ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

যুদ্ধের ময়দানে সাংবাদিকতা
প্রকাশ: সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:৫৬ এএম আপডেট: ২৩.০৯.২০২৪ ৭:৫৩ এএম  (ভিজিট : ১৯৭)
উপসাগরীয় যুদ্ধ, ১৯৯১ সাল, ইরাক অধিকৃত কুয়েতের একটি নতুন উপশহর। বিস্তীর্ণ মরুর বুকে গড়ে উঠেছে বেশকিছু ঘরবাড়ি ও অন্যান্য অবকাঠামো। একজন যুদ্ধ সাংবাদিকের বর্ণনায় এ উপশহরে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন মিত্রবাহিনীর জঙ্গিবিমান থেকে বোমা ফেলার দৃশ্য সরাসরি প্রচার করেছে সিএনএন টেলিভিশন। ক্যামেরা তাক করে আছে, উপশহরে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া ও বালির দিকে। নেপথ্য থেকে বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন সিএনএনের যুদ্ধ সাংবাদিক। ইরাকি বাহিনীর কামান কিংবা সামান্যতম ভুলে মিত্রবাহিনীর জঙ্গিবিমানের বোমা এ যুদ্ধ সাংবাদিক কিংবা তার সঙ্গীদের ভবলীলা শেষ করে দিতে যথেষ্ট। কিন্তু ক্যামেরা চলছে, সেই সঙ্গে বর্ণনা।

এবার ক্যামেরার সামনে একটি কালভার্ট। দূরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। হঠাৎ একটি কার অতি দ্রুত অতিক্রম করল সেই কালভার্ট। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বোমা পড়ে কালভার্টের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়ায় হারিয়ে যায় কালভার্ট। যুদ্ধ সাংবাদিক চিৎকার করে ওঠে, ‘হায় ঈশ্বর, জানি না কারের চালক রিয়ারভিউ মিররে পেছনে দেখার আয়নায় কী দেখেছে। সম্ভবত সে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান ড্রাইভার।’ এর পরপরই সরাসরি সম্প্রচার ছেড়ে স্টুডিওতে ফিরে আসে সিএনএন। প্রিয় পাঠক, এটি কোনো কাল্পনিক দৃশ্য কিংবা নাটক-চলচ্চিত্রের দৃশ্য নয়। সিএনএন টেলিভিশনে সত্যি সত্যি এবং সরাসরি সম্প্রচারিত একটি সংবাদ। এমনি ধরনের হাজারও সংবাদ নিয়ে কাজ করেন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার রোমাঞ্চপ্রিয় একঝাঁক সংবাদকর্মী, যাদের পরিচয় যুদ্ধ সাংবাদিক বা ওয়ার করসপনডেন্ট।

ইউরোপের ইতিহাসের একটি বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে নেপোলিয়নিক ওয়ার বা নেপোলিয়ান যুগের যুদ্ধ। ১৮০৩ সাল থেকে ১৮১৫ সালের মধ্যে এসব যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এসব যুদ্ধ এবং পূর্ববর্তী ফরাসি বিপ্লবজুড়ে রয়েছে ফ্রান্সের শাসক, সেনাপতি ও সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপাটের নাম। নেপোলিয়নের শাসনামলের শেষ সাত বছরে (১৮০৭ থেকে ১৮১৪ সাল) সংঘটিত হয় পেনিসুলার ওয়ার বা উপদ্বীপীয় যুদ্ধ। এ যুদ্ধে একদিকে ছিল ইংল্যান্ডের সমর্থনপুষ্ট স্পেন ও পর্তুগাল আর অন্যদিকে ছিল নেপোলিয়ন তথা ফ্রান্সের দখলদার বাহিনী। এ যুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ সৈন্য ও সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটে। এ যুদ্ধ বিভিন্ন কারণে প্রসিদ্ধি লাভ করে, যার অন্যতম যুদ্ধ সাংবাদিক সৃষ্টি।

