। আমি আপনাদের পাশে আছি।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন পোষ্ট দেখে অনেকেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনেকেই জানতে চেয়েছেন, তিনি আটক কিশোর সম্পর্কে কিছুই লিখেননি কেন। কিশোরটি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী একথাটাও কি তিনি কারো কাছে শোনেন নি। তার বক্তব্যকে উসকানি বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
সময়ের আলো/জিকে