ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

অপচয় ও সংকটে আটকে আছে সম্ভাবনা
প্রকাশ: বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৫:১৫ এএম আপডেট: ১১.০৯.২০২৪ ৭:৪৭ এএম  (ভিজিট : ৩৩১)
দেশে যত পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদন হয় তার বড় একটি অংশ নষ্ট বা অপচয় হয় মাঠ থেকে খাবার টেবিল পর্যন্ত। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইউনেপের প্রকাশিত ‘ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স’ রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী-বাংলাদেশে বছরে ১ কোটি ৬ লাখ টন খাদ্যশস্য দানা নষ্ট বা অপচয় হয়। শস্যদানার মধ্যে আছে-চাল, গম, ডাল, সবজি ও ফল, বিভিন্ন প্রাণীর মাংস, ডিম ও দুধ। এসব পণ্য উৎপাদনের পর বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে নষ্ট হয়।

একইভাবে এফএওর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে উৎপাদিত শস্য দানা-চাল, গম ও ডাল এসব উৎপাদন থেকে মানুষের প্লেট পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই প্রায় ১৮ শতাংশ অপচয় হয়। ফল আর সবজির ক্ষেত্রে অপচয় হয় ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। এই তথ্যগুলো বড়ই উদ্বেগের। অথচ এসব খাদ্যশস্য নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করা গেলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা আরও সুনিশ্চিত করা যাবে এবং রফতানি আয় বাড়ানো যাবে। বিশেষ করে কৃষিপণ্য ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ পণ্য রফতানিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। কারণ বিশাল সম্ভাবনা থাকার পরও কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ পণ্যের রফতানি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এই নষ্ট-অপচয় এবং নানাবিধ সংকটের কারণে।

অথচ বাংলাদেশের শিল্প খাতের মধ্যে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প এখন অন্যতম প্রধান এবং সম্ভাবনাময় খাত। যা কর্মসংস্থান এবং মূল্য সংযোজন ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখছে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প দেশের প্রস্তুতকৃত খাদ্য উৎপাদনের প্রায় ২২ ভাগের চেয়েও বেশি এবং এই উপখাত ২০ ভাগ শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান করছে। মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে (জিডিপি) খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্পের অবদান ২ ভাগ। দেশের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প প্রকৃতিগতভাবেই আকার, প্রযুক্তি, পণ্যের গুণগতমান, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, বিপণন এবং বণ্টনের ভিত্তিতে বহুমুখী। এই খাতে প্রাথমিকভবে মূলত ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পই বেশি এবং স্থানীয় উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণের সম্ভাবনা, মূল্য সংযোজন এবং রফতানির সঙ্গে সংযুক্ত।

বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের অবদান ৮ শতাংশেরও বেশি। এ শিল্প দেশের অন্যান্য শিল্পের তুলনায় উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম। এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দেশের একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত। এ শিল্পের কৌশলগত প্রধান সুবিধা হলো, এর কাঁচামালের বিশাল প্রাপ্যতা রয়েছে। প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দিয়ে একটি শক্তিশালী ও গতিশীল খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প খাত তৈরি করা গেলে একদিকে যেমন কৃষি উৎপাদনে বৈচিত্র্য ঘটবে ও কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করা যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, এর মাধ্যমে দেশের কৃষকের আয় বৃদ্ধি করে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখতে পারবে। একই সঙ্গে কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য বিদেশে রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।’

কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ও রফতানির চিত্র : জানা যায়, দেশে বর্তমানে প্রায় এক হাজারের অধিক প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্য প্রস্তুতকারী শিল্প রয়েছে। তার মধ্যে ৯০ শতাংশই অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র। বাকি ১০ শতাংশ মাঝারি ও বড়। এর মধ্যে রফতানির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ২৫০টি কারখানা। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে মাসে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ পণ্যের রফতানি আয় বেড়েছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। পুরো অর্থবছরের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯৩ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। এর বিপরীতে ১১ মাসেই আয় হয় ৮৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। এর আগের বছর ২০২২-২৩-এ রফতানি হয়েছিল ৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ১১৬ কোটি ২১ লাখ ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ১০২ কোটি ৮১ লাখ ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি হয়েছিল ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ পণ্য রফতানি হয়েছিল ৯০ কোটি ৮১ লাখ ডলারের। বিশ্বের ১৪৫টি দেশে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ পণ্য রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু সারা বিশ্বে কৃষি ও কৃষিপণ্যের যে বিশাল বাজার রয়েছে তার যৎসামান্যই ধরতে পেরেছে বাংলাদেশ। কেননা বিশ্বে কৃষি ও কৃষিপণ্যের ১৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়নের যে বিশাল বাজার রয়েছে সেখানে বাংলাদেশ রফতানি করছে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এ ছাড়া দেশের কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের বাজার রয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের।

