ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

বন্যা নিয়ে পুরোনো ভিডিও-গুজবে সয়লাব সামাজিকমাধ্যম
প্রকাশ: রবিবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৪, ৫:২০ এএম আপডেট: ২৫.০৮.২০২৪ ৮:০৩ এএম  (ভিজিট : ৭৬১)
দেশের চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য ফেক ছবি ও ভিডিও কন্টেট। এমনকি বিভিন্ন দেশের বন্যার ভিডিও চলমান বলে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বাচ-বিচার ছাড়াই এসব কন্টেট লাইক কমেন্ট ও শেয়ার করছেন অনেকেই।

ফলে সামাজিকমাধ্যমগুলোতে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে গুজব ও অপতথ্য। আর এসব কারণে আড়াল হয়ে যাচ্ছে বন্যার প্রকৃত চিত্র। ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার তৎপরতা। সেই সঙ্গে বাড়ছে সাইবার উত্তেজনা। বন্যা শুরুর পর ৪০টি গুজব ছড়িয়েছে ফেসবুকে। এর মধ্যে ১৯টি ভিডিও এবং ১৯টি ছবি ও দুটি তথ্যকেন্দ্রিক গুজব। সবচেয়ে বেশি ছড়ানো হয়েছে ছবি এবং ভিডিওকেন্দ্রিক (সাড়ে ৪৭ শতাংশ করে) ভুয়া এবং অপতথ্য।

ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরা ও গোমতী জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। ফলে বুধবার (২১ আগস্ট) স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত বাঁধের তিনটি গেটের মধ্যে একটি খুলে দেওয়া হয়েছে। ত্রিপুরার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হাওড়া নদী বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়, ধলাই নদী মৌলভীবাজারে, মুহুরী নদী ফেনী জেলায় এবং খোয়াই নদী সিলেটে প্রবেশ করেছে। ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরামে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। এরপর নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লাসহ দেশের ১২টি জেলায় বন্যা প্লাবিত হয়। পরিস্থিতি ভয়ানক আকার ধারণ করে। শুরু হয় উদ্ধার তৎতপরতা। বন্যার পানি বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকে কিছু ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যার কিছু সত্য কিছু মিথ্যা। যেগুলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট বা এআই দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। খালি চোখে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই কোনটা আসল আর কোনটা নকল।

এমনই একটি ছবি ছড়িয়ে পড়ে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে। ছবিটিতে দেখা যায় ছোট্ট একটি শিশু গলা-সমান পানিতে ডুবে আছে। এটিকে ফেনীর বন্যার ছবি বলে প্রচার করা হয়। দ্রুতই ওই ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে ফেসবুকে ক্যাপশন দিয়ে লিখেছেন-‘রাতের ঘুম নষ্ট করার জন্য এমন একটি ছবিই যথেষ্ট।’ ছবিটি অনেকে প্রোফাইল পিকচার দিয়েছেন। তবে সারা দেশের মানুষকে রাতভর কাঁদানো ছবিটির আলোর প্রতিফলন, শিশুটির চোখের অভিব্যক্তি, কপালের ভাঁজ ও ঠোঁটের অস্বাভাবিকতা ইত্যাদি অসংগতি অনুযায়ী আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই ভাইরাল ছবিটিকে এআই জেনারেটেড বলেই ধারণা করেছেন। তাছাড়া ছবি যাচাইয়ের বিভিন্ন ওয়েবসাইটও ছবিটিকে ৬০ থেকে ৯১ শতাংশ পর্যন্ত এআই বলে ফলাফল দিয়েছে। ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের বিশ্লেষণে ভাইরাল ছবিটি এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এটি জানার পর অনেকে লিখেছেন-‘এই ছবিটি ভুয়া হলেও বাস্তব চিত্র এরচেয়েও ভয়াবহ।’

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বন্যার স্রোতে অনেকগুলো গবাদি পশু ভেসে যাচ্ছে। কেউ একজন চিৎকার করে দড়ি ধরার জন্য বলছে। বিভিন্ন পেজ থেকে ভিডিওটি শেয়ার দিয়ে লিখেছে-‘ফেনীতে বন্যায় ভেসে যাচ্ছে গরু, ছাগল ও পশুপাখি’। তবে রিউমার স্ক্যানারের দাবি ভিডিওটি এ দেশের নয়। এটি ২০২০ সালের মেক্সিকোর একটি পুরোনো ভিডিও। যা ফেনীর বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যমুনা টিভির একটি ফটোকার্ড তৈরি করে লেখা হয়-‘ফেনিতে বন্যায় বাচ্চাসহ ৪২৮ জনের মৃত্যু, নোয়াখালীতে ৩৮৫ জনের মৃত্যু, কুমিল্লায় ১০৩ জনের মৃত্যু। এটি শেয়ার করে অনেকেই ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন লিখে পোস্ট করেছেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যমুনা টিভি এমন কোনো সংবাদ বা ফটোকার্ড প্রকাশ করেনি। যমুনা টিভির নামে তৈরি একটি ভুয়া ফেসবুক পেজ থেকে এই ফটোকার্ড প্রচার করা হয়েছে। প্রচেষ্টা ফাউন্ডেশনের পেজে ত্রাণের একটি ছবি পোস্ট করেন তারা। সেটি ছাত্রলীগের ত্রাণ উদ্যোগ বলে প্রচার করা হয়। 

