ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

সাত মাসে ৬০০ কোটি টাকার সার উৎপাদন ব্যাহত
প্রকাশ: বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০২৪, ১:৫৪ এএম  (ভিজিট : ৩৩২)
সিইউএফএল (চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড) বন্ধের ৭ মাস পার হতে চলেছে। গ্যাস সংকটে চলতি বছরের গত ৭ ফেব্রুয়ারি কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে দৈনিক সাড়ে ১ হাজার ১০০ টন থেকে ১ হাজার ২০০ টন সার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সিইউএফএলের প্রতি টন সার ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয় সরকারের কাছে।  সে হিসাবে দৈনিক ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকার সার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ৭ মাসে অন্তত ৬০০ কোটি টাকার সার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।  

অথচ এই কারখানার পাশে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে (কাফকো) গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। চলছে পুরোদমে উৎপাদন। অভিযোগ রয়েছে এরশাদ সরকারের আমলে একটি অসম চুক্তির মাধ্যমে কাফকোর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এর উৎপাদনসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই চুক্তির কারণে কম দামে উৎপাদনের সার কারখানা বন্ধ রেখে বেশি দামের সার উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়েছে। কাফকোর প্রতি টন সার কিনছে সিইউএফএলের দ্বিগুণেরও বেশি ৬০ হাজার টাকা করে। সর্বশেষ সিইউএফএলের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে চলতি আগস্টের শেষ দিকে গ্যাস সরবরাহের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তাও সামিটের এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু করা হলে। অন্যথায় গ্যাস সরবরাহের কোনো সুযোগ নেই। সামিটের গ্যাস সরবরাহ না পেলে সিইউএফএল চালুর আর কোনো সম্ভাবনা থাকবে না বলে মনে করেন কারখানাটির কর্মকর্র্তা-কর্মচারীরা।

সিইউএফএল দীর্ঘ সময় বন্ধের কারণে সার উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান। 

তিনি সময়ের আলোকে বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে বন্ধ আছে কারখানা। একটা কারখানা দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে শুধু উৎপাদন বন্ধ থাকা নয়, এক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর ওপর একটা মানসিক চাপও পড়ছে। কারখানার যন্ত্র সচল থাকলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মন ভালো থাকে। এখন বন্ধ থাকায় সুনসান নীরবতায় যান্ত্রিক কোনো শব্দ নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যস্ততাও নেই।

সিইউএফএলে সার উৎপাদনে ব্যয় কম জানিয়ে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রতি টন সার ৬০ হাজার টাকায় কিনতে হয়। আর আমরা উৎপাদন করে সরকারের কাছে বিক্রি করি বা সরবরাহ করি প্রতি টন ২৫ হাজার টাকায়। পাশে চালু থাকা কাফকো থেকে উৎপাদন করা সার কিনতে হয় আন্তর্জাতিক রেটে। এই কারখানায় গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে উৎপাদনও সচল থাকবে। তাতে সারের ঘাটতি হবে না। 

কারখানার উৎপাদন বিভাগের প্রধান উত্তম চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, গ্যাস সংকটের কারণে চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে সিইউএফএল। দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে মেশিনারিজের কিছু ক্ষতি হয়। তবে আমরা ক্ষতি এড়াতে নানা ধরনের কারিগরি কাজ করে থাকি। তাতে বন্ধের কারণে বড় ধরনের ক্ষতি হয় না।

দৈনিক কত উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে-এ প্রশ্নে তিনি বলেন, সিইউএফএলের ডিজাইন যেভাবে করা হয়েছে তাতে দৈনিক ১ হাজার ৭০০ টন সার উৎপাদনের ক্ষমতা আছে। কিন্তু সিইউএফএল এখন পুরোনো হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা নেমে এসেছে দৈনিক ১ হাজার ১০০ টন থেকে ১ হাজার ২০০ টনে।আমরা উৎপাদন করা প্রতি টন সার বিক্রি করি ২৫ হাজার টাকা করে। যা আন্তর্জাতিক বাজার এমনকি পাশাপাশি কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি (কাফকো) থেকে অনেক কম। আমরা আশা করছি চলতি মাসের শেষের দিকে সামিটের এলএনজি সরবরাহ শুরু হবে। তখন আবার কারখানা চালু হবে এবং সার উৎপাদন করতে পারব।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) পরিচালক (উৎপাদন ও গবেষণা) মোহাম্মদ শাহীন কামাল সময়ের আলোকে বলেন, বহুজাতিক সার কারখানাগুলোতে পেট্রোবাংলা বেশি দামে গ্যাস বিক্রি করে। আর সিইউএফএলসহ দেশীয় সার কারখানায় কম টাকায় গ্যাস বিক্রি করে। তা ছাড়া গ্যাস সরবরাহ না করলে তাদের প্রতি মাসে বিপুল ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চুক্তি আছে। তাই বিসিআইসির মালিকানার বাইরের এসব কারখানায় পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখে। কিন্তু দেশীয় সার কারখানাগুলোতে উৎপাদন করা সার অনেক কম মূল্যে বিক্রি করা হয়। অন্যদিকে বহুজাতিক সার কারখানাগুলো থেকে বিদেশ থেকে আমদানি মূল্যে সার কিনতে হয়। তাই স্বাভাবিকভাবে আমরা চাই সিইউএফএল চালু থাকুক। 

