ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

কারাগারে কেমন আছেন ভিআইপিরা
প্রকাশ: সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১২:৫০ এএম  (ভিজিট : ৮৩২)
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের মধ্যে যারা অতিমাত্রায় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, দেখিয়েছেন দম্ভ তারা এখন পুরোপুরি বেকায়দায়। অপকর্মের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই। অনেকেই পালিয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। তবে এরই মধ্যে অনেক সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাপুটে কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়ে বাসিন্দা হয়েছেন চৌদ্দ সিকের। যারা এত দিন অন্যায়ভাবে জনগণের টাকায় অর্থ-সম্পদ গড়ে বিলাসী জীবন কাটিয়েছেন তাদের কারাজীবন কেমন যাচ্ছে তা নিয়ে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে জনমনে। সাধারণ মানুষের প্রশ্নÑজনগণকে দুর্ভোগে ঠেলে দিয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া ক্ষমতাবানরা কেমন আছেন কারাগারে।

সময়ের আলোর পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন কারাগারে খবর নিয়ে জানা গেছে, সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, এমপি এমনকি গ্রেফতার শীর্ষ কর্মকর্তারা ভালো নেই। যারা একসময় কারাগারকে নিয়ন্ত্রণ করতেন তারাই এখন সেই ফাঁদে পড়েছেন। বন্দিশালায় স্বজনদেরও দেখা মিলছে না ঠিকমতো। বাইরের খাবার ভাগ্যে জুটছে না তাদের। কারাগার থেকে যেসব খাবার দেওয়া হচ্ছে বাধ্য হয়ে সেসব খাবারই খেতে হচ্ছে। কয়েকজন কারা কর্মকর্তার  সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ নির্মম পরিণতির জন্য তারাই দায়ী যারা দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এখন নিজেরাই বন্দি হয়ে পরিবার ছেড়ে নিঃসঙ্গ। কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন ১৫ দিন পর।

এ প্রসঙ্গে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন রোববার সময়ের আলোকে বলেন, কারাগারের পরিবেশে আগের তুলনায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কারাগারগুলোতে আগে তদবির বাণিজ্য হতো। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কথা শুনেছি। বর্তমানে সেখানে কোনো ধরনের অনিয়ম, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, মাদকের ছড়াছড়ি নেই। তিনি বলেন, ভিআইপি যেসব বন্দি ডিভিশন পেয়েছেন তারা জেল কোড অনুযায়ী সুবিধা পাচ্ছেন। বাইরের খাবার আনার নিয়ম না থাকায় ভেতরের খাবারই খাচ্ছেন তারা। আলাদা ভবনে রাখা হয়েছে তাদের। যারা ডিভিশন পাননি তারা সাধারণ বন্দিদের মতো থাকছেন, খাচ্ছেন।

সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন আরও বলেন, প্রত্যেক কারাগারে দায়িত্বরতদের সাবধান করা আছে, কোনো অনিয়মন করলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারাগারের ভেতরে স্বজনপ্রীতির কোনো সুযোগ নেই। কারাগার এখন পুরোপুরি সংশোধনাগার। কোনো প্রভাব-তদবির এবং অনিয়ম চলবে না।
গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও দেশ ত্যাগের পর হামলা ও গ্রেফতার এড়াতে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিসহ শীর্ষ নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দিয়েছিলেন। এরপর তাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা হত্যা, হত্যাচেষ্টা এবং বিস্ফোরক মামলাসহ বিভিন্ন মামলা হয়। ১৪ আগস্ট প্রথমে আওয়ামী সরকারের আমলে তিনবারের প্রভাবশালী আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে গ্রেফতার করেন র‌্যাব সদস্যরা। এরপর থেকেই এক ধরনের ভীতির সঞ্চার হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে। কেউ আত্মগোপনে যান স্বজনদের বাসায়, কেউ জঙ্গলে। আবার কেউ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পর্যায়ক্রমে প্রায় অর্ধশত মন্ত্রী-এমপিসহ আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও সাবেক আইজিপিসহ কয়েকজন বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার হওয়া প্রভাবশালী এই ভিআইপিরা দেশের বিভিন্ন কারাগারে রয়েছেন।