বন্যায় অনেক এলাকার মসজিদ এখনও পানির নিচে বলে মুসল্লিদের একটি ছবি শেয়ার করা হয়। এমন দৃশ্যও গণমাধ্যমের ভিডিওতে এসেছে। তবে এই ছবিটি এই বন্যার কোনো ছবি নয়। এটি ২০২১ সালের ৮ অক্টোবর (সেদিনও শুক্রবার ছিল) সাতক্ষীরার একটি ছবি বলে জানা যায়।

পাতিলের ভেতরে একটি শিশুর ছবি শেয়ার করে বলা হয় শিশুটির বুড়িচংয়ের খারাতাই থেকে তোলা। তারা বাবা-মার নিখোঁজ তবে ফ্যাক্ট চেকিংয়ে জানা যায়, ছবিটির ফটোগ্রাফার নাজমুল হাসান তপন জানিয়েছেন, বাচ্চা ও তার পরিবার সুস্থ আছেন।

এরকম অসংখ্য গুজব ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শনিবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৪০টি গুজব ছড়িয়েছে ফেসবুকে। এর মধ্যে ১৯টি ভিডিও এবং ১৯টি ছবি ও দুটি তথ্যকেন্দ্রিক গুজব। সবচেয়ে বেশি ছড়ানো হয়েছে ছবি এবং ভিডিওকেন্দ্রিক (সাড়ে ৪৭ শতাংশ করে) ভুয়া এবং অপতথ্য। পুরোনো ছবিকে বর্তমানের দাবি করে ৯টি বিষয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া পুরোনো বা ভিন্ন দেশের ভিডিওকে বর্তমানের বন্যার চিত্র দাবি করে ছড়ানো হয়েছে ১৫টি বিষয়ে। ভিন্ন দেশের সাম্প্রতিক ভিডিওকে বাংলাদেশের দাবি করে ১টি ও আসল ছবিকে সম্পাদিত দাবি করে ১টি, ভুয়া তথ্য ২টি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি ছবি-ভিডিওকে বাস্তব দাবি ২টি ও গণমাধ্যমের নামে নকল ফটোকার্ডে অপপ্রচার ৩টি বিষয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে ফেসবুকে। এ ছাড়া গণমাধ্যমেও চারটি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে বলে দাবি করেছে রিউমার স্ক্যানার। তারা বলছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের পক্ষ থেকে ছড়ানো হয়েছে এমন ১০টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে তারা। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকেই প্রচার করা হয়েছে ৬টি অপতথ্য। এসব অপতথ্যের মধ্যে ভিন্ন সংগঠনের সাম্প্রতিক সাতটি উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রমকে নিজেদের বলে দাবি করেছে আওয়ামী লীগ। দলটির পুরোনো কার্যক্রমের ছবিকে সাম্প্রতিক দাবি করেছে ১টি, ভিন্ন ঘটনার পুরোনো ছবিকে বর্তমানের দাবি ১টি ও ১টি ভুয়া তথ্যের প্রচার করেছে দলটি।

রিউমার স্ক্যানার বাংলাদেশের সিনিয়র ফ্যাক্টচেকার তানভীর মাহতাব আবীর সময়ের আলোকে বলেন, বন্যার এই সংকটের মুহূর্তে অপতথ্য প্রচারের ভয়াবহতা উদ্ধারকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ রাখে, ধরুন, সামাজিক মাধ্যমে কোনো একটি এলাকায় বন্যা কবলিত সময়ের পুরোনো ভিডিও (যাতে হয়তো কারও উদ্ধারের আকুতি জানানোর দৃশ্য রয়েছে) বর্তমানে প্রচার হওয়া দেখে কোনো উদ্ধারকারী দল যদি সেখানে গিয়ে দেখে যে, ওখানে উদ্ধার করার মতো কেউ নেই, তা হলে তাদের শ্রম এবং সময় দুটোই নষ্ট হবে। এ ক্ষেত্রে তাই পুরোনো ভিডিও এবং ছবি প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে। রিউমার স্ক্যানার মনে করে, এ ক্ষেত্রে গণসচেতনতায় সরকার এবং গণমাধ্যম দুই পক্ষেরই কাজ করার সুযোগ আছে। 

সিগমাইন্ড এআইর ফাউন্ডার অ্যান্ড সিইও আবু আনাস শুভম সময়ের আলোকে বলেন, জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তি দিয়ে ডিপফেক ভিডিও তৈরি করা যায়। দিনকে দিন ডিপফেক আরও নিখুঁত হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে এটা চেনা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। তারপরও অনলাইনে কিছু সফটওয়্যার বা টুলস রয়েছে এগুলোর মাধ্যমে ডিপফেক যাচাই করা যায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে এই যাচাইয়ে তারা যাবে না, যা দেখবে তারা তাই বিশ্বাস করবে। এ কারণে এটা অ্যালার্মিং মনে হচ্ছে। একটু প্রযুক্তি জ্ঞান থাকলে যে কোনো ব্যক্তি এই ভিডিও তৈরি করতে পারে, এটা আরও বেশি অশনিসংকেত। এসব ভিডিও কোনো দেশে তৈরি হচ্ছে সেটি দেখে বলা মুশকিল। ২০১৮ সালের পর থেকে দেশে এ প্রযুক্তি পপুলার হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের সময় বিভিন্ন প্রচারণায় এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। এটা প্রযুক্তির অপব্যবহার বলা যায়।



সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close