ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

খুলনার সাবেক মেয়র খালেকের সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট
প্রকাশ: বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৪:৪৯ এএম  (ভিজিট : ২৮০)
সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম আর লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের নামে। বাগেরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য এবং সাবেক ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন খালেক তালুকদার। ক্ষমতাসীন দলের তিনবারের মেয়র থাকার সুবাদে কেসিসির ঠিকাদারির কাজের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি। তার আমলে বেশিরভাগ কাজ পেয়েছেন তার পছন্দের ঠিকাদাররা।

বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ পরিদর্শনে গিয়ে মান যাচাইয়ের নামে মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। গালি দিয়ে বিটুমিন খুঁড়ে আর ইট ভেঙে মানুষের চোখে সাজতেন সৎ, নিষ্ঠাবান নেতা। এসব ভিডিও ছড়িয়ে সামাজিক মাধ্যমে সততার বর্ণনা করতেন তার অনুসারীরা।

বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঝড় তুলতেন তিনি। খুলনার সাধারণ মানুষের ভাবনায় তালুকদার আবদুল খালেক একজন সৎ, নিষ্ঠাবান নেতা। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন।

একদিকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মহানগর সভাপতি হওয়ায় তার নিয়ন্ত্রণেই ছিল খুলনার সবকিছু। এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়েই তিনি অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের লোকদের কোটি কোটি টাকার মালিক বানিয়েছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আইন লঙ্ঘন করে অন্যের লাইসেন্সে নিজেই ঠিকাদারি করতেন তালুকদার আবদুল খালেক। মেসার্স হোসেন ট্রেডার্স, আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্স ও মেসার্স তাজুল ইসলাম নামের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে গত কয়েক বছরে প্রায় ৬০ কোটি টাকার কাজ করেছেন তিনি। ঠিকাদার এইচএম সেলিম হুজুর এসব কাজ দেখাশোনা করতেন। এর বাইরে ৫ শতাংশ কমিশনের ভিত্তিতে আরও প্রায় শতকোটি টাকার উন্নয়ন কাজ বড় ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করেছেন। আবার লাইসেন্স ছাড়াই পছন্দের ব্যক্তি, আওয়ামী লীগের নেতা ও কাউন্সিলরদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন কোটি কোটি টাকার কাজ। ওই কাজই বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে কিনে নিতে হতো সাধারণ ঠিকাদারদের। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের খরচের কথা বলে চার বছর দুই মাস ধরে কাজের বিলের ১ শতাংশ করে কেটে নেওয়া হয়েছে ঠিকাদারদের কাছ থেকে। বিপুল অঙ্কের সেই টাকা কোথায় খরচ হয়েছে, কেউ জানে না। এক পর্যায়ে বিষয়টি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের জানালে সেই টাকা নেওয়া বন্ধ করা হয়।

আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদে তালুকদার খালেকের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ ছিলেন নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রকৌশলীরা। তুচ্ছ কারণে তার অকথ্য ভাষায় গালাগাল থেকে নিস্তার পাননি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও। বিষয়টি নিয়ে সবার মধ্যে চাপা ক্ষোভ ছিল। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে এসব কথা বলেন, কেসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

স্থানীয় সরকার আইন, ২০০৯ (সিটি করপোরেশন)-এর ধারা ৯(২) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি মেয়র বা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়ার অথবা মেয়র বা কাউন্সিলর পদে থাকার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের কাজ সম্পাদন বা মালপত্র সরবরাহের জন্য ঠিকাদার হন। অথবা তারা এ ধরনের কাজে নিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হন বা সিটি করপোরেশনের কোনো বিষয়ে তাদের কোনো ধরনের আর্থিক স্বার্থ থাকে। কিন্তু আইন অমান্য করে ঠিকই ঠিকাদারির কাজ করেছেন তালুকদার খালেক।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঠিকাদারিই ছিল তালুকদার খালেকের মূল পেশা। ২০০৮ সালে কেসিসির মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১২ সালে প্রথমবার বয়রা কলেজের সামনে সড়ক উন্নয়নের কাজ করেন তিনি। সে কাজ দেখাশোনা করতেন ভাই জলিল তালুকদার।