বিসিআইসি সূত্র জানায়, আশির দশকে কাফকো প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় কাফকো। ১৯৯৪ সাল থেকে কারখানায় পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়। পুরোদমে উৎপাদন শুরু করে ১৯৯৫ সালের ৩১ জানুয়ারি। প্রাথমিক পর্যায়ে ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয় কাফকো প্রকল্পে। উৎপাদন, সমন্বয় ও টেকনিক্যাল সার্ভিস এই তিন ভাগে বিভক্ত কাফকো। এখানে রয়েছে চারটি সমন্বয়কারী বিভাগ।

এগুলো হচ্ছে মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, সিভিল ও ইনস্ট্রুমেন্টেশন। অ্যামোনিয়া প্ল্যান্টে হ্যাল্ডর টপসোয়ের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। বছরে প্রায় শূন্য দশমিক ১৫ মিলিয়ন টন অ্যামোনিয়া উৎপাদন করা হয়। স্বল্প শক্তি ব্যয় হয় এমন টপসোয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ইউরিয়া প্লান্টে স্ট্যামিকার্বনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে কাফকো। এখানে ব্যাগ তৈরির সরঞ্জাম এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্যাগে ইউরিয়া ভর্তি করার সুবিধা রয়েছে। কর্ণফুলী নদীর তীরে কর্ণফুলী উপজেলার রাঙ্গাদিয়া এলাকায় কাফকোর অবস্থান। 

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন্স) প্রকৌশলী আমিনুর রহমান বলেন, গ্যাস সরবরাহ সিইউএফএলে বন্ধ আছে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে। উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তেই সিইউএফএলে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখে কাফকোতে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। দুই কারখানায় কোনটিতে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই।

কবে সিইউএফএলে গ্যাস সরবরাহ করা হবে এই প্রশ্নে তিনি বলেন, সামিটের এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হলে আশা করছি সিইউএফএলে গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। চলতি মাসের শেষ দিকে সামিটের টার্মিনাল থেকে সরবরাহ শুরুর চেষ্টা আছে। সেখানে কিছু কারিগরি সমস্যা আছে। পাশাপাশি সমুদ্র উত্তাল থাকায় কারিগরি কাজও ব্যাহত হচ্ছে। তবে চলতি মাসের শেষ দিকে আদৌ সামিটের এলএনজি সরবরাহ হবে কি না তা নিশ্চিত নই।

বর্তমানে প্রতিদিন চট্টগ্রামে ২৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ মিলছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে গ্যাস সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি নেই। তবে সামিটের এলএনজি সরবরাহ হলে চলমানের গ্যাসের ঘাটতি খুব বেশি থাকবে না।

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, দেশে বার্ষিক ইউরিয়া সারের চাহিদা ৩২ লাখ টন। চাহিদার সারের বড় অংশ বিসিআইসি সরবরাহ করে। দেশে উৎপাদিত সার দিয়ে চাহিদা সামাল দেওয়া যায় না। তাই প্রতি বছর বিদেশ থেকে সার আমদানি করতে হয়। গড়ে প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ লাখ টন সার আমদানি করতে হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসব সার আমদানি হয়। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিসিআইসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, কাফকো চালু রেখে সিইউএফএল বন্ধ রাখার অন্যতম একটি কারণ গ্যাসের দামে তারতম্য। প্রতি ইউনিট গ্যাস সিইউএফএলসহ বিসিআইসির মালিকানাধীন সার কারখানায় সরবরাহ করা হয় সাড়ে চার টাকা করে। আর কাফকোর কাছে বিক্রি হয় প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা থেকে ৩২ টাকা করে। 

গ্যাস সরবরাহ করে পেট্রোবাংলা সিইউএফএল থেকে কাফকো থেকে ভালো আয় করে। তাই কাফকোতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে। আর সিইউএফএল মাসের পর মাস বন্ধ রাখা হচ্ছে।

সময়ের আলো/আরএস/ 





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close