ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

নিম্ন আয়ের মানুষের আক্ষেপ
পঁচিশ বছরেও পাতে ওঠেনি ইলিশ
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১২:১৬ এএম  (ভিজিট : ৬৮৮)
ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাজারে ইলিশের জোগান ও দাম কমার আশায় ছিল দেশের মানুষ। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। চলতি বছরের প্রথমার্ধে আগের বছরের তুলনায় ইলিশের উৎপাদন কম হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। এর প্রভাব পড়েছে বাজারেও। ভরা মৌসুমেও সাধারণের সাধ্য ছাড়িয়ে গেছে ইলিশের দাম। রফতানি বন্ধ করেও মেলেনি সুফল। এমনকি ২৫ বছরেও পাতে ইলিশ না ওঠার আক্ষেপ শোনা গেছে নিম্ন আয়ের মানুষের মুখে।

এদিকে ভারতে রফতানির খবরে ইলিশের দাম আরেক দফা বাড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, ইলিশের এখন ভরা মৌসুম, তারপরও উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বাজারের তালিকা থেকে বাদ পড়ছে ইলিশ। স্বল্প আয়ের মানুষ ইলিশের ধারে-কাছেও যেতে পারছে না। 

প্রচলিত কথায় আছে, ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ এক দিকে ইলিশের দাম বাড়ছে, অন্যদিকে অভিভাবকহীন বাজারে দাপট দেখাচ্ছে অদৃশ্য সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ইলিশের বাজার। দাম আকাশচুম্বী।  

বাজার নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মনিটরিং করা জরুরি বলে মনে করছেন ক্রেতারা। 

বিক্রেতারা দাবি করছেন, আগে যে পরিমাণ ইলিশ আসত এখন আর সেই তুললায় আসছে না। সরবরাহ কম থাকায় ইলিশের দাম বাড়তি রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীতে চর পড়া এবং পানি কমে যাওয়ার কারণে ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে। সাগর ও নদীতে সৃষ্ট ডুবোচর ও নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ার কারণে সমুদ্র থেকে ইলিশ মিঠাপানিতে আসতে বাধা পেয়ে গতিপথ পরিবর্তন করছে।

সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা। ১ কেজি থেকে ১ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা। ৭৫০ থেকে ৯৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। এ ছাড়া ৪৫০ গ্রাম থেকে তার বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা কেজি।

গত চার বছরে গণমাধ্যমের খবর বিশ্লেষণে জানা যায়, ২০২০ সালে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকায়। সোয়া কেজি থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০ টাকা কেজিতে। ২০২১ সালে এক কেজি ২০০ গ্রাম থেকে এক কেজি ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ২৫০ টাকায়। এক কেজি থেকে এক কেজি ১০০ গ্রাম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়, ৮০০-৯০০ গ্রাম ৭০০-৮০০ টাকায়, ৫০০-৬০০ গ্রাম ৪৮০-৫০০ টাকা এবং ৪০০ গ্রাম ৪০০-৪২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
 
২০২২ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণে আরও জানা যায়, এক কেজি ওজনের ইলিশ ১ হাজার ১৫০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৩ সালে ১ হাজার ২০০-১ হাজার ৩০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৭০০-১ হাজার ৮০০ টাকা কেজি, ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ১ হাজার ৪৫০-১ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। আর ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয় ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে। 

অন্যদিকে দুর্গাপূজা ঘিরে প্রতি বছরের মতো এবারও বাংলাদেশ থেকে ইলিশ যাচ্ছে ভারতে। ইতিমধ্যে ৩ হাজার টন ইলিশ রফতানির অনুমোদন দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর বাইরে গত ৫ বছরে ভারতে ৫ হাজার ৫৯৮ টন ইলিশ রফতানি হয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭৬ টন ইলিশ ভারতে রফতানি হয়। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৯৯ টন ইলিশ রফতানি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ২৩০ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৯১ টন ইলিশ রফতানি করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮০২ টন ইলিশ ভারতে রফতানি করা হয়। 

তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি, গত কয়েক বছরে যে পরিমাণ রফতানির অনুমোদন হয়েছে সে অনুযায়ী ইলিশ রফতানি হয়নি।

