ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

পদ পেয়েই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ‘ছাত্রলীগ নেতা’ জয়
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৬:১৫ পিএম  (ভিজিট : ৩৫৮)
সাংগঠনিক কার্যক্রম গতিশীল করতে চলতি বছরের ১৪ মার্চ ছদাহা ইউনিয়ন শাখার কমিটি ঘোষণা করে সাতকানিয়া উপজেলা ছাত্রলীগ। কিন্তু হয়েছে হিতে বিপরীত। সাংগঠনিক কার্যক্রমের গতি না বাড়লেও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন কমিটিতে সভাপতির পদ পাওয়া মিজানুর রহমান জয়। ছদাহায় ছাত্রলীগের কমিটিতে আসার পর থেকে জয়ের নেতৃত্বে ছদাহা এলাকায় সংঘবদ্ধ কিশোর গ্যাং ছিল সক্রিয়। কিশোর গ্যাং সদস্যদের মাধ্যমে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। 

জানা যায়, গত ২৮ মে দুপুরে ছদাহা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড মিঠার দোকান এলাকার জাকির স্টোরের সামনে মাহমুদুল হক নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী খুন হন। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য নিহতের ভাই এনামুল হক ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান জয় ও তার কিশোর গ্যাং সদস্যদের অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেন।

নিহত মাহমুদুল হকের বাড়ি সাতকানিয়ার ছদাহা এলাকায়। তিনি মিঠার দোকান এলাকায় স্থানীয় মাওলানা ফিশ ফিড কোম্পানিতে দিনমজুরের কাজ করতেন। ৫ বছর বয়সী এক কন্যাসন্তান রয়েছে তার। মাহমুদুল হকের বাবা ছদাহা পূর্ব আজিমপুর ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউল আলম।

জানা গেছে, দিনেদুপুরে খুনের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ গেছে পাঁচ ঘণ্টা পর, সন্ধ্যায়। তবু এমন গুরুতর ঘটনায় মামলাই নেয়নি থানার পুলিশ। খুনে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল জব্দ নিয়ে থানায় নিয়ে এলেও ঘটনার দিন রাত ১০টা পর্যন্ত স্বজনদের বসিয়ে রেখে শেষমেশ বিদায় করে দিয়েছে। পরের অন্তত দুদিন খুনের শিকার হওয়া দিনমজুরের পরিবার আকুতি জানিয়ে থানায় গেছে। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের চাপের কথা জানিয়ে মামলা নিতে রাজি হয়নি থানা। পরে শর্ত দেয়, ঘটনায় মূল অভিযুক্ত স্থানীয় ছাত্রলীগ সভাপতি জয়সহ তার অনুসারীদের নাম আসামির তালিকা থেকে বাদ দিলে মামলা নেওয়া হবে। প্রকাশ্যে খুন হওয়ার পর থেকে তার পরিবার সাতকানিয়া থানা পুলিশের কাছ থেকে পেয়েছে এমন সব নির্মম আচরণ।

অভিযোগে জানা গেছে, মাহমুদুলের স্বজনদের সাতকানিয়া থানার তৎকালীন ওসি প্রিটন সরকার এমনও বলেছেন, ‘কোর্টও আমার সঙ্গে কথা না বলে এই মামলা নেবে না।’ উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ৩ জুন চট্টগ্রামের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেছেন নিহত মাহমুদুল হকের বড় ভাই এনামুল হক (৪১)। শুনানি শেষে আদালতের বিচারক সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জকে (ওসি) ফৌজদারি অভিযোগটি সরাসরি এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। 

