ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

পাহাড় সংকট নিয়ে গুজবের মহামারি
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৭:৩০ এএম  (ভিজিট : ৩১২)
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক দিক নেহায়েত কম নয়। বিপরীতে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডেও এই মাধ্যমের ভূমিকা ভয়াবহ। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচন কিংবা যেকোনো সামাজিক পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে। সংকটে অপতথ্য কিংবা গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি অশান্ত করে তোলা হয় এই মাধ্যমে। পার্বত্য অঞ্চলের সাম্প্রতিক সহিংস বাস্তবতার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে একই চিত্র। পাহাড় ঘিরে যেন গুজবের মহামরি চলছে। পাহাড়ের সংকট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন পর্যন্ত ১১টি গুজব শনাক্ত করেছে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার। সংস্থাটির সিনিয়র ফ্যাক্টচেকার তানভীর মাহতাব আবীর সময়ের আলোকে বলেন, অপতথ্যের এই মহামারির প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। এসব রুখতে দল-মত নির্বিশেষ সচেতন সব মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। 

গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে মো. মামুন নামের এক বাঙালি তরুণকে হত্যার জেরে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সহিংসতা হয়েছে। সংঘাতের এই রেশ পাশর্^বর্তী জেলা রাঙামাটিতেও ছড়িয়েছে। এসেছে মৃত্যুর খবর। ঘটনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছড়াচ্ছে গুজব ও অপতথ্যের প্রবাহও।

শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) বেশকিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যের সঙ্গে অস্ত্র হাতে পাঞ্জাবি পরিহিত এক ব্যক্তির ছবি পোস্ট করে দাবি করা হয়, ছবিটি পার্বত্য এলাকার সাম্প্রতিক ঘটনার দৃশ্য এটি। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ছবিটি পার্বত্য এলাকার নয়। রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত একজন কয়েদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গত ১৬ আগস্ট শুক্রবার কারাগারে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যায় সেনাবাহিনীর একটি দল। ছবিটি সে সময়ের। তবে অস্ত্র হাতে পাঞ্জাবি পরা ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ-সংক্রান্ত ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, সে সময় সিভিল ড্রেসে থাকা একাধিক ব্যক্তির হাতেই অস্ত্র ছিল। কারাগারটির সিনিয়র জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক বলেছেন, এই ব্যক্তির নাম মো. মিজানুর রহমান। তিনি কারারক্ষী হিসেবে রংপুর কারাগারে কর্মরত।

এদিকে খাগড়াছড়ির দিঘীনালাকে হ্যাশট্যাগে রেখে কতিপয় ফেসবুক পোস্ট দেওয়া হয়েছে। জঙ্গল সদৃশ এলাকায় কিছু পাহাড়ি ব্যক্তির জড়ো হয়ে বসে থাকার দৃশ্য যুক্ত করে ওইসব পোস্টে দাবি করা হয়েছে যে, ‘অনেকের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, কয়েকজনকে হত্যা করা হয়েছে। না জানি আজ রাতে আরও কতজনের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়, কতজনকে হত্যা করা হয়। সে জন্য এরা পালিয়ে বেরাচ্ছে’। তবে এই ছবিটিও সাম্প্রতিক নয়। ছবিটি অন্তত চলতি বছরের মে মাস থেকে ইন্টারনেটে রয়েছে। এক্সে গত ১৯ মে এই ছবিসহ একটি পোস্ট পাওয়া যায়। ২০ মে ভারতীয় গণমাধ্যম ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনেও একই ছবি প্রচার করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বেশকিছু শরণার্থী ভারতের মিজোরামের লংৎলাই জেলায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। 

অপতথ্যের এই জোয়ারে ধর্মীয় স্থাপনা-সংক্রান্ত ভুল তথ্যের প্রচারও থেমে নেই। ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন এক্সে খাগড়াছড়ি এবং ফেসবুকে রাঙামাটির দৃশ্য দাবিতে পোড়া মূর্তির ছবি প্রচার করে এটিকে পাহাড়ে সংকটের সাম্প্রতিক দৃশ্য বলে দাবি করেছেন। তবে ভাইরাল ছবিটি অন্তত চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে ইন্টারনেটে রয়েছে। গত ১০ জানুয়ারি এ-সংক্রান্ত একাধিক পোস্ট পাওয়া যায়, যেখানে দাবি করা হচ্ছে, এটি ৬ জানুয়ারির ঘটনা। সেদিন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার শরনংকর ভিক্ষুর মন্দির জ্ঞানশরণ মহারণ্য বৌদ্ধ বিহার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।  

