ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

মেট্রোপলিটন শহর ও গণপরিবহন ব্যবস্থা
প্রকাশ: শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:৩৩ এএম আপডেট: ২১.০৯.২০২৪ ৮:০৫ এএম  (ভিজিট : ২২৭)
ঢাকা একটি মেট্রোপলিটন শহর হলেও যাতায়াত ব্যবস্থা তথা পরিবহন ব্যবস্থা যে সঙ্গিন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যার ফলে যানজটের কবলে পড়ে প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হচ্ছে। তথ্যটি বিশ্বব্যাংকের। একটি শহরের পরিবহন ব্যবস্থাকে অবশ্যই হতে হয় গণমুখী। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে ব্রিজ, রেললাইন সবই গণমানুষের জীবনকে সহজ করার নিমিত্তে প্রস্তুত করতে হবে। নগরের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে বাস ও ট্রেন সার্ভিস সবকিছুর মূলে থাকে গণমানুষের চাহিদার বিষয়টি। আর তাই যে কোনো নগরের জন্য গণপরিবহন ব্যবস্থা পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সবার আগে যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হয় তা হলো শহরের মোট যাতায়াতকারী মানুষের পরিমাণ বা কমিউটার ভলিউম।

জাইকার তথ্য মোতাবেক ঢাকায় দিনে তিন কোটি নব্বই লাখ ভ্রমণ বা ট্রিপ তৈরি হয় যার ৭৬ শতাংশই হলো শর্ট ট্রিপ বা ছোট সময়ের ভ্রমণ, যার দৈর্ঘ্য মাত্র তিন কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যেমন ধরুন যাদের কর্মক্ষেত্র আর বাড়ি কাছাকাছি, অথবা বাচ্চাদের স্কুল, বাজার ইত্যাদি স্বল্প দূরত্বে তারা রিকশা বা হেঁটেই গন্তব্যে যাচ্ছেন। ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের এ শহরের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া মানুষ যারা জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন রাজপথে বের হন। তাদের একটা বড় অংশের যাতায়াত বাহন হলো বাস, সাইকেল অথবা নিতান্তই তারা হেঁটে চলেন। তাই এ শহরের পরিবহন পরিকল্পনায় পদচারী, বাসযাত্রীদের বিষয়টি প্রাধান্য পাবে এমন আশা করাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঢাকার দিকে তাকালে এর সম্পূর্ণ বিপরীত একটা চিত্র আমরা দেখতে পাই। আমাদের পরিবহন ব্যবস্থায় গণমানুষ উপেক্ষিতই বলা চলে। ঢাকার মোট যাতায়াতকারী মানুষ বা কমিউটার ভলিউমের ৪৪ শতাংশের পরিবহন মাধ্যম হলো বাস। ৪৮ শতাংশ মানুষ হেঁটে বা সাইকেলে যাতায়াত করে, ৩৫ শতাংশ মানুষের বাহন হলো রিকশা আর মাত্র ৮ শতাংশ মানুষের যাতায়াতের মাধ্যম হলো যান্ত্রিক বাহন। এ যান্ত্রিক বাহনের মধ্যে গাড়ি ছাড়াও আছে মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা। সুতরাং এ কথা সহজেই অনুমেয় যে, ঢাকার জন্য যে কোনো গণপরিবহন পরিকল্পনাতেই পদচারী ও বাসযাত্রীদের স্থান হতে হবে সবার আগে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এমনকি এশিয়ার অনেক দেশেও পরিবহন ব্যবস্থায় সবার আগে স্থান পায় পদচারীরা, এরপরেই আসে বাস, মেট্রো ইত্যাদি গণপরিবহন যা অনেক কম সময়ে অনেক বেশি যাত্রী শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পৌঁছে দিতে সক্ষম। সাধারণের জন্য যাতায়াতের সবচেয়ে সাশ্রয়ী বাহন হলো বাস। মেট্রোরেল অনেক মানুষকে একবারে পারাপার করতে পারলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। মেট্রো সব শ্রেণির মানুষের জন্য সহজলভ্য বাহন নয়, অন্তত আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য এটা ব্যয়সাপেক্ষ। বিশ্বব্যাপী এটি উচ্চ ভর্তুকিসম্পন্ন পরিবহন ব্যবস্থা। আর সব জায়গায় মেট্রো তৈরিও সম্ভব নয়। আমাদের মেট্রোরেলের ভাড়াও যদি আমরা পর্যালোচনা করি তবে তা কোনোভাবেই একজন স্বল্প আয়ের মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে বাস হতে পারে সব শ্রেণির মানুষের জন্য একটি সুলভ বাহন যা মেট্রো ও অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি সমভাবে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হবে। 

