ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

অবৈধ সম্পত্তি গড়তে বেপরোয়া ছিলেন আছাদুজ্জামান
টাকা ছাড়া চিনতেন না কাউকে
স্ত্রী-সন্তান ছাড়াও শ্যালক-শ্যালিকা, ভাগনে-ভাগনিদের নামে সম্পদ গড়েছেন,তদন্তে অনুসন্ধান কমিটি দুদকের
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৪, ৭:২০ এএম  (ভিজিট : ৮৫৪)
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার নিজ নামে, স্ত্রী আফরোজা জামান ও তিন সন্তান আসিফ শাহাদাত, আয়েশা সিদ্দিকা, আসিফ মাহাদীন এবং শ্যালক-শ্যালিকা ও ভাগনেসহ আরও অনেকের নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের তদন্ত করতে অনুসন্ধান কমিটি করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবীরকে প্রধান করে দুই সদস্যের এই কমিটির অন্য সদস্য হলেন দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আলিয়াজ হোসেন। গত ১৯ আগস্ট এই কমিটি গঠন করে দুদক। এর আগের দিন গত ১৮ আগস্ট সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তের তথ্য জানান দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন। অভিযোগ অনুসন্ধানের পর যাচাই-বাছাই ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই আছাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। টাকা ছাড়া আছাদুজ্জামান চিনতেন না প্রতিবেশীদেরও।

অভিযোগ রয়েছে, চাকরি দেওয়ার নামে অর্থ আদায়, মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে বদলি বা পদায়ন সম্পন্ন করে দিতেন। তদবির বাণিজ্য, অবৈধ উপার্জনের টাকায় স্ত্রী ও তার পরিবারের সম্পত্তির পাহাড় ও তার বেপরোয়া আচরণের কারণে অতিষ্ঠ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

দুদকের অভিযোগে বলা হয়েছে, আছাদুজ্জামান নিজ নামে, স্ত্রী আফরোজা জামান ও তিন সন্তান আসিফ শাহাদাত, আয়েশা সিদ্দিকা, আসিফ মাহাদীন এবং শ্যালক-শ্যালিকা, ভাগনেসহ আরও অনেকের নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি অপরাধলব্ধ সম্পদ গড়েছেন। আছাদুজ্জামান ও তার স্ত্রী, ছেলেমেয়েদের নামে ঢাকাসহ দেশে-বিদেশে রয়েছে সম্পদের পাহাড়। স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে ঢাকায় একটি বাড়ি ও দুটি ফ্ল্যাট এবং মেয়ের নামে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে আছাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নামে কয়েকশ শতক জমি রয়েছে। তার স্ত্রীর কোনো আয় না থাকলেও পরিবহন ব্যবসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ রয়েছে।

আছাদুজ্জামান পরিবারের অঢেল সম্পদের মধ্যে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ভাঙ্গা হাইওয়ের পাশে এবং রাজধানীর বসুন্ধরা, আফতাবনগর, মোহাম্মদপুর, জোয়ার সাহারা, সাভার ও পূর্বাচলে রয়েছে জমি, প্লট ও বাড়ির ছড়াছড়ি।

আবেদনে সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান চাকরিকালে কত টাকা বৈধ উপার্জন করেছেন প্রশ্ন তুলে সেই হিসাবও তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখানো হয়, তিনি বেতন-ভাতা বাবদ সাকুল্যে মোট আয় করেছেন প্রায় ২ কোটি টাকা। এর বাইরে পদবি অনুযায়ী পেয়েছেন আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। অথচ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক আছাদুজ্জামান পরিবারের দেশে-বিদেশে রয়েছে হাজার কোটি টাকার স্থাবর সম্পত্তি। অর্থাৎ এসব জমি, প্লট, ফ্ল্যাট, ব্যবসা অপরাধলব্ধ আয়ে গড়া।

