ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

নিয়োগ, বদলি ও টেন্ডার বাণিজ্য করেই শত শত কোটি টাকা লোপাট
স্ত্রী-ভাইয়ের আলাদিনের চেরাগ ছিলেন ফরহাদ
জনবান্ধব উদ্যোগ নেওয়ার কারণে ডিসি মোহাম্মদ আজিজুল ইসলামকে প্রত্যাহার
প্রকাশ: বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১:০৩ এএম আপডেট: ১৮.০৯.২০২৪ ২:৪৮ এএম  (ভিজিট : ১০৩২)
২০১৪ সালের পূর্বে এলাকার সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। ছিল না রাজনৈতিক কোনো পদ-পদবিও। কিন্তু হঠাৎই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মেহেরপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিনা ভোটে হয়ে যান এমপি। আর ২০১৮ সালে কথিত রাতের ভোটের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পরই তার স্ত্রী মোনালিসা হোসেন ও ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুল পেয়ে যান আলাদিনের চেরাগ। নিয়োগ ও বদলিবাণিজ্য এবং টেন্ডারবাণিজ্য করেই শত শত কোটি টাকা আয় করতে থাকেন ফরহাদ হোসেনের পরিবারের সদস্যরা। এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের অভিযোগ প্রতিপক্ষকে দমনের নামে সাধারণ মানুষের ওপর চালাতেন নির্যাতন। ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে সরকারি চাকরি দিতেন তার স্ত্রী মোনালিসা। 

এ ছাড়া অনলাইন জুয়া পরিচালনারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রী ভাইয়ের প্রভাবে ছোট ভাই মৃদুল একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন সরকারি অফিসগুলোতে। গড়ে তোলেন টেন্ডারবাজির সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে ফরহাদ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই প্রশাসনে চরম দলীয়করণ শুরু হয়।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নিজের নগদ ৬ লাখ এবং স্ত্রীর ১০ লাখ টাকা দেখিয়েছিলেন ফরহাদ হোসেন। ২০২৩ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় নিজের নগদ ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ৬৯৬ টাকা এবং স্ত্রী মোনালিসা ইসলামের ৪৭ লাখ টাকা দেখান। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে হলফনামায় ফরহাদ হোসেন ও তার স্ত্রীর স্বর্ণের গহনা, ব্যবসা, কৃষি, গাড়ি-বাড়ি, সম্পদে তথ্য বেড়ে যায় অস্বাভাবিক। ২০১৪ সালের নির্বাচনি হলফনামায় তার বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ১২ হাজার ৩৪০ টাকা। হলফনামা অনুযায়ী আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ হিসেবে কৃষি ও ব্যবসা উল্লেখ ছিল। তার দাবি অনুযায়ী, বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা। আগে ব্যবসা ছিল না, থাকলেও প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর ব্যবসা থেকে আয় দেখানো হয় ১৭ লাখ ৭৯ হাজার ৩৭৪ টাকা। ২০১৮ সালের নির্বাচনি হলফনামায় নিজের বার্ষিক আয় ১০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দেখালেও ২০২৩ সালে সেই আয় ৪৭ লাখ ২৫ হাজার ৫৭৫ টাকা বলে উল্লেখ করা হয়।

গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মগোপনে ছিলেন সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও তার পরিবারের সদস্যরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে তাকে রাজধানীর ইস্কাটন এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। সরকার পতনের দিনই বিক্ষুব্ধ জনতা তার মেহেরপুরের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এলাকার লোকজনের অভিযোগ ফরহাদ হোসেন ও তার পরিবার জেলার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছিলেন। নিজ দলের দুর্দিনে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে চাটুকার, দুর্নীতিবাজ, পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে তিনি জেলার আওয়ামী রাজনীতি, বিভিন্ন উন্নয়নকাজের টেন্ডার, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার একক কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। 