শুক্র শনি দুদিন ছুটির পর সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসটি কেমন হয় ঢাকাবাসীর? বাড়ি থেকে বেরিয়ে কর্মক্ষেত্রের যাত্রাটা যে এ নগরের বাসিন্দাদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যের নয়, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ নির্বিঘ্নে রাজপথ ধরে কাজে যাবে, শিশুরা শিক্ষাকেন্দ্রে যাবে, তরুণরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবার বাড়ি ফিরে আসবে নিরাপদে এবং নির্দিষ্ট সময়ে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের ঢাকাবাসীর জীবনে কি সেই প্রশান্তি, সেই স্বস্তি আছে? আমাদের দিন শুরু হয় এক আতঙ্কের মধ্য দিয়ে- ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারব তো? কাজ শেষে বিকাল বা সন্ধ্যায় একই চিন্তা- কখন বাড়িতে ফিরব? হাজিরা খাতার লালদাগ এড়াতে এ শহরের মানুষ দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আগে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশে বের হন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেই কর্মক্ষেত্রের দূরত্ব বড়জোর ৮ থেকে বারো কিলোমিটার। ট্রাফিক সিগন্যালসহ এমন দূরত্ব পার হতে বড়জোর আধঘণ্টা লাগার কথা। কিন্তু দেখা যায় কম করে হলেও দেড় ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। কারণ দেখা যাচ্ছে বর্তমানে ঘণ্টায় গাড়ির গড় গতি ৭ কিলোমিটারে এসে পৌঁছেছে (বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে)। আর মুষলধারে বৃষ্টি বা কোনো গণজমায়েত হলে তো কথাই নেই। সেদিনগুলোতে নগরবাসীর ভোগান্তির আর কোনো সীমা থাকে না যেন।

আমাদের প্রয়োজন একটি বহু প্রকারের বা মাল্টি মোডাল পরিবহন ব্যবস্থা যেখানে মেট্রো, বাস, যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক বাহন, পদচারী চলাচল এবং জলপথে যোগাযোগের একটি সমন্বিত ব্যবস্থা থাকবে। এই পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের এই মধ্যবর্তী সময়টায় অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়সাপেক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। সে জন্যই বিশেষজ্ঞরা সবসময় ঢাকার বাস সার্ভিস, পেডিস্ট্রিয়ান ওয়াকওয়ে বা পদচারীর চলাচলের পথ এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছেন। 

ঢাকার মোট আয়তনের ১২ শতাংশ হলো রাস্তা। এর চাইতে কম আয়তনের রাস্তার শহর হলো কলকাতা ও লন্ডন। এ দুটি শহরেই রাস্তার পরিমাণ ১০ শতাংশ। অথচ বিশে^র অন্যতম সফল পরিবহন ব্যবস্থা আছে এই দুই শহরে। কলকাতা ও লন্ডনের মেট্রোরেল সার্ভিস হলো অন্যতম সফল দুটি গণপরিবহন ব্যবস্থা যা পুরো বিশে^ রোল মডেল। মেট্রোর পাশাপাশি উভয় শহরেই রয়েছে উন্নত বাস সার্ভিস এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। সুতরাং একটি শহরের পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে মোট আয়তনে ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকতে হবে- এমন কথা আসলে একটা মিথ এবং কলকাতা প্রকৃষ্ট উদাহরণ এক্ষেত্রে।  অতএব আমাদের এই ১২ শতাংশ রাস্তা নিয়েই কাজ করতে হবে।

