ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

ওপারে প্রবেশের অপেক্ষায় অর্ধ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা
সীমান্তে হিমশিম অবস্থা
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১২:২০ এএম  (ভিজিট : ৪৩০)
মিয়ানমারে আরাকান আর্মি ও জান্তা বাহিনীর সংঘাত-সহিংসতায় মুহুর্মুহু গুলি ও বিস্ফোরণে কাঁপছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এলাকা। এরই মধ্যে ওপার থেকে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে ৯ হাজার রোহিঙ্গা। আরও অর্ধ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা ওপারের সীমান্তে অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য। এ পরিস্থিতিতে হিমশিম খাচ্ছেন খোদ সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের সদস্যরা।

বিজিবির একাধিক গোয়েন্দা সূত্র সময়ের আলোকে জানায়, মিয়ানমারঘেঁষা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকা বিশাল হওয়ায় রোহিঙ্গারা সাগরপথে ও স্থলপথে পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। অবৈধভাবে আনছে অস্ত্র ও মাদক। এসব মাদক ও অস্ত্র যাচ্ছে সরাসরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। আর এ অবৈধ অস্ত্র নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্থিরতা বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সীমান্তে বিজিবির টহল আরও জোরদার করা হয়েছে। একইভাবে সাগরেও নিরাপত্তা জোরদার করেছে কোস্ট গার্ড। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিয়মিত টহলও বৃদ্ধি করেছে বিজিবি ও কোস্ট গার্ড।

স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ‘মাঝি’দের সঙ্গে যোগাযোগ করে এরই মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে বিপুলসখ্যক রোহিঙ্গা সদস্য। রোহিঙ্গা দালালদের পাশাপাশি স্থানীয়রা জনপ্রতি ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে সঙ্গে আনছে অস্ত্র-মাদকও। গত শুক্র ও শনিবার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দালালদের সঙ্গে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে।

থেমে থেমে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ বাড়ছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে। বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে শনিবারও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে অন্তত ৫০০ রোহিঙ্গা। বিষয়টি বিজিবি স্বীকার না করলেও ক্যাম্প সূত্রে প্রবেশের বিষয়টি জানা গেছে।

গত শুক্রবার সকালের দিকে কক্সবাজারের সীমান্ত দিয়ে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। সব মিলিয়ে গত দুই সপ্তাহে উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। মিয়ানমারের মংডুর মনিপাড়া, সিকদারপাড়া ও আইরপাড়া এলাকায় অন্তত ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
উখিয়ার ক্যাম্প ১৮-এর সাবেক এক মাঝি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, শুক্র ও শনিবার নতুন করে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কাছে চাঁদাবাজির টাকা নেওয়াকে কেন্দ্র করে গোলাগুলি হয়। এ ছাড়া নতুন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আরএসও অস্ত্র ও মাদক নিয়ে আসছে। বিষয়টি আরসার সদস্যরা জানার পর তাদের সঙ্গে কয়েক দফা গোলাগুলি হয়। এ ছাড়া ক্যাম্পে আগের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা না থাকায় সন্ধ্যার পর প্রকাশ্যে চলছে অস্ত্রের মহড়া।

এদিকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের মধ্যে সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে উখিয়ার ক্যাম্প ১৮, ১৯ এবং টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে।

দুদিন আগে অনুপ্রবেশ করে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প-১-এ আশ্রয় নিয়েছেন মোহাম্মদ জাকির। তিনি জানান, স্ত্রী-সন্তানসহ পাঁচজন সীমান্তে দুদিন অপেক্ষার পর শুক্রবার কৌশলে পার হয়ে ক্যাম্পে এসেছেন আত্মীয়ের বাসায়। পরে তাদের তালিকা করে ইউএনএইচসিআরের কর্মকর্তারা।

