ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

সংকটের বড় কারণ দলবাজি
প্রকাশ: রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ৪:১৮ এএম আপডেট: ০১.০৯.২০২৪ ৭:৫১ এএম  (ভিজিট : ২১৯)
শিক্ষক লাঞ্ছনা নিয়ে দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব স্তরের শিক্ষকই লাঞ্ছিত হচ্ছেন। নিজ ছাত্রের চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি কিংবা শিক্ষককে কান ধরে উঠ-বস করানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবে প্রকাশ করা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর বদলে যেতে থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্র। দলীয় মনোভাবাপন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়ে উঠে শিক্ষার্থীরা। অনেককে জোর-জবরদস্তি করে পদত্যাগ করানোর অভিযাগ ওঠে। 

জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, এত শিক্ষক লাঞ্ছনার কারণ কি?

শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবারের সংকটের বড় কারণ দলীয়করণ। এক দশকে মহান পেশা শিক্ষকতাকে চরমভাবে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে জড়িতদের হাতে প্রতিষ্ঠান তুলে দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে বসার একমাত্র যোগ্যতা হয়ে উঠেছিল ‘সরকারি দলের ক্যাডার’ হওয়া। শিক্ষকরা নিজেদের কাজকর্মের মধ্য দিয়ে নিজের সম্মানহানি করেছেন। 

তারা আরও বলছেন, ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে আরও সময় লাগবে। এ জন্য বড় ভূমিকা রাখতে হবে শিক্ষকদেরই। শিক্ষকদের পদত্যাগের নামে সারা দেশে যা হচ্ছে, যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে-সেটা সমর্থনযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম।

নিজের ফেসবুকে সমন্বয়ক সারজিস বলেছেন, শিক্ষক পদত্যাগের নামে সারা দেশে যা হচ্ছে, যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে সেটা সমর্থনযোগ্য নয়। কেউ যদি ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্য শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর সঙ্গে অন্যায় করে থাকে তা হলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আইনের মধ্য দিয়ে তদন্তসাপেক্ষে তার বিচার হোক। কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া, মব জাস্টিস করা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। 

তিনি আরও বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর যে শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক আমাদের শিক্ষার পরিবেশকে সুন্দর করে তুলতে পারে সেই সম্পর্ক যেন তিক্ততার না হয়, দূরত্বের না হয়, ভীতির না হয়। অনেক শিক্ষার্থী হয়তো জানেই না যে তাদের ব্যবহার করে অন্য শিক্ষক এই কাজটি করাচ্ছে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য। যারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে অন্যায় প্রক্রিয়ায় এই কাজগুলো করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন তিনি। 

দেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার নিয়োগে প্রধান যোগ্যতা ছিল দলের প্রতি আনুগত্য। গত সরকারের পতনের পর দলীয় আনুগত্যে এসব পদ পাওয়া শিক্ষকরা পদত্যাগ করতে শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারের সংকটের বড় কারণ দলীয়করণ। বিগত সরকারগুলোর আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ শীর্ষস্থানীয় পদে দলীয় আনুগত্য রয়েছে, এমন শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগ হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবসময় দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্র সংগঠনও এই সুযোগে ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে প্রভাব বিস্তার করেছে। এমন পরিস্থিতির ভুক্তভোগী হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এসব অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে গ্রহণযোগ্য শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বর্তমানে দেশে ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসেবে ২৭ জন উপাচার্য, ১২ জন সহ-উপাচার্য এবং ৭ জন কোষাধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে (অধিভুক্ত কলেজসহ) ৪৪ লাখের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। সরকার পতনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা প্রশাসনকে দলীয়মুক্ত করার দাবিও তুলছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে দেশের ১১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, দুটি সরকারি কলেজ ও ৬টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টিতে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সরকারি ও বেসরকারি স্কুল কলেজের অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষকের পদেও দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরাসরি রাজনৈতিক পদ-পদবি নেন। প্রতিষ্ঠানে দলীয় পরিচয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। এর সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদগুলো দলীয় নেতাকর্মীদের দখলে ছিল। তাই প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়াটা গৌণ হয়ে পড়ে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে এক নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভিসি, প্রো-ভিসি বা অন্যান্য কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন। প্রয়োজনে চ্যান্সেলর তাদের আইনানুযায়ী অপসারণ করতে পারেন। সরকারি স্কুল-কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা অন্যদের এই বিভাগ বা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) প্রয়োজনে বদলিসহ তদন্তক্রমে সরকারি কর্মচারীর জন্য প্রযোজ্য অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে স্কুল ম্যানেজিং বা গভর্নিং বডি ব্যবস্থা নিতে পারে। মাউশি কর্তৃক বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক কর্মকর্তার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে সংশ্লিষ্ট বিভাগ/ দফতর তদন্ত বা অনুসন্ধান সাপেক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলা হয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজন প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সার্বিক সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার বিষয়টি তদারকি এবং প্রয়োজনে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগকে অবহিত করার জন্য বলা হয়।

এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী ড. আশেক মাহমুদ বলেন, আশুলিয়ায় যে ছাত্র তার শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করেছে-তা আসলে আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে বিশ্বাসযোগ্য কোনো বিষয় নয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটি সংস্কৃতি ছিল-ছাত্ররা দুর্ব্যবহার কিংবা বেয়াদবি করলে তাদের ওই প্রতিষ্ঠান থেকে শুধু নোটিস নয়, টিসিও দিয়ে দেওয়া হতো, এখন তা হয় না। ফলে অনেকে বেপরোয়া হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, শিক্ষকদের ওপর ছাত্ররা চড়াও হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষমতা কাঠামোর মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তনের ফলেই এমনটা হচ্ছে। এর মানে হলো আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বনিয়ন্ত্রিত ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে থাকে তা হলে শিক্ষকদের ক্ষমতায়নও থাকে। তখন শিক্ষকরা ডিসিপ্লিন মানার জন্য শাসন করতে পারত, অভিভাবকরাও মেনে নিত। আর এখন সবকিছুর পরিবর্তন হয়ে গেছে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশে কোনো শিক্ষকের লাঞ্ছনার বিচার হয়নি। শেখ সাদি বলেছেন, ‘যে সমাজে শিক্ষক ও চিকিৎসকের সম্মান নেই; সেই সমাজ পচে গেছে।’ বাংলাদেশও পচে গেছে। শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, দেশে আইনের শাসন নেই। পরিবার নেই। দেশে মনুষ্যত্বের সামগ্রিক ধস নেমেছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের কারও বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।

শিক্ষা উপদেষ্টা গণমাধ্যমে বলেন, নতুন করে পদায়ন ও নিয়োগের কার্যক্রম চলছে। জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পেতে অসুবিধা হবে। 

তিনি আরও বলেন, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ম বিধি অনুযায়ী পদায়ন ও বদল করা হয়। তাদের বলপূর্বক পদত্যাগের সুযোগ নেই। একটি সফল অভ্যুত্থানের পর সুশৃঙ্খল সমাজে ফিরতে হবে। কাউকে ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত করা যাবে না।

শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।


সময়ের আলো/আরএস/




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close