১৮০৮ সালে ইংল্যান্ডের ‘দি টাইমস অব লন্ডন’ পত্রে ডাইরি লিখে পরিচিতি পাওয়া লেখক দাসপ্রথা বিরোধী নেতা এবং পেশায় একজন আইনজীবী (ব্যারিস্টার) হেনরি ক্রাব রবিনসনকে দায়িত্ব দেন পেনিসুলার ওয়ার সংক্রান্ত খবর সংগ্রহ করার জন্য। তিনি সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যুদ্ধের বাস্তবচিত্র লিখে পাঠাতেন যা পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। ফলে যুদ্ধ শেষে ইতিহাসভিত্তিক বই পড়ে যুদ্ধ সম্পর্কে জানার বিপরীতে সরাসরি সাংবাদপত্র পড়ে যুদ্ধের বাস্তব অবস্থা অনুধাবনের পথ সৃষ্টি করা হয়। এভাবেই আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ সাংবাদিকতার শুরু। 

১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই থেকে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর- এ চার বছর পৃথিবী প্রত্যক্ষ করে এক ভয়াবহ যুদ্ধ, যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধকালে রেডিও-টেলিভিশন বা ইন্টারনেটের তেমন প্রচলন না থাকায় জনগণকে সংবাদপত্র কিংবা লোকমুখে শোনা ঘটনার বর্ণনা থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতি অনুধাবন করতে হতো। তবে লোকমুখে শোনা যত কথা প্রায়ই অতিরঞ্জিত হতো। সার্বিক বিচারে বলা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকেই যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রনেতা ও সেনাপতিরা কাগুজে মিডিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রপাগান্ডা বা গুজব তৈরির কাজে ব্যবহার করা শুরু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধ ও নিজ কর্মকাণ্ডের পক্ষে জনমত সৃষ্টি, শত্রুর মনোবল ভেঙে দেওয়া, নিজস্ব সৈন্যদের চাঙা রাখা এবং সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি অন্যদিকে আকৃষ্ট করা। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ২১ বছর পর অর্থাৎ ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা, যা চলে ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ যুদ্ধে নিহতদের তালিকায় অন্তত ১৫ জন ছিলেন যুদ্ধ-সাংবাদিক। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ১০ বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ভিয়েতনাম, লাউস ও কম্বোডিয়ায় বিশ্বের দুই পরাশক্তির মাঝে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়, যা সংক্ষেপে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নামে পরিচিতি পেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে পরাজয় বরণ করে আমেরিকা। তবে পশ্চিমা মিডিয়া জগতের দাবি এই যুদ্ধে আমেরিকা প্রথমে হেরেছিল ওয়াশিংটনে, তারপর ভিয়েতনামে। কারণ বিভিন্নভাবে মিডিয়া আমেরিকার সেন্সরশিপের জাল থেকে বেরিয়ে যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছিল। যুদ্ধ-সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক কাছ থেকে উভয় বাহিনীর যুদ্ধ, সৈন্যদের দক্ষতা ও মনোবল, বেসামরিক ব্যক্তিদের ক্ষয়ক্ষতি এবং খোদ আমেরিকান সৈন্যদের আহত ও নিহত হওয়ার খবর প্রচার করতে থাকে। এ ছাড়াও কলাম লেখকরা ভিয়েতনামের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকার সেনাবাহিনীর খবরদারি এবং যুদ্ধের পক্ষে মার্কিন প্রশাসনের খোঁড়া যুক্তির অসারতা তুলে ধরে। 

ভিয়েতনাম যুদ্ধকে অপরদিকে ‘প্রথম টেলিভিশন যুদ্ধ’ও বলা হয়। এ যুদ্ধের সময় ধারণকৃত দৃশ্যের রিল বা ফিল্ম জাপানের টোকিওতে বিশেষ বিমানে পাঠানো হতো। সেখানে ডেভেলপ ও এডিটিং শেষে আবার বিমানে পাঠানো হতো ওয়াশিংটনের টেলিভিশন কেন্দ্রগুলোয়। অনেক সময় টোকিও থেকেও এসব দৃশ্য সরাসরি পৌঁছে যেত দর্শকদের ঘরে ঘরে। ভিয়েতনামের একদিকে সমুদ্র ও অন্যদিকে থাইল্যান্ড ও চীন থাকায় বস্তুত যুদ্ধ-সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহ শেষে পাশের দেশে প্রবেশ করত এবং সেখান থেকেই পাঠিয়ে দিত নিজস্ব মিডিয়া হাউসে। 

