চার্জার লাইট আর ফ্যান বিক্রির ধুম পড়েছে স্টেডিয়াম মার্কেটে। কেনাকাটার মধ্যেও অনেককে আবার লোডশেডিংয়ের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। রাজধানীর মতিঝিলের একজন ব্যাংকার লিফটে উঠতে গিয়ে বাধা পেলেন। কারণ হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটর চললেও তিনি আর লিফটে উঠতে সাহস পেলেন না। মালিবাগের ইউসুফ প্রতিদিন সকালে গোসল করে বাইরে যান। কিন্তু পানি না থাকায় তিনি বাসার কেয়ারটেকারকে ধমক দিলেন। কেয়ারটেকারের করার কিছু ছিল না। কারণ বিদ্যুৎ না থাকায় তিনি সময়মতো টাঙ্কিতে পানি তুলতে পারেননি। এ চিত্র হচ্ছে ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে।
ঢাকা শহরে এখন প্রতিদিন তিন থেকে চারবার লোডশেডিং হচ্ছে। আর ঢাকার বাইরের চিত্র আরও ভয়াবহ। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি জেলায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে আমন খেতে সেচ দিতে পারছে না কৃষকরা। বলা যায়, সরবরাহের চেইন অনেকাংশে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
এদিকে দেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে বলে মঙ্গলবার জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বিদ্যুতের জন্য আরও দুঃসংবাদ হচ্ছে-বড় পুকুরিয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। দিনাজপুর থেকে সময়ের আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিট অচল হয়ে পড়ে। এ কারণে বন্ধ হয়ে যায় কেন্দ্রটি। সোমবার সকাল থেকেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তৃতীয় ইউনিট অচল হয়ে পড়ে। ৫২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কবে নাগাদ চালু হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ অনিশ্চয়তা ঘিরেই মানুষের মধ্যে অস্বস্তি। কারণ এ বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান প্রকৌশলী (তত্ত্বাবধায়ক) আবু বকর সিদ্দিক সময়ের আলোকে জানান, কেন্দ্রের তিনটি ইউনিটের মধ্যে ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ২ নম্বর ইউনিট চলতি বছরের শুরু থেকে নষ্ট। আবার ১২৫ ক্ষমতাসম্পন্ন ১ নম্বর ইউনিটটি ওভারহোলিংয়ের কারণে বন্ধ রয়েছে। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে গত সোমবার ২৭৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন তৃতীয় ইউনিটও বন্ধ হয়ে গেছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর ইউনিটটি চালু করা হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী চীনা কোম্পানির যন্ত্রাংশ সরবরাহ করার কথা। কিন্তু সরবরাহ না করায় ইউনিটটি চালু করা যাচ্ছে না।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গোটা দিনাজপুর অঞ্চলের বাসিন্দারা তাপপ্রবাহে কষ্ট করছেন। জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎনির্ভর চাষাবাদসহ শিল্প কলকারখানায়।
উত্তরাঞ্চলে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্র অচল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা উত্তরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। নাহিদ নামে কুড়িগ্রামের এক তরুণ জানিয়েছেন, ‘হামার তো জীবন বের হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা’। ওই এলাকার জুয়েল ইসলাম নামে আরেকজন জানিয়েছেন, কখন যে বিদ্যুৎ আসে বলা যাচ্ছে না। অর্ধেকেরও নিচে নেমেছে কুড়িগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ।
লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ মানুষ, থমকে গেছে জীবনযাত্রা। এ লোডশেডিংয়ের ফলে বাণিজ্যিক উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন জেলার চেম্বার অব কমার্সের প্রতিনিধিরা। গরমে হাঁসফাঁস করছে সাধারণ মানুষ।
রংপুরে কয়েক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি নেই। অনাবৃষ্টিতে আমন খেতে সেচ দিতে হচ্ছে কৃষকদের। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে সেচ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। কারণ সেচ প্রকল্পের বেশিরভাগ গ্রাহক পল্লী বিদ্যুতের আওতাভুক্ত। বিদ্যুৎ না থাকার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমন চাষে।
ঢাকা শহরে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাণিজ্যিক থেকে শুরু বিভিন্ন বিপণিবিতানে কেনাবেচা অনেকাংশে কমে এসেছে। একই সঙ্গে শিশুদের পড়ার সময় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার ফলে অনেক শিশু পড়াশোনা থেকে নিজেকে বিরত রাখছে। সবচেয়ে সমস্যা হচ্ছে হাসপাতালে। তবে অনেক হাসপাতালে জেনারেটর থাকার ফলে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শুধু দিনাজপুরের বড় পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন নিয়ে টানাপড়েন হচ্ছে না। সরবরাহের চেইন অনেকাংশে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। মূলত সরকারি, রেন্টাল, কুইক রেন্টালসহ ৫ ধরনের পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। সব প্লান্টে জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার ফলে বর্তমানে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
এদিকে মঙ্গলবার অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বিদ্যুতের লোডশেডিং প্রসঙ্গে বলেন, দেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে। বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে সরকার চেষ্টা করছে। এ জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জ্বালানি, কয়লা আমদানি করা হবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানা গেছে, এখন প্রতিদিন দিনের বেলায় বিদ্যুতের ১৫ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট চাহিদা রয়েছে। আর সরবরাহ করা হচ্ছে ১২ হাজার ৮৯৯ মেগাওয়াট। রাতে আরও ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং বাড়বে বলে আভাস দেওয়া হয়।
সময়ের আলো/আরএস/