মৎস্য অধিদফতরের হিসাব বলছে, গত এক দশকে ইলিশ উৎপাদনের হার ছিল আকর্ষণীয়। বিশেষ করে ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ টনের বেশি। 

হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৫ হাজার টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৬৭ হাজার টন ও সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। অর্থাৎ শেষ পাঁচ বছরে গড়ে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে আড়াই শতাংশের বেশি। 

তবে চলতি বছরের প্রথমার্ধে আগের বছরের তুলনায় ইলিশের উৎপাদন কম হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। কারণ জানতে চাইলে শেরে বাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিকস ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. কাজী আহসান হাবিব গণমাধ্যমে বলেন, বিভিন্ন নদীর ভিন্ন চরিত্র বিরূপ আবহাওয়ার জন্য দিন দিন আমাদের ইলিশের উৎপাদন কমেছে। এর মধ্যে সাগর ও নদীতে সৃষ্ট ডুবোচর ও নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ার কারণে সমুদ্র থেকে ইলিশ মিঠাপানিতে আসতে বাধা পেয়ে গতিপথ পরিবর্তন করা অন্যতম কারণ।

বাজারে সরবরাহ কম থাকায় দাম চড়েছে ইলিশের। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ইলিশের দরকষাকষি করছিলেন রানী দাস। দামের এক পর্যায়ে তিনি ইলিশ না কিনে অন্য মাছ কেনেন। রানী দাস সময়ের আলোকে জানান, রাজধানীর তেজকুনিপাড়ায় পরিবার নিয়ে থাকেন। তিনি বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ইলিশসহ সব জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। প্রতিনিয়ত সবকিছুরই দাম বাড়ছে। কিন্তু আমাদের বেতন তো বাড়ে না। তাই সংসারে খরচ চালাতে আমাদের বাজারের তালিকা কাটছাঁট করতে হয়। খেতে ইচ্ছে করলেও ইলিশের স্বাদ পাই না। 

রফিকুল ইসলাম নামের আরেক ক্রেতা বলেন, ইলিশ কেনার কথা চিন্তা করাটাই এখন বিলাসিতা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ভেবেছিলাম ইলিশ স্বল্প দামে পাব। কিন্তু সেই আশায় এখন গুড়ে বালি। শুনেছি ৩ হাজার টন ইলিশ ভারতে রফতানি করা হবে। তা হলে আমাদের দেশে তো ইলিশের দাম আরও বাড়বে। বাজার সিন্ডিকেট দমন না করলে দাম কমানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মাছ বিক্রেতা হাবিবুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, অনেক ক্রেতা শুধু দাম জিজ্ঞেস করে চলে যায়। ইলিশ নেয় না। 

তিনি বলেন, বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম। তাই দামও বাড়তি। এ ছাড়া ইলিশের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন নির্ধারিত সময়ে মা ইলিশ ধরা থেকে অনেকেই বিরত থাকেন না। অসুদপায়ে অনেকে মা ইলিশ শিকার করেন।

রাজধানীর ফার্মগেটে পরিবার নিয়ে থাকেন আবদুল খালেক নামের এক রিকশাচালক। পরিবারের সদস্য ছয়জন। তিনিই একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। সময়ে আলোকে তিনি বলেন, দিনে যা আয় করি তাতে সংসারের খরচই জোটে না। পরিবার নিয়ে সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার ওপর ইলিশ খাওয়ার চিন্তা করাটা এক ধরনের দুঃস্বপ্ন। আবেগের সুরে তিনি বলেন, গত ২৫ বছরেও পাতে ওঠেনি ইলিশ।

ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক মোল্লা এমদাদুল্লাহ সময়ের আলোকে জানান, আবহাওয়ার ভিন্নতা এবং নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ার কারণে ইলিশের উৎপাদন আপাতত কিছুটা কম। ফলে দাম বাড়ছে। এ ছাড়া ভারতে রফতানির খবরে ইলিশের দাম বাড়তে পারে- এটা স্বাভাবিক। বাজারে সিন্ডিকেট বলতে তেমন কিছু নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইলিশ ধরা থেকে শুরু করে হাতবদল হয় মাত্র। আর এই হাতবদলের কারণেই দাম বেড়ে যায়। তবে দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আমরা আপতত কাজ করছি না।

সময়ের আলো/জিকে




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close