আজকাল ঢাকা শহরে গাড়ি বেড়ে গেছে অত্যধিক। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন, ব্যাংক কর্তৃক গাড়ি ক্রয়ের জন্য লোনের ব্যবস্থা, অনিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা ইত্যাদি কারণে নগরবাসী গাড়ির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। আমাদের নগর কর্তৃপক্ষ এক্ষেত্রে গাড়িকেই অধিক প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছেন আর বাস পরিবহন, অযান্ত্রিক বাহন ও পদচারীর নির্বিঘ্নে চলাচলের বিষয়টি অবহেলিতই থেকে যাচ্ছে এবং এ অবহেলার ফল ভোগ করতে হচ্ছে পুরো নগরবাসীকে। 

জাইকার তথ্যমতে, আমাদের পাঁচটি মেট্রো মিলিতভাবে মোট কমিউটারের ৮ শতাংশ যাত্রী বহন করবে। তাহলে বাকি ৯২ শতাংশকে অবশ্যই কোনো না কোনো পরিবহন ব্যবস্থার শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের বাস সার্ভিসের অবস্থা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি মেট্রোপলিটন নগরীর বাস সার্ভিস এত নিম্নমানের থাকতে পারে না। প্রায় প্রতিটি বাসই এখন পুরোনো ও অকার্যকর অবস্থায় রাস্তায় চলাচল করছে। এসব বাস বাতিল করে নতুন বাস এনে আমাদের ১২ শতাংশ রাস্তার মাঝেই পরিবহন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যে করেই হোক আমাদের ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে ফেলতে হবে। কারণ এতে করে বায়ুমণ্ডলে যেমন দূষণ বৃদ্ধি পায়, তেমনি অর্থনৈতিক দিক থেকেও অনেকেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ফ্লাইওভার জাতীয় স্থাপনাসমূহ রাস্তায় গাড়ির চলাচলকে আরও উৎসাহ প্রধান করে। এ ছাড়া অবৈধ পার্কিং ও আমাদের রাস্তার কর্মক্ষমতা হ্রাস করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাস্তার অর্ধেকই পার্কিংয়ের কারণে বন্ধ হয়ে থাকে। এসব কারণে আজকাল যানজটের পরিমাণও বেড়ে গেছে। পরিবহন পরিকল্পনায় সবার আগে স্থান দেওয়া হয় পদচারী চলাচলকে, এরপর আসে অযান্ত্রিক বাহন, এরপর আছে গণপরিবহন ও বাস এবং সর্বশেষে আসে ব্যক্তিগত যান্ত্রিক বাহন তথা গাড়ি, মোটরবাইক ইত্যদি। দুঃখজনক হলেও সত্য, ঢাকার ক্ষেত্রে একেবারে উলটো চিত্র আমরা দেখতে পাই। এখানে সবার আগে গাড়িকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমাদের নীতি নির্ধারকদের এ কথাটা মনে রেখে কাজ করতে হবে যে, গণমানুষের পরিবহনই মুখ্য বিষয়। একমাত্র একটি স্মার্ট বাস সার্ভিস ও সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থাই বাঁচিয়ে দিতে পারে লাখ লাখ কর্মঘণ্টা ও মানুষের ভোগান্তি। 

একটি নগরে তার নাগরিকরা শুধুই কর্মক্ষেত্রে যাবে আর বাড়ি ফিরবে এমনটা হয় না। তার সামাজিকতা ও বিনোদনেরও প্রয়োজন আছে। অথচ আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা বর্তমানে এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে আমরা প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতেই আতঙ্কিত বোধ করি। আরএসটিপি একটি পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা বলা যেতে পারে। এ ছাড়া এর বাইরেও সরকার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সবার ওপর একটাই সমাধান আছে- গণপরিবহন ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধন। সেজন্য চাই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, পরিকল্পনা, জনগণের সচেতনতা এবং সর্বোপরি প্রশাসনের সদিচ্ছা।  


স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদ


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close