ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

সহিংসতায় উত্তাল পাহাড়
প্রকাশ: শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১২:২৬ এএম  (ভিজিট : ৩৫২)
সহিংসতার আগুনে ফের অশান্ত পার্বত্য এলাকা। খাগড়াছড়িতে ‘গণপিটুনিতে’ নিহত এক বাঙালির মৃত্যুর ঘটনার রেশ শেষ পর্যন্ত ছড়িয়েছে পার্বত্য তিন জেলাতেই। দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে। সহিংসতা, সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগে উত্তাল হয়ে ওঠে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি। সমানভাবে উদ্বেগ উত্তেজনা ছড়ায় বান্দরবানেও।

এসব ঘটনায় শুক্রবার রাত পর্যন্ত প্রাণ যায় ৪ পাহাড়ির। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে বৃহস্পতিবার রাতে গোলাগুলিতে তিনজনের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন-জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)। অপরদিকে রাঙামাটিতে শুক্রবার বনরূপা বাজারে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে মারা যান আরও এক পাহাড়ি যুবক। এ ছাড়া দুই জেলায় আহত হয়েছে প্রায় শতাধিক। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ব্যাংক, অফিস, মসজিদ, দোকানপাট ও বাসাবাড়ি। খাগড়াছড়ি শহরের নোয়াপাড়ায় বুধবার ভোরে চোর সন্দেহে এক বাঙালি যুবককে ‘গণপিটুনিতে’ মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। বৃহস্পতিবার ৫টার দিকে এ হত্যার প্রতিবাদে দীঘিনালায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন বাঙালিরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ৫টার দিকে ৩০০ থেকে ৪০০ বাঙালি জামতলি ও বোয়ালখালী বাজারের দিক থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তারা লারমা স্কয়ারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় পাহাড়িরা বাধা দিলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এতে অন্তত তিনজন আহত হয়েছেন। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে লারমা স্কয়ার ও দীঘিনালা কলেজের পাশের প্রায় ৩৭টি ঘরবাড়ি ও দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পরে রাতে ‘গোলাগুলিতে’ তিন পাহাড়ি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

শুক্রবারও সেখানে থমথমে পরিস্থিতি রয়েছে। এরই মধ্যে দীঘিনালায় আগুন ও সহিংসতার প্রতিবাদে পাহাড়িদের পক্ষ থেকে শুক্রবার মিছিল বের করলে আবারও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

পুলিশ, হাসপাতাল সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, খাগড়াছড়ির দীঘিনালার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, লুটপাট ও বাড়িঘর-দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার সকালে পাহাড়িরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হয়। মিছিলটি বনরূপা বাজারের পেট্রোল পাম্পের কাছে এলে মিছিলকারীদের সঙ্গে বাঙালিদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। এ ঘটনার পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বনরূপা, কাঁঠালতলী, কোর্ট বিল্ডিং, রাজবাড়ী ও এর আশপাশের এলাকা রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। রাঙামাটিতে পাহাড়ি বাঙালি এ ভয়াবহ সংঘর্ষে অজ্ঞাত ১ জন পাহাড়ি যুবক নিহত হয় এবং উভয় পক্ষে নারী-শিশুসহ অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। 

রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো. মোশাররফ হোসেন খান বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিকাল ৫টায় জেলা প্রশাসন সম্মেলন কক্ষে জেলা কোর কমিটির জরুরি সভা ডেকেছে। সভায় সংঘাত-সংঘর্ষ, জ্বালাও-পোড়াও ও ভাঙচুর-পরবর্তী পদক্ষেপ বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে জানান এ কর্মকর্তা। সর্বশেষ তথ্যে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে আহত অবস্থায় ৫৪ জনকে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেছে।এদের মধ্যে ২৫ বছর বয়সি ১ পাহাড়ি যুবকের মৃত্যু হয়। মুমূর্ষু  ৩ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে ১৯ জন ভর্তি রয়েছে। ৩৪ জন জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে। 

এদিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানায়, তিন পার্বত্য জেলায় উচ্ছৃঙ্খল জনসাধারণের মধ্যে চলমান সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত সময়ে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও ব্যক্তিবর্গকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। যথাযথ তদন্ত কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের শনাক্তসহ প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানায় আইএসপিআর।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আরেফিন জুয়েল সময়ের আলোকে বলেন, পাহাড়ে গুজবকে কেন্দ্র করে অস্থিরতার প্রকৃত ঘটনা, নেপথ্যে কারা এবং কী হয়েছে বা হচ্ছে সবকিছু এই ডিজিটাল যুগে পরিষ্কার করা হবে। যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানি দিচ্ছে তাদেরও শনাক্ত করা হবে এবং আইনের আওতায় আনা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় শক্তহাতে সকল পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রিপল বাপ্পি চাকমা বলেন, রাতে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ১৬ জনকে আনা হয়। তারা বেশির ভাগই সদর উপজেলা থেকে রাতে এসেছেন। এর মধ্যে তিনজন মারা যান। নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ ময়নাতদন্ত শেষে বলা যাবে। বর্তমানে হাসপাতালে আরও ৯ জন চিকিৎসাধীন।

তিনি বলেন, তিনজনের মরদেহ সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন, সোহেল চাকমা, মানব ত্রিপুরা, বিজয় চাকমা ও নলেজ চাকমা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রশাসন সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার দিকে দীঘিনালা লারমা স্কয়ার এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ বাধে। বুধবার মোহাম্মদ মামুন (৩০) নামের এক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগ মারধরের ঘটনার জের ধরে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে। আহত মামুন বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার বাসিন্দা। এ ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় পাহাড়িরা মিছিলে বাধা দেন বলে অভিযোগ। তখন সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে পাহাড়িদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পাহাড়িরা ঘরবাড়ি ছেড়ে গহিন পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান।

দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ বলেন, আগুনে দীঘিনালা বাসস্টেশন ও লারমা স্কয়ার এলাকায় ১০২টি দোকান আগুনে পুড়ে গেছে। এর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায়ের ৭৮টি ও বাঙালির সম্প্রদায়ের ২৪টি দোকান রয়েছে। ভাঙচুর হয় চারটি দোকান। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মিলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে কাজ করছেন। প্রশাসন নিরাপত্তা জোরদার করেছে।

এদিকে বৃহস্পতিবার রাতভর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ, আগুন দেওয়া, গোলাগুলি, হত্যার মতো বিভিন্ন পোস্ট দেখেছে পাহাড়বাসী। এসব পোস্ট দেখে বেশির ভাগ মানুষই নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। সবাই নিজের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য রেখেছেন পূর্বপ্রস্তুতি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল জেলার প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। তারপরও কেন এত গুজব রটানো হলো সামাজিক মাধ্যমে? এ সম্পর্কে পার্বত্য নাগরিক পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলার সম্পাদক মো. মাসুম রানা বলেন, এর নেপথ্যে পাহাড়ের আঞ্চলিক দল, রাষ্ট্রের পরাজিত শক্তি ও ভূ-রাজনীতি জড়িত। সারা রাত ধরে অনেকে মিথ্যা ও উসকানিমূলক পোস্ট দিয়ে তরুণ ও যুবকদের ঘর থেকে বের করে এনে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে চেয়েছে।

এইচ এম ইউছুফ আলী নামের পানছড়ি এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, মামুনকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো খাগড়াছড়িতে। এর জেরে সংঘর্ষ হলো ২৬ থেকে ২৭ কিলোমিটার দুরের দিঘীনালায়। আর আমাদের দোকান পোড়ানো হলো ঘটনাস্থল ২৫ কিলোমিটার দূরের পানছড়িতে। এর আগে পাহাড়ি যুবকরা পানছড়ি ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ে হামলা চালায় ও ভাঙচুর করে। সেনাবাহিনীর টহল টিমকে আটকে রাখে। গুজব পোস্টের কারণে রাতে আর ঘুমাতে পারলো না পুরো জেলাবাসী।

দুই পক্ষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ। প্রকৃত ঘটনার পেছনে কারা? তারা কী করতে চাচ্ছে? এসব প্রশ্নের সমাধান করার জন্য তিনি সরকার ও প্রশাসনের নিকট দাবি জানান।

খাগড়াছড়ি সদরের বাসিন্দা রোমেল চাকমা জানান, আতঙ্কে সারা রাত ঘুমাতে পারেননি তারা। গুজব ও ফেসবুকের পোস্ট দেখে সবাই আতংকিত ছিলেন। বাড়িতে থাকা ভাড়াটিয়া পর্যন্ত বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছে। আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে কারা ফায়দা লুটতে চায়, তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

রহিম হৃদয় নামে খাগড়াছড়ি সদরের আরেক বাসিন্দা জানান, দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে পাহাড় নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি এই ফাঁদে পা না দিতে সকলকে অনুরোধ জানান।


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close