জেলা শিল্পকলা একাডেমি, পাবলিক লাইব্রেরি, ক্রীড়া সংস্থা, ডায়াবেটিস হাসপাতালসহ প্রেস ক্লাব সর্বত্র তিনি নিজের অযোগ্য লোকদের বসিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় ধ্বংসের পথে নিয়ে যান। তার এসব অপকর্মের সহায়ক ছিলেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপাররা। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তার বিরোধী বলয়ের কিংবা ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের স্বাভাবিক প্রবেশাধিকার ছিল না। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতেও নিষেধ করা হতো। জেলার যে কোনো কর্মকর্তাকে মন্ত্রী ও তার পরিবারের আদেশ নির্দেশ পালন করতে বাধ্য করা হতো। কেউ অন্যথা করলে তার শাস্তি ছিল অবধারিত। ফরহাদ হোসেনের রাজনীতি ছিল মূলত প্রশাসন ও পুলিশনির্ভর। ২০১৮ সালে কথিত রাতের ভোটে তাকে বিজয়ী করার ব্যবস্থা করে দেন ছাত্রজীবনে তার বিভাগের সিনিয়র তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. আতাউল গণি। প্রশাসনকে চরম দলীয়করণ তার সময়েই শুরু হয় বলে অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তারা। সর্বশেষ বিরোধী দলবিহীন বিগত একপেশে নির্বাচনেও তার পছন্দের ডিসি শামীম হাসান ও এসপি রাফিউল আলমের ওপর ভর করে নির্বাচনি মাঠ সাজান। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অভিযোগে নির্বাচনের আগে এসপি প্রত্যাহার হলেও থেকে যান ডিসি। তার ওপর ভর করে কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে বিজয়ী হন। তার পছন্দের ডিসি শামীম হাসান ও পুলিশ সুপার এসএম নাজমুলকে সম্প্রতি বদলি করা হয়েছে। 

অভিযোগ রয়েছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ঘুষ ছাড়া বদলি ও পদোন্নতি হতো। ফরহাদ হোসেন তার পছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিয়ে সিন্ডিকেট করে মোটা অঙ্কের ঘুষের টাকা লেনদেন হতো। মেহেরপুর জেলায় একাধিক ব্যক্তির জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে ফরহাদ হোসেনের বিরুদ্ধে। স্ত্রী মোনালিসা ইসলামের মাধ্যমে এলাকার সরকারি নিয়োগের নামে ঘুষ গ্রহণ, বিভিন্ন দফতরে টেন্ডার থেকে কমিশনসহ নানা অপকর্ম করতেন শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ দোসর ফরহাদ। পুরো মেহেরপুর জেলাজুড়ে ফরহাদ-মোনালিসা দম্পতি ছিলেন আতঙ্কের নাম। এ দম্পতির বাইরে জেলায় কোনো কিছু ঘটত না। অভিযোগ রয়েছে জেলার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ফরহাদ হোসেনের বিরোধ ছিল। আওয়ামী লীগের বিরোধ নিয়ে কোনো সাংবাদিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ করলে তাকে বিরোধী দলের ট্যাগ দিয়ে তার সাঙ্গপাঙ্গোদের দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করত। 

গত ২৯ আগস্ট যৌথবাহিনীর অভিযানে ফরহাদ হোসেনের ফুফাতো ভাই শাজাহান সিরাজ দোলনের মেহেরপুর জেলা শহরের ক্যাশব পাড়ার ভাড়া বাড়ি থেকে কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ সরকারি মালামাল জব্দ করা হয়। সে সময় তার দাবি ছিল সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের পক্ষে তিনি বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন। জব্দ মালামালের মধ্যে রয়েছেÑবিনামূল্যে বিতরণের কুরআন শরিফ, কম্বল, বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়াসামগ্রী, সেলাই মেশিন, হুইল চেয়ার, চিকিৎসকের অ্যাপ্রোন, পিপি, শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রিপিস, অক্সিজেন সিলিন্ডার, শিক্ষার্থীদের টিফিন বক্স। এসব সামগ্রীর গায়ে লেখা রয়েছে ‘বিক্রয়ের জন্য নহে’। 

