ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

দুই পুলিশ কর্মকর্তার কাণ্ড
সাভারে নির্বিচারে গুলি ছোড়ার পাশাপাশি চলত ভাঙচুর ও লুটপাট
প্রকাশ: সোমবার, ১২ আগস্ট, ২০২৪, ৪:৪৯ এএম  (ভিজিট : ৪৫৮)
দিনের বেলায় আন্দোলনকামী ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে কাছ থেকে গুলি ছুঁড়তেন। কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেলে বলতেন, দেখ তো উইকেট পড়ছে কি না! আর সন্ধ্যা নামলেই তাদের আতঙ্কে কাঁপত সাভার। উদ্বেগে জবুথবু হয়ে থাকতেন অনেকেই। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা ছাড়াও ঘুমাতে পারতেন না আন্দোলনকারীরা।

রাত গভীর হলেই নেমে আসত ভয়ানক এক আতঙ্ক। রেহাই পেতেন না শিশু থেকে নারী কিংবা বৃদ্ধরাও। হাতে-পায়ে ধরে কাকুতি-মিনতি করেও রক্ষা ছিল না। বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর তো করতেনই, পাল্লা দিয়ে চলত লুটপাট। টিভি, ফ্রিজ ভেঙে তছনছ করা হতো। সটানে ছিনিয়ে নেওয়া হতো গৃহকর্তীর গলার চেইন। চলত নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার লুটের মহোৎসব। আর সোফা থাকলে তো কথাই নেই। গদির বুকে ধারালো ছুরির ফলা বসিয়ে করা হতো ফানাফানা। এভাবেই পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম, অপস অ্যান্ড ট্রাফিক) আবদুল্লাহিল কাফী ও ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সাভার সার্কেল) শহিদুল ইসলাম। আবদুল্লাহিল কাফী বিসিএস ২৯ ব্যাচের কর্মকর্তা। উঠে এসেছেন ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে। আর বিসিএস ৩১ ব্যাচের শহিদুল ইসলামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সাভারে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে পুলিশের গুলিতে ৭০ জনের বেশি নিরীহ মানুষ হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি আন্দোলনকারী থেকে শুরু করে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি হামলা, ভাঙচুর, লুটতরাজ ও মহিলা লাঞ্ছনার একের পর এক অভিযোগ আসছে এই দুজনের বিরুদ্ধে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘যা করেছি সিনিয়র স্যারদের হুকুমেই করছি। আমাকে বলা হয়েছে, যেভাবে তারা গাড়ি ও অফিস ভাঙে ঠিক সেভাবেই তাদের বাড়িঘর তছনছ করবা। আমি হুকুমের গোলাম। আমার কোনো দোষ নেই।’ তার বক্তব্য অনুযায়ী ইউনিট কমান্ডার আবদুল্লাহিল কাফীই দিয়েছিলেন এসব নির্দেশ। সাভারে পুলিশের এই দুই কর্মকর্তার বেপরোয়া দুর্নীতি, অনিয়মের এমন অসংখ্য ঘটনা এখন মানুষের মুখে মুখে। গুলি করে শিক্ষার্থীদের মারার অভিযোগে শহিদুল ইসলামসহ পুলিশের বিচারের দাবিতেও সোচ্চার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর বাইরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা নিয়েও সরব হয়েছেন অনেকেই।

সাভার পৌর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুর রহমান উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ১৫ জুলাই পাড়ি জমান থাইল্যান্ডে। অথচ তিনি নিজে উপস্থিত থেকে গাড়ি পুড়িয়েছেন ভাঙচুর করেছেন-এমন অভিযোগে সাভার মডেল থানাতেই ৫টি নাশকতার মামলায় আসামি করা হয় তাকে। আবদুর রহমানের স্ত্রী দিলরুবা রহমান রুমি জানান, আবদুল্লাহিল কাফী ও শহিদুল ইসলামের বাড়ি বাড়ি হামলা, ভাঙচুর আর লুটতরাজের পর থেকে আমরা চরম ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে আছি। এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার লাঞ্ছনার হাত থেকে রেহাই পেতে আমি দুই সন্তান নিয়ে নিরাপদে চলে যাই ২২ জুলাই রোববার।

