ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

আন্দোলনে চোখ হারানো মানুষের আর্তি
সব ছবি আজ অন্ধকার
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:০৯ এএম আপডেট: ১৯.০৯.২০২৪ ১০:০৮ এএম  (ভিজিট : ৭৪৯)
অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র শুভ সরকার। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিনে গাজীপুরের শফিপুরে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘাত চলছিল। তিনিও আন্দোলনে গিয়েছেন। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার মাথা, চোখ, কপাল, হাত-পা, বুক-পিঠ এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে অজস্র ছররা গুলি লাগে। শরীর থেকে অনেক গুলি বের করা হয়েছে। তবে এখনও মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে অনেক গুলিই থেকে যাওয়ায় হাসপাতালের বিছনায় যন্ত্রণায় ছটফট করছেন তিনি। এমনকি বাঁ চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।

বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সেখানে কথা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। একই সঙ্গে কথা হয় এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও পাঁচজনের সঙ্গে। তাদেরও একই অবস্থা। কারও ডান বা বাম চোখ নষ্ট হয়েছে। আবারও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কারও চোখ তুলে ফেলা হয়েছে। সবাই প্রাণে বাঁচলেও এক চোখ হারিয়ে ও শরীরে অসংখ্য গুলি-ক্ষত নিয়ে হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছেন। আহতদের মধ্যে কেউ ছাত্র, আবার কেউ গার্মেন্টস কর্মী, কিংবা ড্রাইভার। সবাই নিম্ন ও দরিদ্র পরিবারের। একেক জনের চোখ হারানো রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকের ঘরে স্ত্রী, সন্তান মা-বাবা রয়েছে। ক্ষত সারলেও ভারী কাজ করতে পারবেন না। আর ভবিষ্যতে কীভাবে চলবে জীবন-সংসার তা নিয়ে চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। কর্মহীন থাকায় তাদের পরিবার মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। চরম অর্থ সংকটের মধ্যে ধারদেনা করে চিকিৎসা চলছে।

হাসপাতালে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চোখে বিভিন্ন ধরনের আঘাত নিয়ে যারা এসেছিলেন, তাদের বেশিরভাগই ছররা গুলিতে আহত। তাদের প্রাথমিক অস্ত্রোপচার যেটি প্রয়োজন, সেটি দেওয়া হয়েছে। অনেকে অস্ত্রোপচারের পর ছাড়পত্র নিয়ে চলেও গেছেন। এ ধরনের রোগীদের পূর্ণ সুস্থ হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন।

সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখানে এখন পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ২৬ জন। তাদের মধ্যে বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন ১১ জন। এখানে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই রোগীদের সব খরচ সরকার ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহন করছে।

আন্দোলনে আহত হওয়ার সেই দিনের নৃশংস ও লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দিয়ে শুভ সরকার সময়ের আলোকে বলেন, ৫ আগস্ট সকাল থেকেই গাজীপুর এলাকায় পুলিশ-আনসার সদস্য ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছাত্রদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছিল। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে শফিপুর এলাকায় আমি পুলিশের সামনে পড়ে যাই। তখন খুব কাছ থেকে পুলিশ-আনসার সদস্য আমাকে গুলি করে। কতগুলো গুলি করেছে বলতে পারব না। তখন আমার জ্ঞান ছিল। আমি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলাম। পুলিশ-আনসার সদস্যরা বুট দিয়ে কয়েকবার লাথি মেরে দেখেছে আমি মরে গেছি কি না। তারা চেক করেছে। তখনও কয়েকটা গুলি করেছে। আমি মরে গেছি ভেবে তারা ফেলে রেখে চলে যায়। এরপর আমি কিছু বলতে পারব না।

তিনি বলেন, এক পর্যায়ে আমি দেখি গাজীপুরের একটি হাসপাতালে ভর্তি। আমাকে কে এনেছে বা ভর্তি করেছে কিছুই বলতে পারব না। কয়েক দিন গাজীপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। এখনও মাথার মধ্যে গুলি রয়েছে। সেই ঘটনা এখনও বারবার চোখের মধ্যে ভাসে। কতটা ভয়াবহ ছিল তা বলে বোঝাতে পারব না।

