সড়কে সব ধরনের যানবাহন চলছে। কিন্তু সব বাহনই আগে যেতে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। বাস থেকে শুরু করে মোটরবাইক, সিএনজি, রিকশা, টেম্পু সবাই। নতুন মাত্রায় এখন যোগ হয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা আর ইজিবাইক। কেউ কাউকে একটু পাশ কাটানোর রাস্তা দিতে চায় না। আবার বাসগুলো যেখানে-সেখানে দাঁড় করিয়ে যাত্রী তোলে। কোনো কোনো বাসের চেহারা দেখলে মনে হয়, এদের বয়স আর নেই। অর্থাৎ মেয়াদোত্তীর্ণ। নাকে-মুখে কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে দিব্যি চলে যাচ্ছে। কেউ যেন দেখার নেই।
ঢাকা শহরের চিরচেনা ছবি হচ্ছে যানজট। কোনো দিন মাত্রা ভয়াবহ, আবার কোনো দিন সহনীয় মাত্রায়। রাজধানীর মেরুল বাড্ডা ইউলুপ এলাকায় প্রতিদিনের চিত্র হচ্ছে তীব্র যানজট। সব যানবাহন স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। এ রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের দেখা পেলেও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রগতি সরণির নতুন বাজার থেকে কুড়িল বিশ্বরোড যেতে হলে অনেক সময় হাতে নিয়ে যেতে হয়। কারণ কত সময়ে যানজট কমবে তা কেউ বলতে পারে না। অথচ যানজটমুক্ত হলে পথটি ১০ মিনিটেই পৌঁছানো সম্ভব।
মালিবাগ থেকে বাংলামোটরের পথও একেবারে ১৫ মিনিটের। পাশাপাশি বাংলামোটর থেকে মালিবাগের পথও একই সময়ের। কিন্তু এখন সময়ের কোনো বালাই নেই। নীলক্ষেত থেকে হাতিরপুল আসতে কমপক্ষে আধা ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় হয়। আর ঘাটে ঘাটে সিগন্যাল। বাংলামোটরকে অনেক সময় বলা হয়ে থাকে দুর্ভোগের স্থান। সব মিলিয়ে ঢাকা শহরের এমন কোনো রাস্তা নেই যেখানে যানজট নেই। গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। টানা ছয় দিন সড়কে ছিল না ট্রাফিক পুলিশ। সে সময় প্রতিটি সড়কে দিন-রাত পুরোদমে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করেন শিক্ষার্থী। সে সময় সড়কে শৃঙ্খলার চিত্র ফুটে উঠেছিল। ছাত্রদের আগের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন আসলে সড়কে শৃঙ্খলা কী। সে সময় কোনো বাস অন্য বাসকে টপকে যেতে পারেনি। প্রত্যেককে লাইন বেঁধে সারিবদ্ধভাবে যেতে হয়েছে। একইভাবে রিকশা থেকে শুরু করে কোনো যানবাহন কোনো অনিয়ম করতে পারেনি।
এখন আবার সড়কে ট্রাফিক পুলিশ ফিরে এসেছে। কিন্তু তেমন শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। এর দায় কার? এ প্রশ্নে ট্রাফিক পুলিশের অনেক সদস্য জানিয়েছেন, প্রতিদিন যারা সড়ক ব্যবহার করছেন তারাই আসলে নিয়ম মানছেন না। উদাহরণ টেনে জানান, যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং, সড়কের পাশে হকার, উল্টোপথে যানবাহন। এ ছাড়া কোনো রাস্তা তো অর্ধেক মোটর মেরামতের জায়গা হয়ে গেছে। বিশেষ করে মগবাজার মোড় থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে গাড়ি মেরামতের অংশ হয়ে গেছে।
এদিকে একসময় ট্রাফিক পুলিশের জন্য বেশ কয়েকটি স্থানে পুলিশ বক্স ছিল। এখন আর নেই বললেই চলে। তাদের এখন একটু বসার জায়গা নেই। এক ঠা দাঁড়িয়ে ডিউটি করতে করতে অনেকের মধ্যে ক্লান্তভাব চলে আসে। এ কারণে একটানা ডিউটি করতে অনেক সময় বেগ পেতে হয়।
আবার সড়ক যারা ব্যবহার করছেন তাদের বেশিরভাগের অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশ এখন আর আগের মতো কাজ করছে না। তবে ট্রাফিকরা এ অভিযোগ মানতে রাজি নন। তারা বলেন, মূলত ট্রাফিক পুলিশের পরিবর্তনের ফলে অনেকের মনমানসিকতা এখনও ঠিক হয়নি। অনেকের মনে এখনও অজানা এক ভয় কাজ করছে, যা তারা নিজেরাও জানে না।
বিআরটিএর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আসলে ঢাকা শহরে রাস্তার তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা এত বেশি বেড়ে গেছে যে, অল্পসংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ দিয়ে মেইনটেইন করা খুব দুরুহ কাজ। আবার রাস্তায় চলাচল করছে ব্যাটারিচালিত রিকশা আর ইজিবাইক। এরা যেন নতুনভাবে আবির্ভূত হয়েছে যানজটের নতুন উপসর্গ হয়ে। কোনো ধরনের সিগন্যাল মানে না। বড় রাস্তায় তাদের চলার গতি দেখলে আশ্চর্য হতে হয়।