যেসব পণ্য রফতানি হয় : কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ পণ্য রফতানির তালিকায় আছে-চা, শাকসবজি, তামাক, ফল, মসলা, শুকনা খাবার, তৈলবীজ, পান, প্রাণী বা উদ্ভিদ থেকে পাওয়া চর্বি ও তেল, চিনি ও মিষ্টি খাবার, পানীয়, স্পিরিট ও ভিনেগার এবং তেলসহ অন্যান্য পণ্য। এ ছাড়াও আছে হিমায়িত মাছ, চিংড়ি ও অন্যান্য হিমায়িত খাদ্যপণ্য, মসলা, শুকনা ফলসহ অন্যান্য ফল। প্রধান পণ্যগুলো রফতানি করা হয় মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা : কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের সামনে অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার এ খাতকে অগ্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত করে এ খাতের জন্য রূপকল্প, অভিলক্ষ্য, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করেছে। রূপকল্পে বলা হয়েছে-

কৃষি ও কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বাংলাদেশকে এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। অভিলক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে-বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিকাশ, প্রযুক্তির ব্যবহার, ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিশ্ববাজারে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং উৎপাদন অবকাঠামো নিশ্চিত করা।

সরকার কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প উন্নয়ন নীতিমালাও করেছে। সেখানে এ খাতের লক্ষ্য নির্ধারণ করে বলা হয়েছে-২০২৬ সালের মধ্যে এই খাতে ৫ বিলিয়ন ডলারের নতুন বিনিয়োগের চেষ্টা করা হবে। একই বছরের মধ্যে এ খাতে ১ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। ২০২৬ সালের মধ্যে এই খাত থেকে জিডিপিতে অবদান তিনগুণ করা হবে। এ খাতের উন্নয়নে প্রতিটি বিভাগে কমপক্ষে একটি সক্ষমতা বৃদ্ধি সহায়ক প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।

বিশ্লেষকরা বলেন, কৃষি ও কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দেশের বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং রফতানির ভিত্তিতে নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। লাগসই প্রযুক্তি এবং উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক শিল্প উন্নয়ন করতে হলে বহুমুখী প্রতিযোগিতার মোকাবিলা করতে হবে। বাংলাদেশে বিভিন্ন গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান অনেক খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এই সেক্টরে যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে এসব থেকে পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ এবং এই সেক্টরের উন্নয়ন ঘটতে পারে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং বিকল্প প্রযুক্তির মাধ্যমে বহু ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। কেবল নতুন পণ্যের উন্নয়নই নয় বরং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, গুণগত মানের উন্নয়ন, বায়োসেপ্টি এবং প্যাকেজিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং সেই সঙ্গে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বিপণন জোরদার করার পাশাপাশি উৎপাদন পদ্ধতির ওপরেও জোর দিতে হবে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।

প্রতিবন্ধকতা : এ খাতটি মূলত কৃষি উৎপাদনের ওপরে বহুলাংশে নির্ভরশীল হওয়ায় এর কাঁচামাল মূলত কৃষিজাত পণ্য। এ কারণে এই শিল্পকে নানাবিদ চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়। এ খাতের বিকাশে এখন বড় বাধার মধ্যে আছে-রফতানির বিপরীতে নগদ সহায়তা কমে যাওয়া, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়া, প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় উপকরণ খরচ বেশি হওয়া এবং পর্যাপ্ত বন্দর সুবিধা না পাওয়া। এর সঙ্গে ইদানীংকালে যোগ হয়েছে গ্যাস সংকট, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়া, উৎসে কর বেশি নির্ধারণ, উচ্চহারের ভ্যাট-ট্যাক্স, কন্টেইনার ভাড়া বেড়ে যাওয়া।

কী বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা : কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের সামনে অপার সম্ভাবনা থাকার পর নানা বাধার কারণে সুফল মিলছে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ এগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. ইকতাদুল হক সময়ের আলোকে বলেন, ‘দেশে এখন অতি সম্ভাবনাময় কয়েকটি খাতের মধ্যে কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাত একটি। অথচ আমরা খাতটির প্রকৃত সুফল ঘরে তুলতে পারছি না। তবুও এ খাত দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যেমন বড় ভূমিকা রাখছে, তেমনি বিশ্ববাজারে পণ্য রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। দেশের বাজারেও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চাহিদা বৃদ্ধির জন্য আমাদের দেশের মানুষের খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন করা দরকার আছে। আমরা যদি সরকারের কাছ থেকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা চাই এবং দেশের মানুষ যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায় তা হলে এ খাত থেকে রফতানি আয় কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close