শনিবার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ক্যাম্প-১-এর বি-ব্লকে আশ্রয় নেওয়া সাব্বির আহমেদ সময়ের আলোকে জানান, তার দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে টেকনাফের জাদিমুড়া সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। জীবন রক্ষার জন্য তারা সপরিবারে পালিয়ে এসেছেন।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, রাখাইনের মংডু টাউনশিপের বিপরীতে (পশ্চিমে) চার কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদ পেরুলেই বাংলাদেশের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলা। রাতের বেলা মংডু টাউনশিপের সুদাপাড়া, ফয়েজীপাড়া, সিকদারপাড়া ও নুরুল্লাপাড়া গ্রাম থেকে রোহিঙ্গারা নৌকা নিয়ে নাফ নদ অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে। বেশিরভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকছে জাদিমুড়া, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরের মুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া সীমান্ত এবং উপকূল দিয়ে।

টেকনাফে আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন বলেন, গত দুই সপ্তাহে শতাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে ঢুকে পড়েছে। তাদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। নতুন করে কোনো রোহিঙ্গা যেন ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে আশ্রয়শিবিরে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। অনুপ্রবেশের সময় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নাফ নদ থেকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদ ও সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।

অন্যদিকে উখিয়ার কয়েকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হঠাৎ অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। গত দুদিনে দুই রোহিঙ্গা গ্রুপের গোলাগুলিতে একজন নিহত ও অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছে। নিহত রোহিঙ্গার মরদেহ কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। রোহিঙ্গা নেতা আলি হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার ক্যাম্প-১৮-তে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে সাতজন আহত হয়। এর আগের দিন ক্যাম্প-১৫-তে আহত হয়েছে আরও আটজন। এতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি ক্যাম্পগুলোতে অস্থিরতার কারণ হচ্ছে নতুন রোহিঙ্গার আগমন।

তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে অতিরিক্ত এপিবিএন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ৮ এপিবিএন পুলিশের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মোহাম্মদ আমির জাফর। তিনি জানান, সন্ধ্যার পর থেকে এসব ক্যাম্পগুলো অধিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

এ ছাড়া কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের ২০টি পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা কৌশলে অনুপ্রবেশ করছে। সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মি ও দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে আরও কিছু বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে। আরাকান আর্মি গত ছয় মাস যুদ্ধে রাখাইনের অধিকাংশ অঞ্চল ও দেশটির সেনা ও বিজিপির ক্যাম্প, চৌকি দখলের পরে মংডু শহর দখল নিতে এখন তীব্র হামলা চালাচ্ছেন। অন্যদিকে সরকারি বাহিনীও মংডু শহর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পাল্টা হামলা অব্যাহত রেখেছে। এ সংঘাতের জেরে মংডুসহ আশপাশের গ্রামে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের প্রাণহানি ঘটছে। এর ফলে প্রাণ বাঁচাতে নতুন করে অন্তত ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা নৌকা করে নাফ নদ পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে।

মংডু থেকে দালালদের সহায়তায় টেকনাফে আসা রহিম উল্লাহ বলেন, রাখাইনে আরাকান আর্মি ও দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যেই তীব্র যুদ্ধ চলছে। কিন্তু তারা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। গ্রামের অনেক রোহিঙ্গাকে তারা হত্যা করেছে। মর্টারশেল ও বিমান হামলা চালিয়ে অনেক গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাই রাখাইনে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এমন ঘটনায় প্রাণ বাঁচাতে নৌকা করে নাফ নদ পার হয়ে টেকনাফের বড়ইতলী দিয়ে রাতে আঁধারে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি।

মংডু থেকে পালিয়ে আসা আরেকজন সৈয়দ করিম বলেন, মংডু শহরের গ্রামে যখন হামলা করেছে আরাকান আর্মি, তখন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালিয়ে এক সপ্তাহ সীমান্তের কাছে পাহাড়ে অবস্থা করেছি। আরও শত শত রোহিঙ্গা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে ছিল। পরে ক্যাম্পে পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা স্থানীয় লোকদের সহায়তা নিলে টাকা বিনিময়ে নাফ নদ পার হয়ে টেকনাফের হ্নীলা দমদমিয়া সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ঢুকে পড়েছি। এখনও মিয়ানমারের সীমান্তে হাজার হাজার মানুষ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপেক্ষা রয়েছে।




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close