তাই বাস্তবিক অর্থে মিডিয়াকে তথা যুদ্ধ-সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ আমেরিকানদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। মিডিয়ার কারণে মার্কিনিদের আরোপিত যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং মার্কিনিদের সীমাবদ্ধতার পক্ষে জনমত তৈরির এ ধারা পরবর্তী সময়ে ‘ভিয়েতনাম সিনড্রম’ নামে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।

গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরাইলি হামলায় এখন পর্যন্ত নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১৫৮-তে দাঁড়িয়েছে। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস শুরু থেকে বলে আসছে, সংঘটিত অপরাধ যেন প্রকাশ না পায় সেজন্য ইসরাইলিরা সেনারা ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের ওপর ইচ্ছাকৃত হামলা চালাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক এনজিও ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট’ জানিয়েছে, ১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যত সংঘাত হয়েছে তার মধ্যে ‘গাজার যুদ্ধ সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ছিল’। ওই বছর থেকে তারা সাংবাদিকদের হত্যার তথ্য নথিভুক্ত করা শুরু করে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্ট’ গত ফেব্রুয়ারিতে জানায় গত ৩০ বছরে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা দেখা 

গেছে গাজার যুদ্ধে। সংস্থাটি সাংবাদিক হত্যা বন্ধে ইসরাইলকে আহ্বান জানায়। এছাড়া যেসব সাংবাদিক হামলায় নিহত হয়েছেন তাদের মৃত্যুর কারণ তদন্তেরও অনুরোধ জানিয়েছে তারা।

দখলদার ইসরাইলি সেনাদের হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ৪১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। আট মাস ধরে চলা এ যুদ্ধ থামাতে এখন হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি করানোর চেষ্টা করছে মধ্যস্থতাকারী দেশগুলো।

শেষ খবরটি হচ্ছে, গাজা উপত্যকার সাংবাদিক শোরুক আল আইলা ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড (আইপিএফএ) পাচ্ছেন। সাহসী সাংবাদিকতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের প্রতি বছর এই পুরস্কারে সম্মানিত করে।

সাংবাদিক, প্রযোজক এবং গবেষক শোরুক আল আইলা গত বছরের অক্টোবর থেকে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের হামলার খবর প্রকাশ করে আসছেন। চলতি বছরের ২২ আগস্ট ইসরাইলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তার স্বামী সুপরিচিত চলচ্চিত্র নির্মাতা রোশদি সররাজ নিহত হন। সে সময় এই দম্পতির শিশুকন্যাও আহত হয়। এরপর তিনি আইন মিডিয়া নামের একটি স্বাধীন প্রযোজনা সংস্থার দায়িত্ব নিতে বাধ্য হন। কারণ তার স্বামী এটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।   

ইসরাইলি হামলার ফলে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওপর যে প্রভাব পড়ছে তার ওপর ভিত্তি করে তিনি রিপোর্টিং করেন। বিশেষ করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি, ফিলিস্তিনিদের জীবনযাত্রার অবস্থা এবং প্রাণঘাতী আক্রমণ থেকে বাঁচার চেষ্টা নিয়ে তিনি প্রতিবেদন তৈরি করেন। 

আল আইলাকে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার কারণ হলো তার বেঁচে থাকার গল্পটি গাজার সাংবাদিকদের সাহসকে প্রতিফলিত করছে। অকুতোভয় এই সাংবাদিকরা ইসরাইলি বাহিনীর হাতে নির্যাতন, হত্যা এবং গ্রেফতারের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও সংবাদ প্রচারে বিরত হচ্ছেন না। সিপিজের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর হাতে অন্তত ১১৬ জন সাংবাদিক এবং মিডিয়া কর্মী নিহত হয়েছেন। 

উল্লেখ্য, ২১ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই পুরস্কারটি দেওয়া হবে। শোরুক আল আইলা ছাড়াও গুয়াতেমালা, নাইজার এবং রাশিয়ার ৩ জন সাংবাদিক মর্যাদাবান এই পুরস্কারটি পাচ্ছেন।  

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো সত্ত্বেও গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। ১১ মাসের বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধে ৪১ হাজার ৩০০ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৯৫ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগই নারী এবং শিশু। 

 সাংবাদিক 


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close