জানা গেছে, ঢাকায় নিবন্ধিত ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ রয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার ৪৩৬টি। এর মধ্যে ট্রাক ৮৩ হাজার ৭৮৫, পিকআপ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৪৪টি। আর কাভার্ড ভ্যান ৩৮ হাজারের কিছু বেশি। নিবন্ধনের পাশাপাশি রয়েছে অনিবন্ধিত আরও বেশি। এর পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
কয়েক দিন আগেও গুলশান-বনানী এলাকায় নির্ধারিত পোশাকে নির্দিষ্টসংখ্যক রিকশা চলাচল করত। এ রিকশা অনুমোদন দিত সিটি করপোরেশন। কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর অন্য স্থান থেকে অটোরিকশা ঢাকায় চলে আসছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে। ঢাকা শহরে সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। এ ছাড়া এখন ঢাকার বাইরে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশ থেকেও অটোরিকশা আসছে। আর যথারীতি ম্যানেজ করে চালাচ্ছে। যানজটের জন্য এটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
ঢাকা শহরে এখন মোটরবাইকের সংখ্যা কত তা অনেকেই জানে না। এমনকি বিআরটিএর কাছে সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে যারা পাঠাও কিংবা উবার চালান তারা জানান, পরিবহনের সংখ্যা এখন ২৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মোটরবাইক সড়কে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। সেগুলো যেখানে-সেখানে স্ট্যান্ড করা থাকে। আবার চালানোর সময় তারা ফুটপাথ দিয়ে চালাতেও বিন্দুমাত্র ইতঃস্তত বোধ করেন না। একটুখানি জায়গা পেলেই হলো, সেই ফাঁক দিয়েই চলে যায়। যেন উড়ন্ত পাখি।
গতকাল সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বিআরটিএ মোটরযান পরিদর্শকদের দায়িত্ব দিয়েছে। তারা সড়ক ও মহাসড়কে অপরাধ সংঘটিত হলে সেগুলোর বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
তবে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক জানান, আমাদের এ সরকারের বয়স মাত্র এক মাস অতিক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের মনোযোগ সবদিকে আছে। তবে কাজগুলো করছি অগ্রাধিকারভিত্তিতে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। আর ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার কাজটি করে সিটি করপোরেশন। এরপরও আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি।
সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আরও একটি দিন ছিল সোমবার : গতকাল রাস্তায় যেই বের হয়েছে সেই বলেছে তীব্র যানজটের কথা। এ যানজটের সূত্র ছিল রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সাত রাস্তা এলাকা। কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ছয় দফার দাবিতে সড়ক অবরোধ করে। দুপুর ১২টা থেকে শুরু হওয়া অবরোধের ফলে এর আশপাশের রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যারা সড়ক অবরোধ করেছিল তাদের অনেককে বোঝানো হলেও তারা তাদের দাবি আদায়ে অটল থাকে। পরে বিকালের দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি বিভাগের সচিবের আশ^াসের পরিপ্রেক্ষিতে অবরোধ তুলে নেয়। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে হাতিরঝিল থেকে শুরু করে মগবাজার ফ্লাইওভার, ফার্মগেট, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, শাহবাগ পর্যন্ত পুরোটাই যানজটে স্থবির হয়ে যায়। একে তো প্রচণ্ড রোদ, তারপর অসহনীয় যানজটে প্রত্যেক যাত্রীর মনে এক অস্বস্তি কাজ করে। সাত রাস্তায় ছাত্রদের অবস্থানকে ঘিরে প্রতিটি রাস্তায় এমনকি প্রতিটি ফ্লাইওভারে যানবাহন একেবারে স্থির হয়ে যায়। এখানে কোথাও ট্রাফিক ব্যবস্থা কাজ করতে পারেনি। প্রতিটি সড়ক যেন বিশৃঙ্খলে বাধা পড়ে যায়।
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মু. শের আলী এ প্রতিবেদককে জানান, সড়কে শৃঙ্খলা আনতে আমাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সে চেষ্টাই করে যাচ্ছি। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেমন ভূমিকা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন আমাদের সাধারণ নাগরিকদের সচেতনতাও।
সময়ের আলো/জিকে