ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

হাসিনা আমলের বকেয়ায় লোডশেডিংয়ে দেশ
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৭:২৫ এএম আপডেট: ১৩.০৯.২০২৪ ৭:৫৩ এএম  (ভিজিট : ৬৪৯)
গত কয়েক দিন ধরে দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি প্রকট হয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশে লোডশেডিং হচ্ছে ঘন ঘন। এমন পরিস্থিতির নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময়কার বকেয়া।

ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিল, সরকারি  ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল, গ্যাসের বিল ও ঋণের কিস্তি বাবদ বিদ্যুৎ খাতে হাসিনা সরকারের মোট বকেয়া ৭৯ হাজার কোটি টাকার বেশি।সময়মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারায় ৩০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়েছে ভারত। একই সঙ্গে দেশে বেসরকারি খাতের উৎপাদকদের বকেয়া পরিশোধ না করায় তারা প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে পারছে না। এতে তাদের পূর্ণ মাত্রার উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলে লোডশেডিং বেড়েছে। পিডিবি বলছে, ডলার সংকটের কারণেই বকেয়া পরিশোধে এই বিলম্ব।

এদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে দেওয়া ঋণের বকেয়া ও চলতি সুদ বাবদ ৬৩০ মিলিয়ন (৬৩ কোটি) মার্কিন ডলার আগামী ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিশোধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছে রাশিয়া।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে গত ৩-৪ বছরে বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া জমে ৭৯ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। এর মধ্যে আগস্ট পর্যন্ত ভারতে ৫টি কোম্পানির বকেয়া ১০৪ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে এই বকেয়ার টাকা চেয়ে ভারতীয় কোম্পানিগুলো এবং দেশীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকরা বারবার তাগাদা দিয়েছে। ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে অল্প অল্প করে বকেয়া শোধ করা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কারণে তারা সরবরাহ কমায়নি। তার পতনের পর তারা বকেয়া পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে। জ্বালানির বিল পরিশোধ করতে পারছে না বলে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে তারা। এ ছাড়া বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়াও অনেক টাকা জমে যায়। 

এই সংকট থেকে উত্তরণে হাসিনা সরকারের সময়ে ব্যাংক থেকে বন্ড ছেড়ে চাপ কিছুটা কমানো হয়। তারপরও তাদের বকেয়া বাড়ছিল। এ জন্য তাদের প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়।পূর্ণমাত্রায় বিদ্যুৎ উৎপাদন অসম্ভব হয়ে পড়ে। পিডিবিসহ বিভিন্ন কোম্পানির কাছে গ্যাস বিল বকেয়া থাকায় পেট্রোবাংলার এলএনজি আমদানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমান বিদ্যুৎ ঘাটতির পেছনে এই বাস্তবতা মূল ভূমিকা পালন করছে। 

সম্প্রতি  বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানকে অবহিত করার জন্য পিডিবি তাদের আর্থিক দায় দেনার সার্বিক চিত্র তুলে ধরে। সেখানে বলা হয়, আগস্ট পর্যন্ত তাদের বকেয়া রয়েছে ৭৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিল আগস্ট শেষে ১০৪ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এখন আদানির বাংলাদেশের কাছে বকেয়া রয়েছে ৫৪ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। বিভিন্ন গ্যাস কোম্পানি পাবে ১৫ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া ৪ হাজার ৭৪ কোটি টাকা ও আইপিপি (ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) তথা বেসরকারি খাতের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া ১১ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। এর বাইরে আইপিপিগুলো থেকে কেনা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে ৩০ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা।  পিডিবির ঋণের কিস্তি বকেয়া রয়েছে ৮২ কোটি ডলার। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সরকার যেসব ঋণ পিডিবিকে নিয়ে দিয়েছে, সেসব ঋণের কিস্তি বাবদ বকেয়া পড়েছে আরও ১৬ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এ অর্থ সরাসরি পিডিবিকে পরিশোধ করতে হয় না। পিডিবির ঋণের কিস্তি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) পরিশোধ করা হয়। আর পিডিবি ডিএসএল বাবদ সে অর্থ ইআরডিকে পরিশোধ করে। গত জুন মাসে আদানিকে সব শেষ বিল পরিশোধ করা হয়েছে।

