ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

মব জাস্টিস বন্ধ হবে কবে
প্রকাশ: শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২:১৯ এএম আপডেট: ২০.০৯.২০২৪ ৯:৪১ পিএম  (ভিজিট : ৫৪১)
গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই উত্তেজিত জনতার তাণ্ডবের (মব জাস্টিস) শিকার হয়েছেন অনেকেই। অন্তর্বর্তী সরকার এই পরিস্থিতির উন্নতির চেষ্টা চালিয়ে গেলেও দেশের কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে উদ্বেগজনক ঘটনা। গত বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলে ‘চুরির’ অপবাদ দিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন এক ব্যক্তিকে ভাত খাইয়ে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রলীগ নেতাকে ক্যাম্পাসের ভেতর পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন ওঠে, এই মব জাস্টিস কবে বন্ধ হবে।

নাগরিক কমিটি, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞদের মতে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শুধু সামাজিক অস্থিরতাই প্রত্যক্ষ কারণ নয়, এর সঙ্গে কোনো কোনো মহলের ক্ষমতা অপব্যবহারের মতো অনাকাক্সিক্ষত বিষয়গুলোও জড়িত। এই ধারার ঘটনা রুখতে একই সঙ্গে সামাজিক আন্দোলন ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের তাগিদ দিয়েছেন তারা। এই পরিস্থিতি এখনই ঠেকাতে না পারলে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের যে উদ্দেশ্য তা সম্পূর্ণ বৃথা যাবে বলে মন্তব্য করেছেন তারা। 

ঢাবি-শাবি ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি আলোচিত বা নৃশংস হত্যাকাণ্ড : ৬ আগস্ট বাগেরহাটে ঘরে ঢুকে সাবেক স্কুলশিক্ষক মৃণাল কান্তি চ্যাটার্জিকে (৬৫) পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

১৪ আগস্ট সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাড়ি ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে এক আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হন। পূর্ববিরোধের জেরে ৩ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় বেলাল উদ্দিন (৪৫) নামের এক যুবদল নেতাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ৭ সেপ্টেম্বর রাতে চার দিন বয়সের শিশুসন্তানের জন্য ওষুধ কিনতে গিয়ে পিটুনিতে মারা যান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদ।

বগুড়ায় দলীয় কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মিজানুর রহমানকে (৪০) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৯ সেপ্টেম্বর রাতে ওই হামলার সময় ল্যাদো (৩৫) নামে এক যুবদলের কর্মী গণপিটুনিতে নিহত হন। ১৭ আগস্ট কক্সবাজার শহরের কলাতলী এলাকায় গরু চুরির অপবাদ দিয়ে সাজ্জাদ হোসেন (২১) নামে এক তরুণকে তুলে নিয়ে রাতভর পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ১০ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় শুক্কুরসহ তার বাহিনীর ১৫-২০ জন এক গার্মেন্ট শ্রমিকের কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার সময় ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করে। ৬ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি বাসা থেকে বোরহান উদ্দিন সাইমন নামে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের ধারণা, তাকে খুন করা হয়েছে। একই দিন আদাবর থানার শনিরবিল এলাকায় রাতে তুহিন নামে এক বিকাশকর্মীকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছে দুর্বৃত্তরা। তার আগে ৪ সেপ্টেম্বর সকালে মিরপুরের দারুসসালাম এলাকায় রইচ বেপারি নামে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। ওইদিন রাতে ওয়ারী এলাকা থেকে ২৫ বছর বয়সি এক তরুণের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ছাড়া তুমুল আলোচনার মধ্যে আছে কক্সবাজার সৈকতে কয়েকজন নারীকে হেনস্তা, ঢাকার ভাসমান যৌনকর্মীদের পেটানোর মতো ঘটনা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) মো. ইসরাইল হাওলাদার সময়ের আলোকে বলেন, পুলিশের টহল এখনও পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। যানবাহন সংকট রয়েছে। যেখানে টহলে প্রতিটি থানায় ছয় থেকে আটটি গাড়ি চলাচল করত, বর্তমানে কোথাও কোথাও দুই থেকে তিনটি চলছে। যানবাহন সংকটে আগের মতো টহলে বের হতে পারছে না পুলিশ। যার কারণে আইনশৃঙ্খলা কিছুটা অবনতি। তবে ঢাবিতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক সময়ের আলোকে বলেন, মব জাস্টিসের নামে অস্থিরতা ও সহিংসতার যে ঘটনাগুলো লক্ষ করা যাচ্ছে সেগুলো মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরি করছে। ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে প্রতিহিংসা ও ক্ষোভ থাকতেই পারে। তবে ‘মব জাস্টিস’ বা নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার অধিকার কারো নেই। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটি আইনের মাধ্যমে সমাধান করাটাই স্বস্তির বার্তা। এর ফলে শৃঙ্খলা বজায় থাকবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকলে ব্যক্তি ক্ষোভের প্রভাব বেশি পড়বে। ব্যক্তি যদি ব্যক্তি দ্বারা ক্ষতি হয় আর সেটি যদি কয়েকজনকে নিয়ে হামলা চালায় তা হলে সেটি সবার মাঝে প্রশ্ন তৈরি করবে। মানুষ যা খুশি তাই করবে এটি কোনো স্বাধীনতা নয়। সমাজে সহাবস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের যেই প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার রয়েছে সেগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। মব জাস্টিস যেখানেই হোক তা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নয়তো রাষ্ট্র সংস্কারকে কেন্দ্র করে সরকারের গৃহীত উদ্যোগগুলো নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরি করবে। 