আবেদনে বলা হয়েছে, আছাদুজ্জামান মিয়ার নামে আফতাবনগরে ৬ কাঠা, পুলিশ হাউজিংয়ে ৬ দশমিক ৯ কাঠা, পূর্বাচল ১৪ নম্বর সেক্টরে ৩ কাঠা, পূর্বাচল ৮ নম্বর সেক্টরের ১০৮ নম্বর রোডে ৫ কাঠা ও সাভারে ২ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া আছাদুজ্জামানের নামে রয়েছে ৩২২ শতাংশ জমি, ৬৮ ও ২১৫ শতাংশ জমি, ৪৯ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ৮ শতাংশ জমি আছে। এ ছাড়া ফরিদপুরের গ্রামে আছে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি।

আছাদের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাতের বয়স ৩৫ বছর। যিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার বয়স ৩১ বছর। ২১ বছর বয়সি ছোট ছেলে আসিফ মাহাদীন আমেরিকায় পড়াশোনা করেন। এই তিন ভাইবোন এই অল্প বয়সেই শতকোটি টাকার সম্পদ-সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।

স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে রয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১০ কাঠা জমির ওপর ছয় তলা বিশিষ্ট আলিশান বিশাল বাড়ি, যার বাজারমূল্য ৫০ কোটি টাকারও বেশি। এ ছাড়া তার নামে রাজধানীর ১৩/এ, ইস্কাটন গার্ডেন ও ধানমন্ডির ১২/এ সড়কের ৬৯ নম্বর বাড়িতে (বি/২/৫) ফ্ল্যাট আছে।
অভিজাত ধানমন্ডি-১২/এ-তে, ইস্কাটনে আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে ফ্ল্যাট রয়েছে। পূর্বাচলে ১০ কাঠা প্লট, মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় প্লট রয়েছে তার।

অভিযোগে বলা হয়, আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা জামান পুরোদস্তুর গৃহিণী। তার নিজস্ব কোনো আয়ের সংস্থান নেই। তবে সম্পদে পিছিয়ে নেই। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় একাধিক দামি ফ্ল্যাট, প্লট, ৫০ কোটি টাকা দামের আলিশান বাড়ি এবং গাজীপুরের কালীগঞ্জে ও নারায়ণগঞ্জে কোটি কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে তার নামে।

আফরোজার নামে রাজধানীর ধানমন্ডির ১২/এ-তে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে। আরেক দামি এলাকা ইস্কাটনেও ফ্ল্যাট আছে তার। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এল ব্লকে ১০ কাঠা জমির ওপর ছয় তলাবিশিষ্ট বিশাল বাড়িও রয়েছে।

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখোলা মৌজায় আফরোজা জামানের নামে ৪১ শতাংশ জমি রয়েছে। একই মৌজায় তার নামে রয়েছে আরও ২৬ শতাংশ জমি। একই মৌজায় তার নামে ২০১৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কেনা হয় আরও ৩৯ শতাংশ জমি। এ ছাড়া জোয়ার সাহারা মৌজায় ৫ কাঠা জমি, একই মৌজায় আরও ১০ কাঠা জমি, একই মৌজায় আরও ৩৯ শতক জমি রয়েছে তার। এ ছাড়াও আফরোজা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কৈয়ামসাইর-কায়েতপাড়া মৌজায় দশমিক ২৮ একর, একই মৌজায় আরও ৩২ শতক জমির মালিক। ঢাকার বাইরে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে আফরোজা জামানের যে বিপুল পরিমাণ জমি কেবল সেগুলোর বর্তমান বাজারমূল্যই শত শত কোটি টাকা। অথচ তার মতো একজন গৃহিণীর পক্ষে এত জমি কেনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

এ ছাড়া শেপিয়ার্ড কনসোর্টিয়াম লিমিটেড নামের আরেকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান আফরোজা জামান। অথচ তিনি একজন আগাগোড়া গৃহবধূ, যার কোনো নিজস্ব পেশা ছিল না। এই কোম্পানির পরিচালক আছাদুজ্জামানের বড় ছেলে আসিফ শাহাদাত।

মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকার নামে রাজধানীর ৫৬/৫৭, সিদ্ধেশ^রী রোডে ৩ নম্বর বিল্ডিংয়ে ৪ হাজার বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট আছে। এ ছাড়া তার নামে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় প্লট আছে। ২০২১ সালে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা সাদাও করেছেন তিনি, যখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর।
ছোট ছেলে আসিফ মাহাদীনের নামে নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকার ৮/এ রোডের ৬ নম্বর ট্রিপ্লেক্স বৈশিষ্টের একটি বাড়ি রয়েছে। এর বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকারও বেশি। এ ছাড়া আফতাবনগরেও তার নামে ৫ কাঠার প্লট আছে। এ ছাড়া আছাদুজ্জামান মিয়া গাজীপুরের শ্রীপুরে দেড় একর জমির মালিক। ভাগনে ইব্রাহিম শেখ ওরফে কলম ও শ্যালক নূর আলম ওরফে মিলনের নামে কেনা হলেও তারা কার্যত বেকার অর্থাৎ তাদের কোনো আয় নেই।

আবেদনে আরও বলা হয়েছে, আছাদুজ্জামানের শ্যালক-শ্যালিকার নামেও রয়েছে সম্পত্তির ছড়াছড়ি। তাদের নামেও কোটি কোটি টাকার জমি রয়েছে। শ্যালিকা ফাতেমাতুজ্জোহরার নামে ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট, খুলনায় বাড়ি এবং মোহাম্মদপুরে একাধিক জমি রয়েছে। পরিবহন ব্যবসাও রয়েছে তার।

আছাদুজ্জামানের স্ত্রীর সৎভাই হারিচুর রহমান সোহানের নামেও পরিবহন ব্যবসা আছে। এ ছাড়া তিনি নিজেকে পিওর গোল্ড লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়েছেন। শ্যালকের এসব ব্যবসায় আছাদুজ্জামানই বিনিয়োগকারী বলে আবেদনে বলা হয়েছে।

সোহানের নামে রাজধানীর অভিজাত এলাকা বেইলি রোড, শাহজাহানপুরে ফ্ল্যাট রয়েছে। বনশ্রী ও আফতাবনগরে একাধিক প্লট রয়েছে। এর মধ্যে বনশ্রীর একটি প্লটে বাড়ির নির্মাণকাজও চলছে। আছাদুজ্জামান মিয়ার অবৈধ টাকা দিয়ে এসব সম্পদ গড়া হয়েছে।

এ ছাড়া চলতি বছরের ১৫ মে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা পৌরসভায় তারা মিয়া নামে এক ব্যবসায়ীর ছেলের কাছ থেকে ৩০ শতাংশ জমি কেনা হয়েছে সোহানের নামে। ৩ কোটি টাকা দিয়ে ওই জমি মূলত আছাদুজ্জামানই কিনেছেন শ্যালক সোহানের নামে। আছাদুজ্জামানের বাবার সুনির্দষ্ট কোনো পেশা ছিল না। তবে গ্রামে সামান্য কিছু জমিজমা ছিল। সেসব দিয়ে তাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ হতো। অর্থাৎ বিপুল পরিমাণ জমিজমার মালিক বা অর্থ-বিত্তশালী অবস্থা তাদের ছিল না।

আছাদুজ্জামান মিয়া ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ডিএমপি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তাকে জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।

অভিযোগ রয়েছে, ডিএমপি ছেড়ে গেলেও সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান এখনও সেখানকার স্টিকারযুক্ত গাড়ি ব্যবহার করেন। গত সংসদ নির্বাচনে তিনি তার পূর্বের পেশাগত পরিচয় খাটিয়ে প্রভাব বিস্তার করেন।


সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close