তুমি না একটা দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছ? দেশের ছাত্ররা আজ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে। বর্তমান এ অবস্থায় তোমার কথাটি খুব মনে পড়ছে। তুমি বলতে, দেশের সরকার যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন বিদ্রোহীভাবাপন্ন জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক একসময় এমন একটা বিপর্যয়ে এসে দাঁড়ায় যখন কর্তৃপক্ষ যা কিছুই করে তাতে জনগণের আক্রোশ আরও বাড়ে এবং যা কিছু না করে তাতে বাড়ে জনগণের অশ্রদ্ধা। দেখো এক কোটা সংস্কারকে ঘিরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার সব শিক্ষার্থী আজ রাস্তায়। কীভাবে দল বেঁধে মুহুর্মুহু স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে প্রতিবাদ করছে।
চলো না আমরাও ওই তরুণদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে প্রতিবাদে অংশ নিই। তোমার মনে নেই আমরা একসঙ্গে কত মিছিল করেছি? আজ আমার খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাই। এই ছোট ছোট সন্তানরা যদি পারে আমরা কেন পারব না? তুমি পারবে আসতে? সেই সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে? আজ কতদিন তারা না খেয়ে না ঘুমিয়ে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে রাস্তায় নেমে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ছে। পুলিশ তাদের অত্যাচার করছে কিন্তু তাতে তারা আরও বেশি জ্বলে উঠছে। তুমি বলতে, ‘মানুষ যখন শোষণ-নির্যাতনের শেষ পর্যায়ে চলে অসে, তখন তার হারানোর ভয় থাকে না, তখন মানুষ সাহসী হয়ে ওঠে। নির্যাতনই তাকে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করে।’ হ্যাঁ, এখন পরিস্থিতি সে রকমই।
তুমি যে কেন দেরি করছ বুঝতে পারছি না! আমি নিশ্চিত তারুণ্যের এই প্রতিবাদের মুখে তুমি কোনোভাবেই ঘরে বসে থাকতে পারতে না। যবে থেকে তোমার সঙ্গে পরিচয় তবে থেকেই তোমার মুখে সাম্যের কথা শুনে আসছি। অনেক বিষয়ে আমার সঙ্গে তোমার তর্কও হতো। তুমি শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতে। আমি বলতাম, ও! সমাজতন্ত্র! এ নিয়ে দুজনের বেশ তর্ক হতো। তুমিও পৃথিবীর নানা প্রান্তের তাত্ত্বিকদের উদাহরণ দিতে। আমিও কম যেতাম না। আমি একটু মধ্যপন্থার, সে কারণে তুমি আমাকে পেটি বুর্জোয়া বলে, বলা চলে একপ্রকার গালাগালই দিতে। পেটি বুর্জোয়াও যে একটা তীক্ষ্ণ গাল হতে পারে, তোমার সঙ্গে তর্কে না গেলে বুঝতেই পারতাম না।
পরে একসময় দেখি রাজাকারও একটা গালি, রোহিঙ্গাও একটা গালির পর্যায়ে চলে গেছে। আসলে মতাদর্শের নীতিগত অবস্থানও যে সমাজে কখনো নেতিবাচকভাবে উচ্চারিত হয়, এটা তারই প্রমাণ।
দেখো, গতকাল পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি করেছে। ছাত্ররা কিন্তু ভয়ে পালিয়ে যায়নি। বরং আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। আমার খুব মনে পড়ছে নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কথা। সে সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরাও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলাম। সেখানেই তো তোমার সঙ্গে পরিচয়। তোমরা কলাভবনের করিডোর দিয়ে মিছিল করে শিক্ষার্থীদের ক্লাস বয়কটের কথা বলছিলে। আমরা কয়েকজন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার দিয়ে বিরোধিতা করেছিলাম। বলেছিলাম, আপনারা ছাত্রনেতারা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করেন, আর আমরা ক্লাস বয়কট করব? তুমি খুব ক্ষেপে উঠে বলেছিলে, হত্যার প্রতিবাদকে কি আপনি সমর্থন করেন না?