সাবেক ছাত্রনেতা ও অ্যাক্টিভিস্ট বাকি বিল্লাহ সময়ের আলোকে বলেন, গত কিছু দিন ধরে মন্দিরে হামলা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, মাজারে হামলা যেভাবে চলছিল তখন ঠিক মতো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তার ফল হিসেবে ঢাবি ও জাবিতে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আগে যদি যথাযথ ব্যবস্থা নিত, তা হলে এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটত না। এগুলো থেকে বোঝা যায় যে, রাষ্ট্র এখনও পরিপূর্ণভাবে সংগঠিত হতে পারেনি। আমার মনে হয়েছে সরকার বেশ কিছু কাজে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা এগুলো সমর্থন করছে তাও কিন্তু নয়। তাদের আন্তরিকতাকে সামনে আনতে হলে এসব বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ঢাবি ও জাবির ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত, তারা ফ্যাসিস্টদের প্রেতাত্মা। প্রত্যেককে গ্রেফতার করতে হবে। তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সারাদেশে যে ‘মব’ পদ্ধতি চলছে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুর মোহাম্মদ সময়ের আলোকে বলেন, এখন যে সময়টা যাচ্ছে তা নানা কারণে স্বাভাবিক নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ দমনের কাজ হলো পুলিশের। এই ক্ষেত্রে পুলিশ কীভাবে কাজ করতে পারে, কাজ করতে গেলেও তারা তা পারছে না। এর প্রধান কারণের মধ্যে একটি হলো পুলিশের ঘন ঘন বদলি। অন্যটি হলো তাদের লোকবল কম। তারা যে ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট পাওয়া দরকার তাও তারা পাচ্ছে না। 

সাবেক এই আইজি বলেন, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পরে সব ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। তাই আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কিছুটা সময় লাগবে। এখনও অনেক পুলিশ সদস্য পলাতক, যার ফলে তারা দায়িত্বে যোগদান করেনি। সবাই মিলে তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে। পুলিশের কাজটি মূলত থানা থেকে হয়। তাই থানাগুলোতে যেন ঠিকমতো কাজ হয় তাই এলাকার মানুষ তাদেরকে সাহস দিতে হবে। তা ছাড়া সেনাবাহিনী যেহেতু মাঠে আছে তাই সমন্বয় করে কাজ করলে আমার মনে হয় সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। বিভিন্ন ঝামেলার কারণে তাদের কাজের গতিতে সময় লাগছে।

সাবেক আইজি মোহাম্মদ নুরুল হুদা সময়ের আলোকে বলেন, এসব ঘটনা তো সবসময়ই ঘটে যাচ্ছে। এগুলোকে নতুন করে দেখার মতো কিছুই নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহু দিন ধরেই এসব চলে আসছে। আগে বেশি ছিল তাই বলে কি এখন কমে যাবে নাকি। খারাপ ছাত্ররা এখনও রয়েছে। সব যে ভালো হয়ে গেছে তা কিন্তু নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এগুলো দেখার জন্য খুব বেশি তৎপর হতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রচিন্তা নামের সংগঠনের শিক্ষার্থী মোস্তাকিম বিল্লাহ মাসুম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে এমন ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই দায় এড়াতে পাওে না। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের দায়ও কম না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জানমাল রক্ষার দায়ভার কর্তৃপক্ষের, সেই দায়িত্বে অবহেলায় শিক্ষার্থীরা নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে। যার ফলে এমন ঘটনা ঘটছে। আবার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ‘মবায়ন’ কীভাবে ঘটে, সেই জরুরি প্রশ্নও আমাদের তুলে ধরতে হবে। আমাদের শহর ভাবনায় বিনোদনের অভাব থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হতে হয়, যার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও শহরের মানুষ ক্রমাগত মুখোমুখি অবস্থান তৈরি করা হয়, যাকে রাষ্ট্রীয় প্রকল্প হিসেবেই ভাবতে ইচ্ছা করে। এ ব্যাপারেও আমাদের সচেতনতা জরুরি হয়ে পড়ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন ঢাবি শিক্ষার্থী তুহিন খান। এই অ্যাক্টিভিস্ট লেখক সময়ের আলোকে বলেন, ঢাবি এবং জাবিতে যে নৃশংস ঘটনা ঘটেছে তার একমাত্র কারণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবনতি। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার দায়িত্ব সরকারের। আমরা নাগরিক সমাজ এসব ন্যক্কারজনক ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। তিনি বলেন, এর আগেও মাজারে হামলা, জমিদখল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির ওপর হামলা, এমনকি হিজবুত তাওহিদের ওপর হামলার পরিকল্পনা আমরা সামাজিক প্রতিরোধ করেছি। পরবর্তীতে এই ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। একইভাবে নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমরা সামাজিকমাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ব। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য সামিনা লুৎফা সময়ের আলোকে বলেন, ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে দুটি হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী প্রতিটি অপরাধীকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে। যেসব হলে এত বড় জঘন্য ঘটনা ঘটেছে সে হলের প্রভোস্টসহ আবাসিক শিক্ষকদের পদত্যাগ করতে হবে। তিনি বলেন, প্রক্টর এবং প্রক্টরিয়াল টিমের দায়িত্বে অবহেলার জন্য পদত্যাগ করতে হবে। দুই উপচার্যকেই এ হত্যাকাণ্ডের দায় নিতে হবে। মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার মতো বড় দুঃসাহস যেন আর কারও না হয়।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close