ঢাকা বিভাগীয় কারা উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) প্রিজনস মো. জাহাঙ্গীর কবির সময়ের আলোকে বলেন, বর্তমানে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারেই আছেন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যসহ ৩৬ জন ভিআইপি। তাদের মধ্যে ৯ জন জেল কোড অনুযায়ী ডিভিশন সুবিধা পেয়েছেন। কারাগারে ডিভিশন মানে আলাদা একটি নির্ধারিত ভবনে থাকার সুযোগ পাওয়া। সাধারণ বন্দিদের তুলনায় ডিভিশন পাওয়া বন্দিদের খাবারের তালিকায় দুয়েকটি ভালো মানের আইটেম থাকে। তবে বেশিরভাগ খাবারই সাধারণ বন্দিদের মতো। তিনি বলেন, কাশিমপুর-২ কারাগারে আছেন ৬ ভিআইপি।

চট্টগ্রাম বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক টিপু সুলতান সময়ের আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলার কারাগারের অবস্থা এখন পুরোপুরি স্বচ্ছ। ভেতরে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা নেই। খাবার থেকে শুরু করে সবকিছুই এখন নিয়মের মধ্যে চলছে। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর সাবেক সরকারের অনেক প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও নেতাকর্মী চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন কারাগারে আছেন। অনেকে ডিভিশন পেয়েছেন। আমি সরকারি কাজে ঢাকায় আসায় এ মুহূর্তে সংখ্যাটা সঠিক বলতে পারছি না। তবে সার্বিকভাবে কারাগারের পরিবেশ ভালো।

রংপুর বিভাগীয় কারা সূত্র জানায়, সাবেক পানি সম্পদমন্ত্রী ও ঠাকুরগাঁও-১ (সদর উপজেলা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনকে ঠাকুরগাঁও কারাগারে রাখা হয়েছে। তিনি ডিভিশন পেয়েছেন। ওই বিভাগে আর কোনো ভিআইপি বন্দি নেই।

কারা সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে বাংলাদেশের শীর্ষ ধনী সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের ব্যাপক প্রভাব থাকলেও তারা ডিভিশন পেয়েছেন। আগে প্রভাবশালী মহলের অনুরোধ-তদবির থাকলেও বর্তমানে কেউ তাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন না। এমনকি আত্মীয়-স্বজনরাও তেমন দেখা করার সুযোগ পান না। কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী ১৫ দিন পরপর স্বজনদের দেখা মেলে। বাইরের খাবার নেওয়ার নিয়ম না থাকায় কারাগারের খাবারই জুটছে তাদের ভাগ্যে।

ওই সূত্র আরও জানায়, আগে যারা দেশ পরিচালনায় ব্যাপক ক্ষমতাধর ছিলেন তারা এখন নিশ্চুপ। নিজেরাই নিজেদের ভুলের কথা বলছেন। কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি বলছেন, হারিয়ে গেছে হাজার কোটির সুখ। এখন এ ছোট্ট রুমেই তাদের জীবনযাপন। হেরেমের মতো বাড়ি বা বিলাসবহুল পাঁচ তারকা হোটেলের মতো নরম বিছানা নেই। একাকী জীবনে এখন নামাজ পড়তে শুরু করেছেন অনেকেই।

কারা সূত্র জানায়, তিনবেলা নিয়মমাফিক খাবার দেওয়া হচ্ছে। ডিভিশন যারা পেয়েছেন তারাও নিয়মিত নামাজ পড়া শুরু করেছেন। তবে বাড়তি কোনো খাবার খাওয়া বা কারাগারের ভেতরের মাঠেও ঘোরাফেরা করার সুযোগ নেই। যে ভবনটি তাদের জন্য নির্ধারিত সেখানেই তারা ঘোরাফেরা করছেন। একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছেন। নিজেদের ভুলের প্রায়শ্চিত্তের গল্প বলছেন একে অন্যের কাছে।
এখন পর্যন্ত যারা গ্রেফতার হয়েছেন : শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিএনপির অনেক নেতাকর্মী জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। আর কারাগারের সেই ফাঁকা জায়গা পূরণ করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দাপুটে মন্ত্রী-এমপি এবং চাকরি হারানো সুবিধাভোগী সরকারি কর্মকর্তারা।

সাবেক এই মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের তালিকায় রয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং শেখ হাসিনার জ্বালানি, খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এবং জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি শাহরিয়ার কবির, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সৈকত ও ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, অন্যতম আলোচিত সেনা কর্মকর্তা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন, মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল। এ ছাড়া সাবেক দুই আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন এবং একেএম শহীদুল হকসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন।


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close