ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

সোহরাব কমিশন বিদায়ের পথে
প্রকাশ: শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৭:২২ এএম  (ভিজিট : ২৮৯৩৪)
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তনের হাওয়া শুরু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিদায়ের সুর বাজছে সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি)। যেকোনো সময় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় বিবেচনায় নিয়োগকৃত ‘সোহরাব কমিশন’ বিদায় নিতে পারে। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা কেলেঙ্কারিতে আস্থা সংকটে থাকা সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানে জোরেশোরে সংস্কারের দাবি উঠেছে। ইতিমধ্যে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইনের অপসারণ ও এর পুনর্গঠনের দাবিতে বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীরা। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখতে হলে পিএসসির কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। পিএসসির অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানটির ওপর জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে দ্রুত পিএসসির সংস্কার করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পুরো কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে।

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগদানে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি কর্মকমিশন দীর্ঘদিন ধরে দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পিএসসির অধীনে বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের প্রায় ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ওঠে। এমনকি সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। 

আরও উদ্বেগজনক হচ্ছে, এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত পিএসসির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের পর পিএসসি যে তদন্ত কমিটি করেছিল, সে কমিটি তদন্ত কাজ শেষ করেছে। তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন পিএসসি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন। 

তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের প্রমাণ পায়নি। এখন এই প্রতিবেদন আমরা সরকারের কাছে পাঠাব। সভায় তদন্ত প্রতিবেদন সদস্যদের পড়ে শোনানো হয়। সেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল, তা প্রমাণিত হয়নি।

তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিতে আহ্বায়ক ছিলেন পিএসসির যুগ্ম সচিব আবদুল আলীম খান। কমিটির সদস্য ছিলেন পিএসসির পরিচালক দিলাওয়েজ দুরদানা। আর তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন পিএসসির পরিচালক মোহাম্মদ আজিজুল হক। বাংলাদেশ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে পিএসসির দুই উপপরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সরকারি কর্মকমিশন সূত্রে জানা গেছে, সংবিধানের ১৩৮ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। কমিশন পুনর্গঠনে সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে চেয়ারম্যান ও সদস্যদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা। পরবর্তী সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চেয়ারম্যান ও অন্য সদস্যদের নিয়োগ প্রদান করে প্রজ্ঞাপন জারি করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই রয়েছেন। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি শাখার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, শিগগিরই সরকারি কর্মকমিশন পুনর্গঠন করা হবে। গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিবর্গ কমিশনে স্থান পাবেন বলে তিনি জানান।    

২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মো. সোহরাব হোসাইন সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ছিলেন। তার আমলে তিনি এক বিসিএস শেষ করতে সর্বাধিক সময়ের রেকর্ড করেছেন। ৪১তম বিসিএসের নিয়োগ কার্যক্রমে ৫ বছরেরও বেশি সময় লাগে। নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ নিয়ে তার কমিশনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। নন-ক্যাডার পদে নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগে চাকরিপ্রাথীরা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেন।  

কমিশনের অন্য সদস্যদের মধ্যে এসএম গোলাম ফারুক বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। কমিশনের সদস্য ফয়েজ আহম্মদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও এন সিদ্দিকা খানম সরকারি কর্মকমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব ছিলেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সচিবদের মধ্যে কে এম আলী আজম অবসরের পূর্বে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মো. খলিলুর রহমান ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব। কমিশনের আরেক সদস্য মো. মাকছুদুর রহমান পাটওয়ারী ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ছিলেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব পদের দায়িত্ব থেকে ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানমকে কমিশনের সদস্য করা হয়।

একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন হেলালুদ্দিন আহমদ। পরে তাকে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব করে আওয়ামী লীগ সরকার। গত বছর সাবেক এই সচিবকে পিএসসির সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।  

কমিশনের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক ড. মুবিনা খোন্দকার ও অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন ছিলেন আওয়ামী সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট। তাদের মধ্যে অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। সাংবিধানিক পদে থেকেও দেলোয়ার হোসেনের রাজনৈতিক দলের কমিটির সদস্য হওয়া নিয়ে সমালোচনায় তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কমিশনের আরেক সদস্য অধ্যাপক ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষক হিসেবে পরিচিত মুখ। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক থাকাকালে এক প্রকল্পের কেনাকাটায় ১৮০ কোটি টাকা লোপাটের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার মাত্র এক দিন আগে ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি তাকে এ গুরুতর অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরদিন ১১ জানুয়ারি তিনি পিআরএলে যান। পরে তাকে পিএসসির সদস্যপদে নিয়োগ করে সরকার। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৪তম কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামকে পিএসসির সদস্য করা হয়। সদস্য হিসেবে আরও আছেন নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক (প্রকৌশল) জাহিদুর রশিদ।

জাতীয় নাগরিক ঐক্য কমিটির সদস্য সচিব আকতার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনা বিদায় হওয়ার পরও এ দেশের সব ফ্যাসিস্টের দোসররা রয়ে গেছেন। এখনও বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, ফ্যাসিবাদীদের নানা উপাদান, নানা দোসর এখনও থেকে গেছে। বিগত সময় থেকে আমরা দেখি আসছি, পিএসসির মতো জায়গায় অনিয়ম, অন্যায় চলে আসছে। এ ছাড়া পিএসসিতে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে ৫শ, ৭শ’ এমনকি ১ হাজার টাকাও ফি দিতে হয়। একজন বেকারের জন্য এই ফি দেওয়া সম্ভব হয় না। 

তিনি আরও বলেন, আমরা সবাই সরকারকে ভ্যাট দিই। তাই আমাদের তরুণদের চাকরি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সরকারকে আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে। সব অযাচিত ফি নেওয়ার মাধ্যমে বেকারদের আর চাকরির বাজার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. রইছ উদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, সরকারি কর্মকমিশনের সংস্কার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সেই চিন্তাভাবনা আছে বলেই মনে করছি। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি দ্রুত আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close