ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

সহিংসতা-খুন থামছেই না
প্রকাশ: রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৩:০৫ এএম  (ভিজিট : ২৬২)
অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যেই পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে দুই তরুণকে। তাদের মধ্যে নিহত শামীম ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। গত বুধবার বিকাল থেকে মধ্যরাতের মধ্যে এ দুই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে তোফাজ্জল মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ার পরেও এক দফা মেরে ভাত খাইয়ে আবার কয়েক দফা মেরে হত্যার বিষয়টি নাড়া দিয়েছে জনমানসকে। দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনায় দেশবাসী ক্ষুব্ধ।

এর আগে ৭ সেপ্টেম্বর রাতে চার দিন বয়সের শিশুসন্তানের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে পিটুনিতে মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদ। ২০১৪ সাল থেকে পঙ্গু অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছিলেন তিনি। এ ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এ রকম হত্যা ও সহিংসতার ঘটনা এখন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর নতুন নামও দেওয়া হয়েছে, ‘মব জাস্টিস’ বা জনতার তাণ্ডব। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার বার্তা বারবার দেওয়া হলেও লাভ হচ্ছে না। উপরন্তু সহিংসতা-খুন বাড়ছেই। শুধু সমতলে নয়, সহিংসতা বেড়েছে পাহাড়েও। গত কয়েক দিনে দফায় দফায় বাঙালি ও পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে ৪ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারা দেশে চার শতাধিক থানায় হামলা হয়। এসব থানায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাট হয়। এদিকে লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদের একটা বড় অংশ এখনও উদ্ধার হয়নি। যেগুলো রয়েছে সাধারণ মানুষ ও সন্ত্রাসীদের হাতে। থানায় হামলার পর ভেঙে পড়ে থানার সার্বিক কার্যক্রম, সঙ্গে পুলিশের মনোবল। এর পর থেকেই আইনশৃঙ্খলার অবনতি শুরু হয়। এখন থানায় কার্যক্রম চললেও পর্যাপ্ত টহল গাড়ি না থাকায় ঘুরে ঘুরে এলাকার আইনশৃঙ্খলা সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে বিট পুলিশিং কার্যক্রম দৃশ্যমান না থাকায় এলাকাভিত্তিক অপরাধের মাত্রাও বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, চাঁদাবাজি এবং ছিনতাইয়ের কারণে বেশি আহত ও নিহতের ঘটনা ঘটছে। এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

আরও কয়েকটি হত্যার ঘটনা : গত শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান এলাকায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে নাসির বিশ্বাস (২২) ও মুন্না (২৩) নামে দুই তরুণ নিহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে, দুই তরুণকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটে মোহাম্মদপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান এলাকার পাশে। এ ঘটনার বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ওসি ইফতেখার হাসান শনিবার সন্ধ্যায় সময়ের আলোকে বলেন, আমরা সেনাবাহিনী ও ১০০ পুলিশ সদস্য নিয়ে আসামি গ্রেফতারে অভিযান চালাচ্ছি। আশা করছি দ্রুত আসামি গ্রেফতার হবে। যে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে সেই গ্রুপ দুটির নাম জানাতে পারেননি ওসি ইফতেখার। তিনি বলেন, নিহত মুন্নার বিরুদ্ধে রাজশাহী ও ঢাকা মিলিয়ে মোট আটটি মাদক, অপহরণসহ অন্যান্য মামলা রয়েছে। নিহত নাসিরের বিরুদ্ধে ঢাকা ও মাদারীপুরে দুটি মাদকের মামলা রয়েছে। এ ঘটনায় বাদী পক্ষ মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আশা করছি রাতে মামলা হয়ে যাবে। এদিকে শুক্রবার রাজধানীর খিলগাঁও তালতলার ঝিলপাড় এলাকায় নুরু ইসলাম (৫০) নামে এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। একই দিনে রাজধানীর সূত্রাপুরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে জিন্নাহ (৫২) নামে এক অটোরিকশাচালক নিহত হয়েছেন। গত সোমবার রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় স্বামীর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন স্ত্রী বিথী আক্তার (২২)। ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মুগদা-মান্ডা কাজীবাড়ি মসজিদ এলাকায় মারামারির সময় ছুরিকাঘাতে আশিক এলাহী শাকিল (২৮) নামে এক ব্যবসায়ী নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন ওই ব্যবসায়ীর আপন দুই ভাই আশিক পারভেজ সুজন (৩৮) ও আশিক শামস (২৪)। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপরেও হামলা হচ্ছে। ১৩ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী জনপথ মোড়ে শরাফ আলী (৪৭) নামে এক পুলিশ সদস্যের পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়। ওই পুলিশ সদস্য পিঠে ঢুকে থাকা ছুরি নিয়েই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। এ ছাড়া চলতি মাসে রাজধানীতে আরও কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে সেপ্টেম্বরের চেয়ে বেশি ঘটেছে আগস্ট মাসে।