তার পরিবাবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুভ সরকারের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলায়। বগুড়ার একটি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষে তিনি পড়াশোনা করছেন। আর চোখের অপারেশন এবং ওষুধপত্রসহ এখন পর্যন্ত তাদের মোট প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। যদিও সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর প্রায় সব খরচই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং সরকার বহন করছে। তবে শুভ সরকারের মাথার মধ্যে থেকে গুলি বের করতে না পারায় ভবিষ্যতে নিয়ে চরম উৎদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে তার পরিবার।

আন্দোলনে চোখ হারানো আরেক রোগী অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মো. জুয়েল। তার ডান চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। তার বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে। সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে গত ৭ তারিখে ভর্তি হন।

জুয়েল সময়ের আলো বলেন, ছাত্র আন্দোলেন সময় ঢাকায় ছিলাম। গত ১৮ জুলাই শনি আখড়ায় ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষের সময় পুলিশ সরাসরি আমাকে গুলি করে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন আমার শরীরে ৩৮টি ছররা গুলি ছিল। এখনও সব গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। তিনি আরও জানান, আহত হওয়ার পর আমাকে প্রথমে ইসলামিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে এক চোখ নষ্ট হয়ে যায়। আমার হাতে-পায়ে, পেটে-পিঠে-কপালে এবং পা থেকে কোমর পর্যন্ত ছররা গুলির ক্ষত চিহ্নে ভরা। আমার শরীর দেখলে নিশ্চিত যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে। যদিও দগদগে ঘাগুলো এখন অনেকটাই শুকিয়েছে। কিন্তু ব্যথা কিছুতেই কমছে না। রাতে ঘুমাতে পারি না। ব্যথার যন্ত্রণায় মনে হয় মরে যাচ্ছি। একটা চোখ সারা জীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছি। একটা অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেল। এখন এভাবেই বেঁচে থাকতে হবে। তবুও ভাগ্য ভালো অনেকের মতো আমি মরিনি। যে অবস্থা হয়েছিল মরেও যেতে পারতাম। তাই চোখ হারালেও খুব একটা আফসোস হয় না। এখন পর্যন্ত তার প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে এবং ধারদেনা ও স্বজনদের সহায়তায় খুব কষ্টে তার চিকিৎসা চলছে বলেও জানান তিনি।

পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে এবং এক চোখ হারিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন বগুড়া সদরের বাসিন্দা মফেদা বেগম। তিনি জানান, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিনে আমার ছেলে আন্দোলনে বের হয়। তখন সকাল থেকেই চারদিকে মারিমারি-ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলছিল। অনেকেই মারা যাচ্ছিল এবং রক্তাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছিল। এই অবস্থা ছেলের খোঁজ না পেয়ে টেনশনে পড়ে যাই। ছেলের দুশ্চিন্তায় তাকে খুঁজতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। সংঘর্ষের মধ্যেই কোথায় থেকে গুলি এসে চোখের মধ্যে লাগে। পরে স্থানীয়রা হাসপাতালে ভর্তি করে।

তিনি বলেন, আহত হওয়ায় প্রথমে বগুড়ার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি হই। সেখানে আমার বাম চোখ নষ্ট হয়ে যায়। কেন আমাকে গুলি করা হলো, কি অপরাধ ছিল আমার। যে আমার চোখ নষ্ট করেছে আমি তার বিচার চাই। চিকিৎসায় আমার অনেক খরচ হয়েছে। এখানে ভর্তি হওয়ার পর হাসপাতালে কর্তৃপক্ষ খরচ দিচ্ছে। আমার স্বামী সামান্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। কিন্তু সামনে দিনে কীভাবে খরচ যোগাব। কীভাবে ওষুধ কিনব আর কীভাবে সংসার চালাব সেই চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না।