প্রতিবেশীদের সিসি ক্যামেরার দৃশ্য মতে, সেদিন রাতে আবদুল্লাহিল কাফী ও শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল পুলিশ আমার পৌরসভার মজিদপুর চুঙ্গির পাড় এলাকার বাসার তালা ভেঙে প্রথমেই গুঁড়ো করে দেয় সিসি ক্যামেরার ডিভিআর। চুর্ণবিচূর্ণ করে চারপাশের গ্লাস, টিভি, আলমারি, ওভেন, আসবাবপত্রসহ সন্তানদের দুটি ল্যাপটপ। আলমারি ভেঙে লুট করে নগদ ৪০ হাজার টাকা ও ৫০ ভরির মতো স্বর্ণালংকার। পরের শুক্রবার একটি বিয়েতে অংশ নেব বলে ব্যাংকের লকার থেকে গহনাগুলো আনিয়েছিলাম। সব লুটে নিয়েছে। বিশ্বাস করবেন না, ফ্রিজে থাকা রান্না করা খাবারগুলোও খেয়ে নেয় তারা। আচ্ছা পুলিশ যদি ডাকাত হয়-তা হলে আর কার কাছে আশ্রয় চাইব?

একই অভিজ্ঞতার কথা জানান সাবেক সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (সম্প্রসারণ) শহিদুল্লাহ কাউসার। তিনি বলেন, বড় মেয়ে কাউসার হাবিবার স্বামী ঢাকা জেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক। এই অপরাধে গত ২১ জুলাই বেলা ৩টার দিকে পুলিশের গাড়ি বহর আসে আমাদের মহল্লায়। এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা আমার সি ৯/৭ বাড্ডা ছায়াবিথীর বাসায় ঢুকে ৪ থেকে ৫ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে। নিচ তলা, ওপর তলার সব জানালার কাচ, প্রাইভেট কার, ভাড়াটিয়াদের ৫টি মোটরসাইকেল, দুটি ফ্রিজ, তিনটি এসি, টিভি, আসবাবপত্র ভেঙে তছনছ করে। লুটপাট করে ব্যাংক থেকে ওঠানো ব্যবসার জন্য রাখা নগদ ২৯ লাখ টাকা। গাড়ি বিক্রির ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। দোকান ভাড়ার ৫০ হাজার ৮০০ টাকাসহ দুটি স্বর্ণের চেইন, ৫টি মোবাইল। নিচ তলা, ওপর তলার হাইকমোড, বেসিন, পানির কল কিছুই অক্ষত রাখেনি। কার কাছে বিচার দেব। আল্লাহ ছাড়া আমাদের আর কেই বা ছিল। তবে বলতে পারেন ৫ আগস্ট বিচার পেয়েছি।

বিএনপি নেতা ও সাভার সিটি সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ওবায়দুর রহমান অভি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন ১৮ জুলাই। অথচ নাশকতাসহ বিভিন্ন মামলায় তিনি নিজে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, গাড়ি পুড়িয়েছেন মর্মে তাকে সাভার মডেল থানার একাধিক মামলায় আসামি করা হয়। ওবায়দুর রহমান অভি বলেন, আবদুল্লাহিল কাফী ও শহিদুল ইসলাম বাড়ি বাড়ি যান আর ভাঙচুর করেন-এই ভয় দেখিয়ে জাহিদ হোসেন জুয়েল নামের এক সোর্স আমার পরিবার থেকে ৫ লাখ টাকা নেন। অথচ টাকা দিয়েও আমার বাড়ি রক্ষা হয়নি।

অভির স্ত্রী মাসুমা আক্তার জানান, পুলিশের ভয়ে আমরা নিরাপদে চলে যাই। অথচ দুজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বেই ২৩ জুলাই রাতে সিটি সেন্টারের ১১ তলায় আমার বাসার তালা ভেঙে ভেতরে পুলিশ ঢুকে মূল্যবান ঝাড়বাতি, জানালার গ্লাস, টেবিলের গ্লাস, চারটি টেলিভিশন, ফ্রিজ ভেঙে তছনছ করে। লুটপাট করে বাড়িটি উদাম রেখেই চলে যায়। এ ধ্বংসাবশেষ দেখে আমার দুই কন্যা ও শিশুপুত্র এখনও ভয়ে শিউরে ওঠে। ওরা বলে, মা মা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। আবার পুলিশ এসে যদি আমাদের পেয়ে মেরে ফেলে-বাচ্চাদের চোখে-মুখে তাকানো যায় না-কী ভয় আর আতঙ্ক। বলে বোঝাতে পারব না।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফীর বক্তব্য নিতে একাধিকবার চেষ্টা করেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। আরেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শহিদুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দোহাই দিয়ে অভিযোগের বিষয়টি এড়িয়ে যান।


সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close