৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের অবস্থা কেমন? প্রশ্নটা সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। ১৫ বছরের জঞ্জাল তো আর দুয়েক দিনে সাফ করা যাবে না। কিছুটা সময় তো লাগবেই। হয়তো অনেক পরিবর্তনই হবে। হয়তো আগাপাছতলাই বদলে যাবে বাংলাদেশ। আমরা দেখতে পাব নতুন এক বাংলাদেশ, যে দেশের স্বপ্ন দেখছে আমাদের নতুন প্রজন্ম।
সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ঘুষ, রাহাজানিমুক্ত এক বাংলাদেশ আমাদের সবার কাম্য। দুবেলা দুমুঠো ডাল-ভাত শান্তিতে খেতে পারলেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ খুশি। এ দেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতি, অর্থনীতি ও কূটনীতির অতসব মারপ্যাঁচ বুঝে না। তারা চিনে সহজ-সরল জীবনযাপন। জীবনের সব জটিলতা, কুটিলতা দূর হলেই মানুষ খুশি। তারা কোনো অন্য কোনো নামে বানানো কোনো টর্চার সেল দেখতে চায় না। খেয়ে-পরে মনের কথা নির্ভয়ে বলে জীবনটা কাটাতে পারলেই চলে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকায় বিদেশি বিভিন্ন মিশনের রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সম্প্রতি বলেছেন, এমন একটি সময়ে এসে দেশের দায়িত্ব নিয়েছি, যখন প্রায় সবক্ষেত্রেই চরম বিশৃঙ্খলা। তাই নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করবে।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে এ কথা পরিষ্কার যে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। গত ১৫ বছর ধরে মানুষ যে রকম নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে, আশা করা যায় সে রকম নির্বাচন হবে। মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে অন্তত নিজের ভোটটা পছন্দমতো প্রার্থীকে দিতে পারবে। দীর্ঘদিন ধরে ভোটাধিকারের বাইরে থেকে বাংলাদেশের নাগরিকরা ভোট দানের কথা বলা যায় ভুলেই গেছে। কেন্দ্র থেকে ভোট না দিয়ে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা কম-বেশি আমাদের সবারই আছে। মনের যন্ত্রণা মনে নিয়ে ভোট না দিয়ে ফিরে আসার সেই দুঃসহ বেদনা মানুষ আজও ভুলতে পারছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার যদি মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে পারে তা হলেই সবাই খুশি। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের চাহিদা খুব বেশি না। তারা শান্তিতে তিনবেলা পেটপুরে খেয়ে নিশ্চিন্ত ঘুমাতে পারলেই আনন্দিত। আশা করা যায় বর্তমান সরকার বাংলাদেশের মানুষের এই চাহিদাটি পূরণ করতে পারবে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যদি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি উন্নত হয় তা হলে একটা দেশ তরতর করে চলে। বিষয় দুটোই বেশ চ্যালেঞ্জিং। এই চ্যালেঞ্জ অবশ্যই নিতে হবে বর্তমান সরকারকে।
বিগত সরকার যেসব ভুল করেছে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে যেসব অমার্জনীয় আচরণ করেছে। এ রকম দৃশ্য মানুষ কল্পনাও করতে চায় না। বিষয়টি মাথায় রেখেই বর্তমান সরকারকে পা ফেলতে হবে। অবশ্য এই সরকার তাই করছে। বেশ ভেবেচিন্তে নিচ্ছে প্রতিটি পদক্ষেপ। প্রাথমিকভাবে তারা সমস্যা চিহ্নিত করছে। পরে এক এক করে সমাধান করবে। সব সমস্যার সমাধান একসঙ্গে করা যাবে না। দীর্ঘদিনের জমানো সংকট থেকে এক নিমিষেই উত্তরণ ঘটানো যাবে না। ধীরে ধীরে করতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অনেক ব্যাপার আছে। একটা রাজনৈতিক সরকার হুটহাট এটা-সেটা করে ফেলতে পারে। রাজনীতির বাইরের সরকার তা পারে না। তা ছাড়া যেকোনো কিছু ভেবেচিন্তে করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
গত সরকারের পতনের পেছনে কী কী কারণ ছিল বা আছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে পথ চলতে পারলেই বিপদ কম হবে। অনেকটা পুলসেরাত পুল পার হওয়ার মতো। একটু পা ফসকালেই সব শেষ।
ইতিমধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি বেশ জটিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংস্কার আগে করতে হবে আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরে করতে হবে বা কোনো সংস্কার বেশি জরুরি তা চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। সেই কঠিন কাজটিই করছে বর্তমান সরকার। খুব মেপে মেপে পা ফেলে করতে হচ্ছে কাজটি। সেই ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। একটা ভুল হয়ে গেলে সে ভুল শুধরানোর জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বেশ আশাবাদী। তারা আশায় বুক বেঁধে আছে। দীর্ঘদিনের জগদ্দল পাথরের চাপা থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে। সামনে আরও আরামদায়ক নিশ্বাস নেওয়ার জন্য দিন গুনছে। নিশ্চয় তারা নিরাশ হবে না।
দীর্ঘ ১৫ বছরের জঞ্জাল সাফ করতে অনেক সময় লাগবে। সেই সময়টা অন্তর্বর্তী সরকারকে দিতে হবে। মানুষ সে সময়টা দিতে মানসিকভাবে তৈরি আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারটা ঠিক এখনই বোঝা যাচ্ছে না। তবে বেশি তাড়াহুড়ো করলে ফলাফল আশানুরূপ না হওয়ার আশঙ্কা আছে।
দীর্ঘদিন মানুষ নির্বাচনের বাইরে থাকার কারণে ‘নির্বাচনি পরিবেশ’ শব্দটা থেকে বিচ্ছিন্ন। আগে এই শব্দটার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মানুষ যেন নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর নির্বাচন। অতসব কাজ করার জন্য দুই-তিন মাস কোনো সময় না। অন্তত তিন-চার বছর লাগবে। সে সময় পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
বাংলাদেশের কল্যাণ যারা কামনা করে তারা অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করবে। কারণ তারা জানে সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। সময়ের আগেও করা যায় না পরেও না। উভয় বিষয় মাথায় রেখেই অন্তর্বর্তী সরকারকে পথ চলতে হবে।
বিগত সরকারের যারা দেশটাকে অন্তঃসার শূন্য করেছে তাদের যেমন শাস্তির আওতায় আনতে হবে তেমনি সাধারণ নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়টা চিন্তা করতে হবে বর্তমান সরকারকে।
একটা কাজ করতে গিয়ে যেন আরেক কাজের প্রতি অবহেলা না করা হয় সে বিষয়টি লক্ষ রাখতে হবে।
‘সিন্ডিকেট’ আর ‘চাঁদাবাজি’ নামক যে শব্দ দুটির কারণে মানুষের জীবন কালা কালা সে শব্দগুলো বাংলাদেশ থেকে চিরতরে নির্মূল করতে পারলেই কেবল দেশের মানুষ শান্তি-স্বস্তি পাবে। বলা হচ্ছে সিন্ডিকেট আর চাঁদাবাজির যারা হোতা তাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। যদি তাই হয় তা হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে সে আশা মানুষ করতেই পারে।
বিগত সরকার বাংলাদেশের মানুষের প্রতি একটা বড় অবিচার করেছিল। নিজের মতো করে গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ করে মানুষের জীবন তছনছ করে দিয়েছিল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাসের সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ টাকা করে ছিলেন। কয়েক দিন পরেই সর্বনিম্ন ভাড়া দশ টাকা হয়ে যায়। এখনও তা বহাল আছে। মানে একজন মানুষ বাসে উঠে একশ গজ দূর নেমে গেলেই দশ টাকা ভাড়া দিতে হয়।
পৃথিবীর অনেক দেশে সর্বনিম্ন ভাড়া আছে, তা হলো কিলোমিটারপ্রতি। আমাদের পাশের দেশ ভারতে প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া চল্লিশ পয়সা বা কম-বেশি। সর্বনিম্ন ভাড়া দশ টাকা করার কারণে সবরকম পরিবহন ভাড়ায় প্রচণ্ড বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। কৃষক যে আলু বা টমেটো প্রতি কেজি বিক্রি করে মাত্র দশ টাকায় তা রাজধানী ঢাকায় বিক্রি হয় একশ টাকায়। এর মূল কারণ পরিবহনের অস্বাভাবিক ভাড়া আর ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি।
সর্বনিম্ন ভাড়ার অপশন তুলে দিলে জনমনে শান্তি-স্বস্তি ফিরে আসবে। পরিবহনের সিন্ডিকেট ভেঙে দিলে মানুষ বড় একটা অনিয়ম থেকে মুক্তি পাবে। জীবনের অর্ধেক পেরেশানি কমে যাবে। কৃষক যে আলু দশ টাকায় বিক্রি করে শহরের মানুষ সে আলু বড়জোর পনের টাকায় ক্রয় করতে পারবে। একটা মাত্র সমস্যার কারণে শতটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এই সর্বনিম্ন ভাড়ার অপশন তুলে দিলে মানুষের শত সমস্যার সমাধান হবে রাতারাতি। বর্তমান সরকারের কাছে মানুষ এই দাবিটি তালিকার শীর্ষে রেখে উপস্থাপন করতেই পারে।
বাংলাদেশের মানুষ বেশ আশাবাদী। অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয় তাদের হতাশ করবে না। মানুষ দীর্ঘদিন পর তাদের মন খুলে কথা বলার অধিকার ফিরে পেয়েছে। আশা করা যায় এবার তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিও আসবে।
সাংবাদিক ও লেখক
সময়ের আলো/আরএস/