জীবিকার তাগিদে গাজীপুরের এক পোশাক কারখানায় কাজ করতেন মাসুদ রানা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই ছিলেন সক্রিয়। গত ৪ আগস্ট কালিগঞ্জ উপজেলায় শত শত শিক্ষার্থী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। তাতে তিনিও অংশ নেন। আর এ আন্দোলনে অংশ নেওয়াই কাল হলো জীবনে। মাথা থেকে শুরু করে হাত-পা, পেট-পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে শত শত ছররা গুলি লাগে তার। এমনকি বাদ যায়নি চোখও। শরীর থেকে কিছু গুলি বের করলেও চোখের ভেতরে, হাতে-পিঠে এবং মাথায় এখনও ২০-২৫টি গুলি আটকে আছে বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। শরীরজুড়ে অসংখ্য গুলি আর ক্ষত নিয়ে কখনো হাসপাতাল কাতরাচ্ছেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের হিলিতে। মা, ভাই-বোন, সন্তান নিয়ে তাদের পরিবার। তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আহত হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে তার পরিবার অভাব-অনটনে দিন কাটছে এবং ধারদেনা করে চিকিৎসা চলছে বলেও জানান তিনি।

মাসুদ রানা ক্ষোভ প্রকাশ করে সময়ের আলোকে বলেন, আমার পুরো শরীরজুড়ে ছররা গুলির ক্ষতচিহ্ন ভরা। কিন্তু ব্যথা কিছুতেই কমছে না। এক চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। সুন্দর পৃথিবীটা আর দুই চোখ দিয়ে দেখতে পাব না। আমার দেখা সব ছবি আজ অতীতের অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে। শরীরে গুলি থাকায় যন্ত্রণায় হাঁটাচলা করতে কষ্ট হচ্ছে। অসহ্য ব্যথায় রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। আহত হওয়ার পর আমি কয়েকটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। তাতে আমার অনেক খরচ হয়েছে। কিন্তু এই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পায়নি। অথচ সব মিলিয়ে আমার লাখ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। চিকিৎসার সব খরচই ধারকর্জ করতে হয়েছে। প্রতিদিন ওষুধপত্রসহ হাজার হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। আমরা তো গরিব মানুষ। এত টাকা পাব কই? কীভাবে ওষুধ খাব আর কীভাবে সংসার চলবে। সেই কথা ভাবলে দুই চোখে অন্ধকার দেখি।

আহত হওয়ার সেই দিনের ভয়াবহতার দৃশ্যের বর্ণনা করে চোখ হারানো আরেক রোগী হৃদয় হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, আন্দোলনের শুরু থেকেই বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে আহত শিক্ষার্থীদের আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে নানাভাবে সহায়তা করেছি। গত ১৮ জুলাই রামপুরা টিভি গেটের সামনে মুখোমুখি আন্দোলনে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও ছররা গুলি মারতে মারতে এগিয়ে আসে। আর গুলিতে আমার পুরো শরীর ঝাঁজরা করে দেয়। চোখের মধ্যে গুলি লাগে কিন্তু ভাগ্য ভালো যে অনেকের মতো মরে যাইনি। আর বাম চোখও নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু বেঁচে থাকলে টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারছি না। কবে সুস্থ হয়ে কাজ করতে পারব সেটাই জানি না। ভবিষ্যতের চিন্তায় দুই চোখের পাতা এক করতে পারছি না।

ভুক্তভোগী রোগী ও পরিবারের সদস্যরা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ছররা গুলিতে অনেকেই চোখ হারিয়েছেন। একাধিকবার অপারেশনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে অনেককে। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে হচ্ছে তাদের। তাতে ওষুধসহ অনেক টাকা খরচ হয়েছে। যা অনেকের আর্থিক সামর্থ্য নেই। হাসপাতালে থাকা পর্যন্ত রোগীরা সেবা পাবেন। এরপর কী হবে, সেটি জানেন না তারা।



সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close