রাজধানীজুড়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা। নিয়ম ও আইনের তোয়াক্কা না নিজের মতো মূল সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব বাহন। কোনো সিগন্যাল না মেনে যেখানে-সেখানে থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করছে এগুলো। এতে বাড়ছে জনভোগান্তি, সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। বিশেষ করে সরকার পতনের পর থেকে শিথিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগে অলিগলি থেকে বেরিয়ে রাজধানীর মূল সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এসব বাহন। রাজধানীর মূল সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইকের দাপট বেড়েছে। গণপরিবহনকেও ওভারটেক করতে পিছপা হয় না এসব বাহন। এ বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা হলেও কোনোভাবেই এসব বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
গতকাল সরেজমিনে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব, নিউ মার্কেট, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, ফার্মগেট, যাত্রাবাড়ী, কলাবাগন, মিরপুর, ধানমন্ডি, শ্যামলী, মহাখালী ও বাড্ডা এলাকাসহ প্রায় সব মূল সড়কে অসংখ্য ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক চলতে দেখা গেছে। এসব অটোরিকশা যখন-তখন দ্রুতগতির যানবাহনের সামনে চলে আসছে, কোথাও হঠাৎ করেই বাঁক নিচ্ছে। এতে পেছনের যানবাহনের চালকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। আবার দ্রুতগতিতে সড়কে উল্টোদিকে চলে অন্য যানবাহনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
এসব বাহন নিয়ন্ত্রণে সবশেষ গত ১৫ মে ঢাকার মূল সড়কে ব্যাটারিচালিত কোনো রিকশা চলাচল করতে পারবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। সেখানে রাজধানীর ২২টি মহাসড়ক নির্দিষ্ট করে নিষিদ্ধ করা হয়। শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, কোনোভাবেই যেন চলতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়। এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইকের কারণে ঢাকার রাস্তা অনিরাপদ হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাড়িচালক রুবেল আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে রাস্তায় অন্য গাড়ি চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এগুলো কোনো ধরনের সিগন্যাল না মেনে উল্টো দিকে ছুটে চলে। এ কারণে গণপরিবহনসহ সব ধরনের গাড়ি চলতে বাধার সম্মুখীন হয়। তাছাড়া পুলিশও এখন আগের মতো দায়িত্ব পালন করছে না। ব্যাটারিচালিত গাড়ির চালকরা এলোপাতাড়ি যাতায়াত করে। কোনো সিগন্যাল না মেনে ওভারটেক করে। আগে মেইন রোডে চলার কারণে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে জরিমানা করা হতো, ডাম্পিং করা হতো। এসব রিকশায় দিকনির্দেশনা দেওয়ার কোনো লাইট নাই। ধীরগতির কারণে পেছনের গাড়িরও গতি কমিয়ে দিতে হয়। এতে সড়কে যানজট তৈরি হয়।
একাধিক ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, আগে ট্রাফিক পুলিশ অনেক সমস্যা করত, তাই মূল সড়কে উঠত না। শুধু রাতে মূল সড়কগুলোতে চলাচল করত তারা। কিন্তু বর্তমানে অবস্থা পাল্টে গেছে। কারণ পুলিশ কিছু বলে না। আর এই সুযোগে তারা কাউকে তোয়াক্কা না করেই চলাচল করছে। মূল সড়কে নিয়ম না মেনে অন্যান্য গাড়ির সমানে যাচ্ছেন এসব চালক। এতে করে যানজট হচ্ছে বলেও স্বীকার করেন তারা। তাদের দাবি, গলির সড়কের চেয়ে মূল সড়কে বেশি ইনকাম করা যায়।
সরকার পরিবর্তনের পর থেকে ভেঙে পড়া পুলিশি ব্যবস্থার সময়ে কিছুদিন ছাত্র-জনতা নিজেদের উদ্যোগে রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। সে সময় অননুমোদিত এসব রিকশার মূল সড়কে চলাচলে বাধা দিলেও তারা ব্যর্থ হন। এরপর ধীরে ধীরে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নামলেও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে অনেকটাই বাধাহীনভাবে। এতে অদক্ষ চালকের এলোমেলো চলাচল, আইন না মানার প্রবণতা, উল্টোপথে চলা, যেখানে-সেখানে হুটহাট রিকশা ঘোরানো- সব মিলিয়ে রাজধানীতে রাস্তায় প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ঢাকার বাইরে থেকে অনেক ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক শহরে প্রবেশ করেছে। এসব চালকের কোনো ধরনের নিবন্ধন ও অভিজ্ঞতা নেই। এতে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। এগুলোকে বিআরটিএ ও সিটি করপোরেশন থেকে কোনো ধরনের অনুমতি দেওয়া হয়নি। অবৈধভাবে চলার কারণে সিগন্যাল ও নিয়মনীতি মানছে না। ট্রাফিক পুলিশের নিয়মনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা খুবই জরুরি। ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা একবার যদি মূল সড়কে চলার সুযোগ পেয়ে যায় তাহলে পরে তাদের সরানো কষ্ট হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. হাদিউজ্জামান সময়ের আলোকে বলেন, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো রাজধানীর জন্য বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বাহনের জন্য নীতিমালা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। তারা কোন কোন রুটে চলতে পারবে তা নির্ধারণ করে দিতে হবে। এসব বাহনকে প্রযুক্তিনির্ভর করার জন্য কাজ করা দরকার। আগে ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তারপর চলার অনুমতি দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার মতো ছোট শহরের মূল সড়কে এসব বাহন চলার ফলে সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। এর জন্য তিনটি নীতিমালা থাকা দরকার। প্রথমত কোন সড়কে চলবে তা ঠিক করা, দ্বিতীয়ত কীভাবে আধুনিকায়ন করা যায় তা চিন্তা করা, তৃতীয়ত এসব বাহনের ব্যাটারিগুলো যেন পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে সেদিকে লক্ষ রাখা।
স্বাধীনতার পর থেকে বিআরটিএ প্রায় ৫৪ লাখ গাড়ি নিবন্ধন দিয়েছে। বর্তমানে ব্যাটারিচালিত যানবাহন প্রায় ৫০ লাখ হবে। তাই এক বছরে এত পরিমাণ গাড়ি অনুমোদন দেওয়া সম্ভব নয়। বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে আলাদাভাবে এজেন্সি করে এসব বাহনকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তবে সবকিছু তদারকি করতে হবে বিআরটিএ-কে। ফলে অনিয়ম কমে আসবে এবং জবাবদিহির জায়গা তৈরি হবে।
যাত্রীদের ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকগুলোতে না ওঠার আহ্বান জানিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার খন্দকার নাজমুল হাসান সময়ের আলোকে বলেন, যানজট নিরসনে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। তাছাড়া এসব বাহন যেন মূল সড়কে উঠতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে যাত্রীরা যদি তাদের এড়িয়ে চলেন তাহলে কাজটি করতে সহজ হবে। এসব গাড়ির জন্যই দিন দিন যানজটের মাত্রা বেড়ে চলেছে। আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে ডাম্পিং ব্যবস্থা চালু রাখা হবে। এই সপ্তাহের মধ্যে যদি ব্যাটারিচালিত গাড়ি মূল সড়ক থেকে না সরে যায় তাহলে আগামী সপ্তাহের মধ্যে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই একটা দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারবেন।
সময়ের আলো/জিকে