এদিকে অস্ত্রসহ রাস্তা পার হচ্ছে পাহাড়ি ব্যক্তিরা এমন দাবিতে দুইটি ভিডিও পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক দৃশ্য বলে দাবি করা হচ্ছে ফেসবুকে। তবে রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধানে দেখেছে, ভিডিও দুইটি ফিলিপাইনের। সাত্তার জাক্কাল নামের একটি ফেসবুক পেজে এই দুইটি ভিডিও ১৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। পেজটি ফিলিপাইন থেকে পরিচালিত হচ্ছে। তা ছাড়া ভিডিওর বিভিন্ন উপাদান (গাড়ির নাম্বার প্লেট, গ্যাস স্টেশনের নাম, মোবাইল পেমেন্ট পরিষেবা জিক্যাশের ব্যানার) বিশ্লেষণ এবং পরবর্তীতে যাচাই করে এটা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ভিডিও দুইটি ফিলিপাইনেরই।

অস্ত্র হাতে আরও কিছু ব্যক্তির ভিন্ন আরেকটি ভিডিওকেও পার্বত্য চট্টগ্রামের দৃশ্য বলে দাবি করা হচ্ছে ফেসবুক ও ইউটিউবে। তবে রিউমর স্ক্যানার অনুসন্ধান করে দেখেছে, সেই ভিডিওটি ভারতের আসামের। ভিডিওটির অগ্রভাগে যাকে দেখা যাচ্ছে, তার নাম সামবোর রংপি। তিনি আসামের একজন পুলিশ সদস্য। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ১৭ জুলাই মূল ভিডিওটি পোস্ট করা হয়। একই ব্যক্তি গত ৩ সেপ্টেম্বর আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করেন তার অ্যাকাউন্টে। এটিকেও বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের দাবিতে  প্রচার করা হয়েছে ফেসবুকে।

রাঙামাটিতে মার্কিন সেনারা ঢুকে পড়ছে দাবি করেও একটি ভিডিও প্রচার হতে দেখা গেছে। যাচাই করে দেখা গেছে, এই ভিডিও সাম্প্রতিক সময়ের নয়। ভিডিওটি এক্সে গত ৩০ মে বায়োতে ফ্রান্স উল্লেখ আছে এমন একটি অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা হয়। তবে ভিডিওটির বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে এটা নিশ্চিত যে, এটি বাংলাদেশের বা সাম্প্রতিক সময়ের ভিডিও নয়। বর্তমানে রাঙামাটির অবস্থা দাবি করে একটি ছবি পোস্ট হচ্ছে ফেসবুকের একাধিক অ্যাকাউন্টে। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, ছবিটি মিয়ানমারের। 

দেশের যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে মৃত্যুর গুজব একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাহাড়ের সাম্প্রতিক  সংকটেও তার ব্যতিক্রম হযনি। ব্যারিস্টার এবং সলিসিটর নিঝুম মজুমদার, আওয়ামী যুব মহিলা লীগের যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি ইয়াসমিন সুলতানা পোলেনসহ একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে জেনার চাকমা নামে এক ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পুরোনো পোস্টের স্ক্রিনশট যুক্ত করে দাবি করা হচ্ছে, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সংঘাতের ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তবে রিউমর স্ক্যানারকে জেনার চাকমা নিশ্চিত করেছেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ গুজব। তিনি সুস্থ আছেন এবং বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন। এই বিষয়ে বিভ্রান্তি মূলত নামের কারণে। খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ এবং গোলাগুলিতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে গণমাধ্যম। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে  জুনান চাকমা (২০) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। ‘জুনান’ নামটিকে ‘জেনার’ ভেবে নিয়ে জীবিত ব্যক্তির নিহত হওয়ার দাবিসংবলিত পোস্ট করেছেন নেটিজেনরা।

রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশের সিনিয়র ফ্যাক্টচেকার তানভীর মাহতাব আবীর। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, একটি দেশের যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে গুজবের প্রচার এবং প্রসার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ সার্বিক বিষয়গুলোতে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতেও একই ধরনের আশঙ্কা রয়েছে। সে কারণেই রিউমর স্ক্যানার গুজব এবং অপতথ্যের ছড়িয়ে পড়া রোধে সার্বক্ষণিক মনিটরিং এবং ফ্যাক্টচেকিং কার্যক্রম চালু রেখেছে। 

তানভীর আরও বলেন, সাম্প্রদায়িক গুজব, মৃত্যুর ভুয়া তথ্য, ভিন্ন দেশের বা পুরোনো ঘটনাকে সাম্প্রতিক পরিস্থিতির দাবিতে প্রচারের মাধ্যমে চলমান সংকটকে আরও ভয়াবহ রূপ দেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। অপতথ্যের এই ভয়াবহতা রুখতে দল-মত নির্বিশেষ সচেতন সব মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। 

সময়ের আলো/জিকে




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close