সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা সেচ কমিটির সভাপতির সই জাল করে সেচ সংযোগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। সই জাল করে ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করা সংযোগ না দিতে ও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইউএনও ও পল্লী বিদ্যুতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী সেচ মালিকরা।
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরেজমিন কথা হয় সেচ পরিচালনা করা রসুলপুর গ্রামের আবদুল মমিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি সেচ সংযোগ থেকে আরেকটি সেচ সংযোগের দূরত্ব থাকার কথা অন্তত ৭৮০ ফুট। পল্লী বিদ্যুতের অফিসের মনোয়ারের লাইসেন্স দিয়ে কাজ করে আমাদের গ্রামের (রসুলপুর) অদক্ষ ইলেকট্রিশিয়ান রফিক। মনোয়ার ও রফিক পল্লী বিদ্যুতের কামারখন্দ সাব জোনাল অফিসের এজিএম মুক্তার হোসেন, ওয়্যারিং পরিদর্শক শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগসাজশে আমার সেচ সংযোগ থেকে ২০০ ফুট দূরত্বে ফরিদুল ইসলাম ও ৪০০ ফুট দূরত্বে সোহেল রানার দুটি ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করে। যেখানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা সেচ কমিটির সভাপতি তার সই জাল করে ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করে তারা। ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করে পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা ফরিদুলের সেচ সংযোগ দিতে এলে গ্রামবাসীর তোপের মুখে সংযোগ না দিয়ে ফিরে যান তারা।
আবদুল মমিন আরও বলেন, অবৈধ এ কাজের জন্য সেচ সংযোগের প্রার্থী ফরিদুল ও সোহেলের কাছ থেকে আপাতত ৫ লাখ টাকা নেয়। এর মধ্যে ফরিদুলের ৪ লাখ ও সোহেলের ১ লাখ টাকা রয়েছে। ফরিদুল টাকা বেশি দেওয়ায় তার সংযোগ আগে প্রদান করার অপচেষ্টা চালানো হয়।
রায়দৌলতপুর গ্রামের সেচ মালিক রফিকুল ইসলামের ছেলে রাকিব হোসেন জানান, ইউএনওর সই জাল করে ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করে আমার সেচ সংযোগ থেকে ১১৫ ফুট দূরত্বে সেচ সংযোগ দেওয়ার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এমন খবর নিশ্চিত হওয়ার পর ইউএনওসহ পল্লী বিদ্যুতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ দেওয়া হয়। কিছু দিন পর কামারখন্দ পল্লী বিদ্যুতের এজিএম মুক্তার হোসেন ও ওয়্যারিং পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম এসে বলেন, শহিদুলের সংযোগ নিতে আপনি বাধা দেন কেন। এ ঘটনার কিছু দিন পর গোপনে আমার সেচ প্রকল্প থেকে মাত্র ১১৫ ফুট দূরত্বে সেচ সংযোগ দিয়ে যায় পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা।
রাকিব আরও জানান, এজিএম মুক্তার, ওয়্যারিং পরিদর্শক শফিকুল ও আমাদের গ্রামের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইলেকট্রিশিয়ান মনোয়ার মিলে ১২ লাখ টাকা চুক্তিতে ইউএনওর সই জাল করে ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করে শহিদুলের সেচ সংযোগ দেওয়া হয়। সংযোগ দেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে ইউএনওর কাছে গেলে তিনি এজিএমকে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেন।
রসুলপুর গ্রামের অভিযুক্ত রফিক জানান, ফরিদুলের সেচ সংযোগের ব্যাপারে আমাকে যে টাকা দেওয়া হয়েছিল সেই টাকা ইলেকট্রিশিয়ান মনোয়ারের কাছে দিয়েছি। সে অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেচ সংযোগ পাস করেছে। কীভাবে সে সেচ সংযোগ পাস করেছে আমার জানা নেই।
রফিক আরও জানান, বোঝেন তো একটা কাজ টাকা ছাড়া এমনিতেই হয় না। তারপরও সেচ সংযোগের ব্যাপারে আমাকে যে টাকা দেওয়া হয়েছিল সেই টাকা ফরিদুলের পরিবারকে তিন মাসের মধ্যে ফেরত দিতে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে মুচলেকা দিয়েছি।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত পল্লী বিদ্যুতের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইলেকট্রিশিয়ান মনোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর আওতায় কামারখন্দ সাব জোনাল অফিসের ওয়্যারিং পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, যখন সেচ সংযোগ দেওয়া হয়, তখন গ্রাহক নিজেই অথবা গ্রাহকের প্রতিনিধি সংযোগের সব লেনদেন করে থাকে। ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি ও আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে তিনি জড়িত নয় বলেও মন্তব্য করেন ।
সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর আওতায় কামারখন্দ সাব জোনাল অফিসের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) মুক্তার হোসেনও সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ইউএনওর সই জাল করে গ্রাহকরা নিজেই ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করে। পরে সেই ছাড়পত্র অফিসে জমা দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শহিদুল ইসলাম নামে একটি সংযোগ দেওয়া হয় ও ফরিদুল ইসলামের সংযোগ দিতে গিয়ে অবৈধ ছাড়পত্রের বিষয়টি জানতে পেরে সংযোগ না দিয়ে অফিসে ফেরত আসা হয়। এজিএম বলেন, সেচ কমিটির রেজুলেশন দেখে বৈধতা নিশ্চিত করে সেচ সংযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু ভুল করে শহিদুল ও ফরিদুলের রেজুলেশন না দেখেই ছাড়পত্রের ওপর ভিত্তি করে তাদের সংযোগ দেওয়া হয়। ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি ও আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করেন তিনি।
ইউএনও ও উপজেলা সেচ কমিটির সভাপতি শাহীন সুলতানা জানান, অভিযোগ যাচাই করে দেখা যায়, ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করা শহিদুল ও ফরিদুলের নাম বাতিলের তালিকায় রয়েছে। ইউএনও বলেন, এ ব্যাপারে এজিএম জড়িত নয়, গ্রাহক নিজেই ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করেছে বলে এজিএম জানিয়েছেন। তারপরও এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না। এজিএমকে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তা ছাড়া অভিযুক্ত এজিএম ও ওয়্যারিং ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে তিনি আপাত কোনো ব্যবস্থা নেবেন না বলেও জানান ইউএনও।
এ ব্যাপারে কথা বলতে সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর জেনারেল ম্যানেজারের মুঠোফোনের অফিসিয়াল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
তবে সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (গ্রাহকসেবা) রফিকুল ইসলাম জানান, কামারখন্দে ইউএনওর সই জাল করে সেচের ভুয়া ছাড়পত্র তৈরি করার প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি কাজ করছে। তদন্ত শেষ হলে বিস্তারিত জানা যাবে।
সময়ের আলো/জিকে