ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

ডেঙ্গুতে মৃত্যু-আক্রান্ত বাড়লেও টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের
প্রকাশ: রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:২৯ এএম  (ভিজিট : ২৬৪)
উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে অন্যান্য জেলায়ও। আর শুধু এ মাসে ২১ দিনেই মারা গেছে ৪২ জন। যা চলতি বছরে কোনো এক মাসে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু। আর আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজার ২৬৭ জন। অথচ এর আগের মাস আগস্টে মোট মোট মৃত্যু হয়েছিল ২৭ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছিল ৬ হাজার ৫২১ জন। সেই হিসেবে এ মাস যেতে না যেতেই আগের মাসের চেয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। 

গতকাল শনিবার নতুন করে একজনের মৃত্যু এবং আক্রান্ত হয়েছে ৮৪৩ জন। সব মিলিয়ে চলতি বছরে মোট আক্রান্ত হয়েছে ২৩ হাজার ১০৮ জন। এর মধ্যে ঢাকায় আক্রান্তের হার হচ্ছে হচ্ছে ৪৪ শতাংশ এবং ঢাকার বাইরের ৬৫ শতাংশ। আর এ বছর মোট মৃত্যু হয়েছে ১২৫ জনের। এর মধ্যে ৬৯ শতাংশ মৃত্যুই ঘটেছে ঢাকার দুই সিটিতে। এ ছাড়াও রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে ডেঙ্গু রোগীর ভিড়। চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা। আর রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে বিশেষায়িত বেড চালু করা হয়েছে। প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। একইভাবে চাপ বেড়েছে রাজধানীর অন্য হাসপাতালগুলোতে।
উদ্বেগজনক ডেঙ্গু পরিস্থিতিতেও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন নগরবাসী। তাদের অভিযোগ, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অনেক স্থাপনাতেই মিলছে এডিসের লার্ভা। 

সরকারের পটপরিবর্তনের পর থেকেই মশা নিধন কর্মসূচিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে। নিয়মিতভাবে কাজ করছেন না মশক নিধন কর্মীরা। অভিযান পরিচালনা কার্যক্রম থেমে গেছে। এ ছাড়াও, লার্ভিসাইড স্প্রে এবং ফগিংসহ সিটি করপোরেশনের নিয়মিত মশাবিরোধী ব্যবস্থাগুলোও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় অনেকের বাসাবাড়ি কিংবা স্থাপনায় জন্মাচ্ছে মারাত্মক ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা। যদিও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, জনপ্রতিনিধিদের অবর্তমানে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে মশক নিধন কার্যক্রম শুরু করেছেন এবং তদারকির দায়িত্ব পালন করছেন।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তবে, অক্টোবরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। কারণ এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে সে বিষয়ে আরও দুই মাস আগে থেকেই সতর্ক করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্তের রেকর্ড। 

আর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন, যার মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৩৯ জন, যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। মার্চ মাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩১১ জন, পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এপ্রিলে আক্রান্ত হয়েছে ৫০৪ জন, মৃত্যু হয়েছে দুইজনের। মে মাসে আক্রান্ত হয়েছে ৬৪৪ জন, মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। জুন মাসে ৭৯৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের, জুলাই মাসে ২৬৬৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। এ ছাড়া আগস্ট মাসে মৃত্যু হয়েছিল ২৭ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছিল ৬ হাজার ৫২১ জন।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত মোট মৃত্যু হয়েছে ১২৫ জনের। এর মধ্যে মধ্যে ৮৭ জনই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। এর মধ্যে ৬৯ দশমিক ৬ শতাংশই মৃত্যুই ঘটেছে ঢাকায়। তবে সবচেয়ে বেশি ৭২ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে। দুই সিটিতে এবার মোট আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজার ১৮৩ জন। আর আক্রান্তের হার হচ্ছে ৪৪ শতাংশ। এর বাইরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে বিভাগে ১৭ জন এবং বরিশাল বিভাগে ১১ জন। তবে বেশি আক্রান্ত হয়েছে চট্টগ্রামে বিভাগে ৫ হাজার ৪২ জন।

শনিবার স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন ২ হাজার ৭০৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি ১ হাজার ৫৪২ জন এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ১৬৪ জন। এ ছাড়া চলতি বছরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট চিকিৎসা নিয়েছে ১ হাজার ১৭২ জন। আর বর্তমানে মোট ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে ১৪৮ জন। এর পরেই মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবেচয়ে বেশি রোগী ১ হাজার ৯৫১ জন ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের। আর বর্তমানে রোগী ভর্তি রয়েছে ১০০ জন। আর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে এখন পর্যন্ত দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ২৪ জন। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় শিশু হাসপাতালে ১৬টি বিশেষায়িত বেড চালু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক ডা. এসএম খালিদ মাহমুদ শাকিল। তিনি বলেন, গত কয়েক দিন ধরে রোগী কিছুটা বাড়ছে, সেই বিষয়টির কথা চিন্তা করে আমরা ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষায়িত বেড চালু করেছি। প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হতে পারে।