জনবান্ধব উদ্যোগ নেওয়ার কারণে প্রত্যাহার করা হয় ডিসি মোহাম্মদ আজিজুল ইসলামকে : জেলা শিল্পকলা একাডেমি, পাবলিক লাইব্রেরি, ক্রীড়া সংস্থা, ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্রেস ক্লাবসহ সর্বত্র ফরহাদ হোসেন অযোগ্য লোকদের বসিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় ধ্বংসের পথে নিয়ে যান। তার এসব অপকর্মের সহায়ক ছিলেন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারগণ। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তার বিরোধী বলয়ের কিংবা ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের স্বাভাবিক প্রবেশাধিকার ছিল না। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতেও বারণ করা হতো। তিন খলিফার সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রশাসন চালাতেন সাবেক ডিসি আতাউল গণি, ড. মনসুর আলম খান ও বর্তমান ডিসি শামীম হাসান। পিপি পল্লব ভট্টাচার্য, প্রফেসর হাসানুজ্জামান মালেক ও জেলা আওয়ামী লীগ যুগ্ম সম্পাদক ইব্রাহিম শাহীনদের নিয়ে ডিসির ছাদের গোলঘরে নিয়মিত অফিস শেষে সভা বসত। গত নির্বাচনের আগ মুহূর্তে অবশ্য হাসানুজ্জামান মালেকের সঙ্গে মন্ত্রীর দূরত্ব বাড়ে, তাই এক খলিফা বাদ নতুন খলিফা শাশ্বত নিপ্পনের আবির্ভাব হয়। এখান থেকে নানা পরিকল্পনা হতো। ব্যতিক্রম ছিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম। তিনি পূর্বসূরিদের অনুসরণ না করে ডিসি অফিসকে দল, মত নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত করেন। ঝিমিয়ে পড়া শিল্পকলা, ক্রীড়া সংস্থা ও পাবলিক লাইব্রেরি পুনর্গঠন ও উপযুক্ত লোক দিয়ে গতিশীল করার পরিকল্পনা করেন। যুগ যুগ ধরে শহরের ভেতর গড়ে ওঠা অবৈধ ট্রাক-বাস স্ট্যান্ড পৌর টার্মিনালে স্থানান্তরসহ নানাবিধ জনবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন।

মন্ত্রীর রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে প্রশাসনকে তিনি জনবান্ধব ও গণমুখী প্রশাসনে পরিণত করার নানা উদ্যোগ নেন। কিন্তু এসব জনবান্ধব উদ্যোগ মন্ত্রী ও তার সাঙ্গপাঙ্গোদের রুষ্ট করে। যার ফলে মাত্র ৩ মাসের মাথায় নির্বাচনের আগেই তাকে প্রত্যাহার করে নেন। তার আগেও আরেকজন জেলা প্রশাসক ছিলেন আনোয়ার হোসেন। তিনিও মন্ত্রীর আস্থাভাজন না হওয়ায় মাত্র চার মাসে মেহেরপুর থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তার আগে শফিকুল ইসলাম নামের আরেক জেলা প্রশাসককেও বছরখানেকের মধ্যে বদলি করেন ফরহাদ হোসেন।

জেলার যেকোনো কর্মকর্তা নির্বিবাধে মন্ত্রী ও তার পরিবারের আদেশ নির্দেশ পালন করতেন। কেউ অন্যথা করলে তার শাস্তি ছিল অবধারিত। ফরহাদ হোসেনের রাজনীতি ছিল মূলত প্রশাসন ও পুলিশনির্ভর। 

সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জেলে থাকায় অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া তার স্ত্রী ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলেও তার কল রিসিভ করেননি।

সময়ের আলো/জিকে




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close