নৃশংস খুনের এই মামলার আসামিরা হলেন- সাতকানিয়ার ছদাহা আজিমপুর ৫ নং ওয়ার্ডের মো. সোলেমানের ছেলে মো. সাইফুল (২৪), আজিজুল হক প্রকাশ রাজা মিয়ার ছেলে আরিফুল ইসলাম সোহাগ (২৫), ফেরদৌসের ছেলে রায়হান (২২), আনিছুর রহমানের ছেলে তাসিব (২২) ও শফিকুর রহমানের ছেলে নুরুল ইসলাম (২৪), ছোট ঢেমশা ৬ নং ওয়ার্ডের মোহাম্মদ মিয়ার ছেলে ছদাহা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান জয় (২৫), একই এলাকার নুরুল আবছারের ছেলে সাকিব প্রকাশ টোকাই সাকিব (২৪) ও মাহবুবুর রহমানের ছেলে আরফিন সুলতান (২২)। এছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ১৫-২০ জনকে মামলায় আসামি করা হয়। 

জানা গেছে, ৮ জুলাই বেলা দুইটায় মাহমুদুল হক হত্যার অন্যতম অভিযুক্ত সাকিব প্রকাশ টোকাই সাকিবকে গ্রেফতার করা হয়। হত্যা মামলার আসামি এই কিশোর গ্যাং লিডারকে ছাড়িয়ে নিতে দিনভর চলে প্রভাবশালীদের তদবির।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাহমুদুল হক খুনে অভিযুক্তরা প্রকাশ্যেই এলাকায় ঘুরেছে। অংশ নিয়েছে কোটা বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের অবস্থান কর্মসূচিতেও। কিন্তু পুলিশ তাদের ধরা তো দূরের কথা, উল্টো তাদের সঙ্গে সখ্যতা রেখে চলেছে- এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর।

জানা যায়, ২৬ মে মাহমুদুল হক তার কর্মস্থল মাওলানা ফিশ ফিড থেকে নাস্তা করার জন্য আজিমপুর এলাকায় ফেরদৌসের চা দোকানে নাস্তা করতে যান। কিন্তু তার পকেটে টাকা না থাকায় দোকানদারের ছেলে রায়হানকে মাহমুদুল হক জানান, সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে যাওয়ার সময় বকেয়া ১৭ টাকা শোধ করে যাবেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা রায়হান অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে বকেয়া টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দেন। এমন অবস্থায় মাহমুদুল হক তার কর্মস্থলের ম্যানেজারের কাছ থেকে ধার নিয়ে ১৭ টাকা বকেয়া শোধ করে কাজে চলে যান। এরপরও দোকানদারের ছেলে রায়হান মোহাম্মদুলের নামে নানা ধরনের কুৎসা রটাতে থাকেন। এর কারণ জানতে চেয়ে মাহমুদুল তার বন্ধু কফিল উদ্দিনকে নিয়ে সেই চা দোকানে যান। সেখানে তখন ছদাহা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান জয় ছাড়াও স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সাইফুল ও আরিফুল ইসলাম সোহাগ উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তারা দোকানদারের ছেলে রায়হানের পক্ষ নিয়ে মাহমুদুল হকের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। তাদের মারমুখী অবস্থা দেখে মোহাম্মদুল সেখান থেকে একপর্যায়ে চলে যান। কিন্তু পরদিন ২৭ মে বিকেল চারটার দিকে ছদাহা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান জয়ের নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি সংঘবদ্ধ কিশোর গ্যাং সশস্ত্র অবস্থায় মাহমুদুলের বাড়িতে গিয়ে গালিগালাজের একপর্যায়ে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে চলে যায়।

এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২৮ মে দুপুর ২টার দিকে মাহমুদুল হক ও তার বড় ভাই এনামুল হকের শ্যালক আরিফুল ইসলাম নাস্তা করার জন্য ছদাহা মিঠার দোকান এলাকার জাকির সওদাগরের দোকানে গেলে তারা দেখেন, অন্তত সাতজন বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র প্রকাশ্যে নিয়ে সেখানে বসে আছেন। এর মধ্যে সাইফুল, রায়হান ও আরিফুল ইসলাম সোহাগের হাতে টিপ ছুরি ছিল। অন্যদিকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ছিল ছাত্রলীগ নেতা মিজানুর রহমান জয়, সাকিব প্রকাশ টোকাই সাকিব, তাসিব, নুরুল ইসলাম ও আরফিন সুলতানের হাতে। অস্ত্রগুলো দেখে মাহমুদুল হক ও আরিফুল ইসলাম দোকান ছেড়ে বের হওয়ার জন্য চাইতেই অপেক্ষমাণ সশস্ত্র কিশোর গ্যাং সদস্যরা তাদের পথরোধ করে। এর একপর্যায়ে তারা মাহমুদুল হককে ঝাপটে ধরে দোকানের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলে। এ সময় সাইফুল তার হাতে থাকা ধারালো ছুরি মাহমুদুল হকের নাভির নিচে সজোরে ঢুকিয়ে দেয়। এ সময় তার নাড়ি ভুঁড়ি কাটা অবস্থায় মাটিতে নিথর হয়ে পড়ে যান মাহমুদুল।

এরপরও তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় ছাত্রলীগ সভাপতি মিজানুর রহমান জয়, সোহাগ, রায়হান, টোকাই সাকিব, তাসিব, নুরুল ইসলাম ও আরফিন সুলতান মোহাম্মদুলের নিথর শরীরের ওপর এলোপাতাড়ি ঘুষি ও লাথি মারতে থাকেন। মাহমুদুলের গোঙানির শব্দ শুনে তার বড় ভাই সিএনজিচালক জিয়াবুল হক জিয়া ও ভাইয়ের শ্যালক আরিফুল ইসলাম তাকে বাঁচাতে গেলে টোকাই সাকিব ও তাসিব জিয়াবুলকে ঝাপটে ধরে রাখে। ওই চক্রের সদস্য আরিফুল ইসলাম সোহাগ এ সময় জিয়াবুলের পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিলে তিনিও মাটিতে পড়ে যান। এ সময় আরিফুল ইসলামকেও বেদম মারধর করে তারা। 

এদিকে ঘটনার খবর শুনে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে হত্যাকারীরা তাদের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল ফেলেই ঘটনাস্থল ছেড়ে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন আহত জিয়াবুল হক জিয়ার পরা শার্ট খুলে দুই ভাই মাহমুদুল হক ও জিয়াবুলের জখম হওয়া পেটে বেধে সাতকানিয়ার কেরানীহাটের একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। তবে গুরুতর অবস্থা দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে করে কয়েক ঘণ্টা পর চট্টগ্রাম মেডিকেলের জরুরি বিভাগে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসক মাহমুদুল হককে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত আরেক ভাই জিয়াবুলকে ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। ২৯ মে চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার একজন পুলিশ অফিসার মাহমুদুল হকের লাশের সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত শেষে লাশটি পরিবারের হাতে হস্তান্তর করেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাহমুদুল গত সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট ছিলেন। ওই নির্বাচনের পর থেকেই তিনি হত্যার হুমকি পাচ্ছিলেন বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন। মাহমুদুল হকের ভাই এনামুল হক বলেন, ‘যেহেতু সংগঠনের বিভিন্ন পদ ও দায়িত্বে ছিলাম আমরা, সে কারণে নেত্রীর নির্দেশে নৌকার পক্ষে কাজ করেছে আমাদের পরিবার। আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করা যে এতো বড় কাল হয়ে দাঁড়াবে আমরা ভাবতেও পারিনি।’

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে আত্মগোপনে থাকায় এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ছদাহা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি মিজানুর রহমান জয়ের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, হত্যা মামলার অন্যতম এ আসামি দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

সময়ের আলো/আরআই


আরও সংবাদ   বিষয়:  আ.লীগ কর্মী হত্যা-আসামি   ছাত্রলীগ নেতা-জয়   সাতকানিয়া   চট্টগ্রাম বিভাগ  




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close