শোনো, এই মাত্র ফেসবুকে একটা পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে- পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। আশপাশে হাজার হাজার মানুষ স্লোগানে মুখরিত। পুলিশ আবু সাঈদকে সরাসরি বুক বরাবর একটা নয়, পরপর তিন রাউন্ড গুলি করে। প্রথমে সাঈদ বুঝতে পারেনি, মানুষও হতভম্ব হয়ে পড়ে কীভাবে এমন নিরস্ত্র যুবকের বুকে সরাসরি পুলিশ গুলি করতে পারল? সময় যত গড়ায় মৃত্যুর মিছিল বাড়তে থাকে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবকসহ সাধারণ আর কেউ ঘরে রইল না। সরকার আন্দোলন থামাতে নানা অপকৌশল শুরু করেছে। তাতে আন্দোলন আর ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েছে। কী চমৎকার চমৎকার নান্দনিক স্লোগান এই বাচ্চাদের মুখে! ছোট ছোট বাচ্চাদের এত চমৎকার সাংগঠনিক দক্ষতা তোমাকে মুগ্ধ করত আমি নিশ্চিত। তুমি প্রায়ই বলতে যেদিন সমাজে তরুণরা জেগে উঠবে, যেদিন তারা বুক চিতিয়ে শাসকদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে, সেদিন হবে প্রকৃত বিপ্লব। হ্যাঁ, তারই প্রতিফলন, শিক্ষার্থীরা বন্দুকের নলকে আর ভয় পাচ্ছে না। আমি আমাদের ঘরের আবদুল্লাহ, শাকিবকেও আটকে রাখতে পারিনি।
ওরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মরিয়া। আমি কিছু বললে বলে, কেন, তুমিও তো একসময় আন্দোলন করেছ। সেই তুমি কীভাবে আমাদের বাধা দাও। আজ আর ওদের আটকে রাখিনি। দুরু দুরু বুকে বললাম, ঠিক আছে যাও। সঙ্গে কিছু সাবধান বাণী। ওদের কিছু শোনার সময় নেই। বেরিয়ে গেল। আমি উৎকণ্ঠায় একবার মোবাইল দেখি আবার টেলিভিশনের সামনে খবরে চোখ। কোথাও স্বস্তি পাচ্ছি না। মেলবোর্ন থেকে অরিত্র মেসেঞ্জারে ছবি পাঠায় রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলের যে ছেলেটা মারা গেছে, তার শিক্ষকের ছেলে। আরও নানা দিক থেকে মৃত্যুর খবর। মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। আমার মাথা ঝিম ধরে আছে কিছুই কাজ করছে না।
আচ্ছা, এই যে এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, আমি একা। তুমি কি বুঝতে পারছ আমার মনের অবস্থা? আমি যে এত কথা বলছি কিন্তু তুমি কীভাবে নিশ্চিন্তে আছ? এই দাঁড়াও তো! গেটের কাছে কীসের এত হইচই শোনা যাচ্ছে! এ কী! আবদুল্লার শরীরে ও মাথায় ব্যান্ডেজ। দশ বারোজন ছেলেমেয়ে আবদুল্লাকে ধরে নিয়ে এসেছে। পুলিশের টিয়ারশেলে ছেলেটা ক্ষতবিক্ষত। ছেলেটা আমার কাতরাচ্ছে। ওরা হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে এনেছে। ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়েই সবাই আবার বেরিয়ে গেল। পেছন থেকে আমি ডাকলাম শাকিব... শাকিব... ও পেছনে তাকিয়ে একবার শুধু হাত নাড়ল, মিলিয়ে গেল মিছিলে।
আমি আবদুল্লার মাথার কাছে এসে বসলাম। ও কোনো রকমে ক্ষীণ কণ্ঠে প্রশ্ন করে, তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ? আমি দেয়ালে ঝোলানো তোমার ছবির দিকে তাকিয়ে বললাম, না বাবা। আমিও তোর মতোই স্বপ্ন দেখছি বাংলাদেশ পুনর্গঠিত হবে তবে সেটা ঘটাবে কূটনীতিকরা নয়, ছাত্র-জনতা।
সময়ের আলো/আরএস/