সাম্প্রতিককালে ঢাকার বাইরে কিছু হত্যাকাণ্ড : রাজধানীর বাইরেও থামছে না সহিংসতা ও খুন। রাজবাড়ী জেলার কালুখালীতে শনিবার ভোরে চোর সন্দেহে এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত নাজমুল হোসেন মোল্লা (৩২) ফরিদপুরের মধুখালীর গাড়াখোলা গ্রামের আহম্মেদ মোল্লার ছেলে। একই দিনে দুপুরের দিকে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ফতেপুর পশ্চিম ইউনিয়নে ছেলের ইটের আঘাতে খুন হয়েছেন মা। নিহত রোকেয়া বেগম (৬০) দিঘলীপাড় গ্রামের মৃত কালু মিয়া প্রধানের স্ত্রী। গত শুক্রবার রাতে টাঙ্গাইলে বেসরকারি সংস্থা সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট থ্রো ইউনিটির (সেতু) প্রধান কার্যালয় থেকে হিসাবরক্ষকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পরিবারের দাবি, চার দিন ধরে আটকে রেখে নির্যাতন করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। একই দিনে চট্টগ্রামে পুরাতন চান্দগাঁও এলাকায় স্থানীয় কাউন্সিলর কার্যালয়ের সামনে খেলার টার্ফ (মাঠ) দখল নিয়ে নগর যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসাইন ও একই কমিটির কৃষি সম্পাদক নুরুল আমিনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। সংঘর্ষের সময় ছুরিকাঘাতে জুবায়ের উদ্দীন বাবু (২৫) নামে এক যুবদল কর্মী নিহত হন। গত বৃহস্পতিবার রাতে যশোরের অভয়নগর উপজেলার মশরহাটি গ্রামে দুর্বৃত্তদের হামলায় একজন নিহত ও দুজন আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে স্থানীয়রা তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মতিয়ার বিশ্বাসকে (৪৫) মৃত ঘোষণা করেন। আহত আবদুল হালিম (৩৪) ও মনিরুল ইসলামকে (৩৮) খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ভোরে নাটোরের গুরুদাসপুরে ডাকাতদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হারেজ আলী (৮০) নামে এক বৃদ্ধ খুন হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন তার স্ত্রী হোলেদা বেগম (৭০)। চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে চট্টগ্রাম নগরের ধুপপোল মিস্ত্রিপাড়া এলাকায় মুসলিম উদ্দিন (৪৮) নামে এক ব্যবসায়ীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ১৪ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে বন্ধুর হাতে খুন হন রাসেল হোসেন (২৬) নামে এক তরুণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে এ রকম হত্যার সংখ্যা আরও বেশি, যেগুলো অনেক সময় গণমাধ্যমে খবর হয় না।

যা বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী : সহিংসতা-খুন নিরসনে পুলিশের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া শাখার এআইজি ইনামুল হক সাগরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের সঙ্গে। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, ‘ঘটনাগুলোতে কারা জড়িত তা তদন্ত করে বের করার চেষ্টা করছি। আমাদের নিয়মিত পুলিশিং চলছে।’ বিট পুলিশ অপরাধ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে বিট পুলিশিং ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। বিট পুলিশিংয়ের কার্যক্রমের উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা তো জানেন আমরা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আমাদের স্থাপনায় কীভাবে হামলা হয়েছে। আমরা সব ক্ষত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আমরা জনগণের কাছে প্রত্যাশা করব, কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেন। কোনো অপ্রীতিকর কিছু দেখলে মানুষ যেন পুলিশকে সেটি অবহিত করে। তা হলে আমরা আমাদের কার্যক্রম আরও জোরদার করতে পারব।’

অপরাধ বিশেষজ্ঞ যা বলছেন : সার্বিক বিষয় জানার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক সময়ের আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে আরও কিছু সময় লাগবে। যৌথবাহিনীর অভিযান চলছে। এতে আইনশৃঙ্খলা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি বলেন, বড় রাজনৈতিক দলের সক্ষমতা তৃণমূল পর্যন্ত। নেতারা যদি নিজ নিজ এলাকায় শিষ্টাচার মানানোর জন্য কঠোর হন, তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘাটতিটুকু পূরণ হয়ে যায়। আবার নেতারা বললেও কর্মীরা সবাই যে মেনে চলছেন তাও না। কিছু ঘটনা তো ঘটছে। পূর্ণমাত্রায় স্বাভাবিক হতে এখনও সময় লাগবে। সবাই যদি সহযোগিতামূলক ভূমিকা পালন করেন তবে এ সময় কমে আসবে।


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close