এদিকে রাজধানীর বংশালের বাসিন্দা ইছাহাক হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, দিনে-রাতে মশার উৎপাতও কয়েকগুণ বেড়েছে। অনেক স্থাপনাতেই মিলছে এডিসের লার্ভা। রাস্তাঘাটে ময়লার স্তূপ হয়ে পড়ে আছে কিন্তু পরিষ্কার করা হয় না। গত কিছু দিন ধরে কোনো মশার ওষুধ ছিটানো হচ্ছে না। মশার লার্ভা নিধনে কোনো কার্যক্রম হচ্ছে না। এমনকি সিটি করপোরেশন সচেতনতামূলক কোনো কাজও করছে না। মাঝেমধ্যে দায়সারা আর লোকদেখানো কিছু কাজ করা হয় বলেও জানান তিনি। 

শনিবার সকালে মিরপুরে মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. মাহমুদুল হাসান। পরিদর্শনের পর উপস্থিত মশককর্মী ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের উদ্দেশে ডিএনসিসি প্রশাসক বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি এডিসের লার্ভা জন্মাতে পারে এমন উৎসগুলো পরিচ্ছন্ন করার মাধ্যমে ধ্বংস করতে হবে। স্বাস্থ বিভাগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও প্রকৌশল বিভাগ সম্মিলিতভাবে কাজ করলে ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।

নগরবাসীর উদ্দেশে প্রশাসক মাহমুদুল হাসান বলেন, আমাদের কর্মীরা বাসাবাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করে এবং ওষুধ ছিটায়। কিন্তু বাসাবাড়ির ভেতরে আমাদের কর্মীদের পক্ষে কাজ করা সম্ভব হয় না। তাই নিজেদের বাসাবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত তদারকি টিম প্রতিটি অঞ্চলে পরিচালিত কার্যক্রম সঠিকভাবে তদারকি করছে বলেও জানান তিনি।

ডেঙ্গুর প্রকোপ কেন বাড়ছে এ বিষয়ে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. হাসিবুল ইসলাম সময়ের আলোকে বলেন, সাধারণত আগস্ট থেকে অক্টোবর ডেঙ্গুর ‘পিক সিজন’ হয়ে থাকে। আমরা পরিষ্কার-পরিছন্নতায় অবহেলা করছি। বিশেষ করে কোটা আন্দোলেনের পর থেকে সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করছে না এবং ঠিকভাবে কাজ করছে না। ফলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুও বাড়ছে। তাই ডেঙ্গু মোকাবিলায় সচেতনা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে ফ্রিজ, এসি, ফুলের টব, অব্যবহৃত টায়ার, ডাবের খোসা, চিপসের খোলা, প্যাকেট, বিভিন্ন ধরনের খোলা পাত্র, ছাদ কিংবা অন্য কোথাও যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে সতর্কদৃষ্টি রাখতে হবে।

তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে প্রথমে অনেকেই বুঝতে পারেন না। এটাই মূল সমস্যা। বেশিরভাগ রোগী ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহ রূপ শক সিনড্রোম অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তাদের ব্লাড প্রেশার কমে যাচ্ছে। অনেক রোগীর জ্বরসহ পেটে তীব্র ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, প্রচণ্ড দুর্বলতা, বমি অথবা মাড়ি ও নাক থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়। তাই জ্বর হলে অবহেলা করা যাবে না। তবে ডেঙ্গু হলে কোনো ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন নেই। অবস্থা খারাপ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার সময়ের আলোকে বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই ডেঙ্গু বাড়বে। এখন পুরো ঢাকায় মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার না করলে অক্টোবরে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। কারণ এখন শুধু বর্ষা নয়, শীত-গ্রীষ্মেও এই ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। এর কারণ হচ্ছে আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়ণ, লোকবলের ঘাটতি ও জনসচেতনতার অভাবে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। ইতিমধ্যে মাঠ পর্যায়ে এডিস মশার ঘনত্ব আমরা লক্ষ করছি। কয়েকটি জেলায় কাজ করে আমরা এডিস ঘনত্ব গতবারের তুলনায় বেশি পেয়েছি। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশালসহ ঢাকার আশ-পাশের এলাকায়।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা আমার সবাই জানি। কিন্তু প্রতিবারই আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি। প্রতিবারই বলছি আমরা কাজ করছি, এটা করছি, সেটা করছি। কিন্তু নাগরিকরা ফলাফল পাচ্ছে না। সেসবের সুফল কেন আসছে না, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে সার্ভিলেন্স কার্যক্রমসহ বিজ্ঞান ভিত্তিকভাবে কাজ করতে হবে এবং মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে।




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close