২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন খালেক। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র (ওটিএম) আহ্বান হলে কেসিসির প্রকৌশলীদের নির্দেশ দিতেন, নির্দিষ্ট কাজে অন্য বড় ঠিকাদাররা কেউ যাতে দরপত্র জমা না দেয়। আর দিলেও ইজিপির ফাঁকফোকর দিয়ে কাজটি তিনি দিয়ে দিতেন হোসেন ট্রেডার্সকে। হোসেন ট্রেডার্সের নামে মেয়রের ঠিকাদারির বিষয়টি কেসিসিতে ‘ওপেন সিক্রেট’।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, হোসেন ট্রেডার্সের নামে তালুকদার আবদুল খালেক ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বিআইডিসি সড়কের একাংশ, ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে রূপসা বেড়িবাঁধ সড়ক উন্নয়ন, ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কেডি ঘোষ রোড, ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে পুরাতন যশোর রোড, ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে সিমেট্রি রোড, ৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে নিরালা এলাকার পাঁচটি সড়ক উন্নয়নসহ ১৭টি সড়কের ঠিকাদারি করেছেন।

এ ছাড়া আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্সের নামে ২ কোটি ৫১ লাখ টাকায় মুন্সিপাড়া তৃতীয় গলি, ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে গগন বাবু রোড উন্নয়ন, তাজুল ইসলামের নামে খালিশপুর পিপলস মোড় থেকে গাছতলা মোড় পর্যন্তসহ আরও চারটি কাজ করেছেন।

উন্নয়ন কাজ ইচ্ছামতো বাটোয়ারা দরপত্রে অংশ নিতে ঠিকাদারি লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। কিন্তু লাইসেন্স ছাড়াই অন্য নামে আওয়ামী লীগ নেতাদের ঠিকাদারি কাজ দিতেন তালুকদার আবদুল খালেক।

মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমডিএ বাবুল রানাকে নিরালার আটটি সড়কের ৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ও ৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে টিবি ক্রস রোড এবং বানরগাতী সড়কের কাজ দেওয়া হয়েছে। মেসার্স তাজুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ করেছেন তিনি।

বাবুল রানা বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে ঠিকাদার তাজুল ইসলাম বলেন, দলের সিনিয়র নেতা হওয়ায় আমি লাইসেন্স দিয়ে সহযোগিতা করেছি। কাজটি তিনি নিজেই করেছেন।

একইভাবে ৫ কোটি ১ লাখ টাকা ব্যয়ে খালিশপুর ১৮ নম্বর রোড উন্নয়নের কাজ দেওয়া হয়েছে খালিশপুর থানার ৯টি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে। শাহীদ এন্টারপ্রাইজের নামে দেওয়া কাজটি ২৫ লাখ টাকায় কিনে নেন তাজুল ইসলাম। ওই টাকা ৯ ওয়ার্ডের নেতারা ভাগ করে নেন।

এ বিষয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, ওই সময় কিছু করার ছিল না। টাকা দিয়ে কিনেই কাজ করতে হয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ নেতা ও ১৪ দলের কয়েকজন নেতাকে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। 

খুলনা কেসিসির নগর ভবন থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতেন রামপাল ও মোংলা বাগেরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য তালুকদার আবদুল খালেক। কেসিসি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আসনটিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তার স্ত্রী হাবিবুন নাহার। কিন্তু খালেকই রামপাল ও মোংলা উপজেলার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সভা-সমাবেশে অংশ নিতে রামপালে গেলে ব্যবহার করতেন কেসিসির গাড়ি ও তেল।নগর ভবনে বসেই ওই দুই উপজেলার সব ঠিকাদারির কাজ ভাগবাটোয়ারা, টিআর বরাদ্দ ও উন্নয়ন কাজ কীভাবে হবে তার নির্দেশ দিতেন। প্রায়ই কর্মকর্তাদের ডেকে আনতেন নগর ভবনে।