পিডিবি সূত্র জানিয়েছে, আগে ভারত থেকে ২৬০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ আমদানি করা হতো। এখন সরবরাহ কমে ১৮শ মেগাওয়াটে ঠেকেছে। ৬শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় ১২শ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে। এসবের বিরূপ প্রভাবের কারণে লোডশেডিং হচ্ছে।

পিডিবি বলছে, তারা এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে ১২ টাকা ১৩ পয়সায়। কিন্তু বিদ্যুৎ বিক্রি করে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৭০ পয়সায়। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে ঘাটতি থাকে ৫ টাকা ৪৩ পয়সা। বিদ্যুৎ বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে জ্বালানি কেনার পয়সাও সংস্থান করা সম্ভব হয় না। এ জন্য সরকারি ভর্তুকি ছাড়া পিডিবি অচল। গত অর্থবছর পিডিবিকে ভর্তুকি বাবদ ৩৩ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার, তবে তা পুরোটা নগদ দেওয়া হয়নি। বন্ডের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা, যা সরকারের দীর্ঘমেয়াদি দায় সৃষ্টি করেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ভর্তুকি বাবদ এখনও সরকারের পিডিবির পাওনা রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ পেলে আইপিপি ও গ্যাসের বকেয়া বিল পরিশোধ করতে পারবে পিডিবি।

সূত্র জানিয়েছে, রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১২.৬৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ২০ বছরে রাশিয়াকে পরিশোধ করতে হবে ১১.৫৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছর সুদের কিস্তি বাবদ ৪ মিলিয়ন দেওয়ার কথা ছিল, দেওয়া হয়নি। এ বছরও একই পরিমাণ অর্থ শোধ করা যায়নি। মূল টাকার কিস্তি ২০২৭ সালের মার্চ মাস থেকে দিতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বৃহস্পতিবার  গণমাধ্যমে বলেছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ‘একটা চক্র গড়ে উঠেছিল’ । বিগত সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রতিষ্ঠানকে বামন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। বেসরকারি খাতসংশ্লিষ্ট, সরকারি নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের আমলা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের লোকজনকে নিয়ে চক্রটি গড়ে উঠেছিল। ফলে জাতীয় চাহিদাসম্পন্ন নীতি কখনো প্রণয়ন করা হয়নি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কোনো ব্যক্তিস্বার্থে বা কোনো গোষ্ঠীস্বার্থে। আমরা দেখতে চাই এই চক্র ভেঙে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। গ্যাস সংকটে ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে। আদানি জানিয়েছে, বকেয়া টাকা না পাওয়ায় তারা জ্বালানি বিল পরিশোধ করতে পারছে না। এ জন্য তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। খন্দকার মোকাম্মেল আরও বলেন, পিডিবির যে বকেয়া তা গত কয়েক বছরে বেড়েছে। এর কারণ হচ্ছে প্রয়োজনীয় ডলার সংকট।

বর্তমান সরকারকে বকেয়ার জন্য আগের সরকারের চেয়ে বেশি চাপ দেওয়া হচ্ছে কি না; এমন প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সময়ের আলোকে বলেন, বিষয়টি আমরা সেভাবে দেখতে চাই না। আসলে বকেয়া বাড়ছে। যতটা পারছি ততটা পরিশোধ করছি। আমরা সোনালী ব্যাংককে বলে রেখেছি আদানিকে ১০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে দিতে। 

তিনি বলেন, আদানি জানিয়েছে, তাদের কয়লা সংকটের কারণে সরবরাহ কিছুটা কম হচ্ছে। ১-২ দিনের মধ্যে কয়লা চলে আসবে বলে তারা আশা করছে। তখন সরবরাহ বাড়বে। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।

রূপপুরের বিষয়ে তিনি বলেন, রূপপুরের টাকা অ্যাকাউন্টে আছে। কিন্তু তাদের বকেয়া পরিশোধ করা যাচ্ছে না মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে।


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close