২০০৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, তালুকদার আবদুল খালেকের বার্ষিক আয় ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। তার কাছে নগদ ছিল ৫৭ হাজার ৫৫০ টাকা। সম্পদ বলতে ছিল ব্যাংকে জমা ১৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানতে ২৮ লাখ টাকা। কিন্তু গত ১৫ বছরে বহুগুণে বেড়েছে সাবেক মেয়র খালেকের সম্পদ।

২০২৩ সালের হলফনামায় দেখা গেছে, খালেকের আয় ২৮ লাখ ১৫ হাজার ৭০২ টাকা। তার কাছে নগদ টাকা আছে ৪ কোটি ৭৯ লাখ। চারটি ব্যাংকে তার জমা ১ কোটি ১৮ হাজার টাকা। এর বাইরে ৩ দশমিক ২১ একর কৃষিজমি, ৩ কাঠা অকৃষিজমি, রাজউকের পূর্বাচলে একটি, কেডিএর ময়ূরী আবাসিকে একটি ও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মুজগুন্নি আবাসিক এলাকায় প্লট রয়েছে।

মেয়রের ঠিকাদারি কাজ দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা এইচএম সেলিম হুজুর বলেন, মেয়র সাহেবের সঙ্গে শুধু ডাকবাংলো ও কাস্টমঘাট সড়কের কাজ করেছি। আমার লাইসেন্সে বিভিন্নজন কাজ করেছেন। সব কাজ মেয়র সাহেবের বলে চালানো হচ্ছে  এটি ঠিক না।

আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্সের তৌহিদুল ইসলাম আজাদ বলেন, আমাদের লাইসেন্সে অনেকেই কাজ করছেন। তবে মেয়র কোনো কাজ করেননি। ৫ শতাংশ টাকা দিয়ে কাজ কেনা দুই ঠিকাদার অর্থ লেনদেনের তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান বলেন, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।

কেসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কর তাজুল ইসলাম বলেন, দরপত্র প্রক্রিয়ায় আমার সংশ্লিষ্টতা নেই। অনেক কিছুই জানি না। তারপরও কোনো অনিয়ম হলে খুঁজে বের করে তার বিচারের ব্যবস্থা হবে।
কেসিসি ঠিকাদার জাহিদ হাসান খসরু বলেন, ইজিপি টেন্ডারে কাজ হতো। সেখানে অংশ নিলেও তালুকদার আবদুল খালেকের নির্দিষ্ট ফার্মে টিক দেওয়া থাকত। তিনি নিজেও বেনামে ঠিকাদারি কাজ করতেন। নির্দিষ্ট চার-পাঁচটি ফার্মে কাজ করতেন সাবেক কেসিসি মেয়র, এটি সবাই জানে।

খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা বলেন, আওয়ামী লীগের ১৭ বছরে নগরীতে কেউ কাক্সিক্ষত সেবা পায়নি। সাধারণ মানুষ সিটি করপোরেশনে গেলে দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছে। প্রত্যেক পর্যায়ে দলীয়করণ করেছে। এমনকি ওয়ার্ড অফিসে গিয়েও সেবা পাওয়া যায়নি।

কেসিসির সাবেক মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, ড্রেন সংস্কারের নামে রাস্তার পাশের সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। জনবান্ধব পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা হয়নি। দুর্নীতি ছিল মাত্রাহীন ও লাগামহীন। ইজিবাইকের কারণে নগরে বিশৃঙ্খলা বেড়েছে।

এসব বিষয়ে জানার জন্য খুলনার সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে কোথায় রয়েছেন, তা কেউই বলতে পারছেন না।


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close