বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষকে লেনদেন করতে হয়। কিন্তু অনেক সময় এই লেনদেনই বিবাদ, দূরত্ব ও সম্পর্ক ছেদন এবং মনোমালিন্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি এর সূত্র ধরে মারামারি-কাটাকাটি পর্যন্ত গড়ায় কখনো কখনো। এর বহু কারণ থাকতে পারে, তবে অন্যতম কারণ হচ্ছে লেনদেনের অস্বচ্ছতা। অথচ বিবাদমুক্ত সুখী-সুন্দর জীবনের জন্য ধার্মিকতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নির্মলতাও। মূলত লেনদেনই হচ্ছে ধার্মিকতার মাপকাঠি।
একজন মানুষের মধ্যে কতটুকু ধার্মিকতা আছে তা জানা যায় এরই মাধ্যমে। এ জন্যই বলা হয়, প্রকৃত দ্বীনদারি তো লেনদেনেরই নাম, অর্থাৎ খুব নামাজ পড়া, লাগাতার রোজা রাখা, একের পর এক হজ-ওমরাহ করা, দান-সদকায় আগে আগে থাকা, জিকির, তেলাওয়াত ও তসবিহ নিয়ে পড়ে থাকাই শুধু দ্বীনদারি নয়। প্রকৃত দ্বীনদারি তো এই যে, একজন মানুষ এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে যাবতীয় লেনদেনেও হবে স্বচ্ছ ও সতর্ক। মিথ্যার আশ্রয় নেবে না, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না, আমানতের খেয়ানত করবে না এবং দেনাপাওনা পরিশোধেও করবে না কোনো প্রকার গড়িমসি। কিন্তু অনেকে নামাজ-রোজা, জিকির-তেলাওয়াত ও তসবিহ-তাহলিলকেই কেবল দ্বীনদারি ধরে নিয়েছে। তাই তাদের নামাজ-কালামে ও লেবাস-পোশাকে বড় দ্বীনদার মনে হলেও লেনদেনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মস্ত বড় ধূর্ত ও ধড়িবাজ। লেনদেনে অস্বচ্ছতা, পাওনা পরিশোধ টালবাহানা, মোয়ামালা-মোয়াশারায় অসতর্কতা।
তাই বাহ্যিক চালচলন, বেশভূষা দেখেই কাউকে প্রকৃত দ্বীনদার বলে মনে করার কোনো সুযোগ নেই। জনৈক ব্যক্তি হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর কাছে এক ব্যক্তির গুণকীর্তন করে বলল, অমুক বড় সত্যবাদী। ওমর (রা.) বললেন, আচ্ছা তুমি কি তার সঙ্গে কখনো সফর করেছ? লোকটি উত্তর দিল, জি না। ওমর (রা.) আবার প্রশ্ন করলেন, তা হলে কি তোমার ও তার মধ্যে কখনো কোনো লেনদেন হয়েছে? লোকটি একই উত্তর দিল, জি না।
ওমর (রা.) তৃতীয়বার প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা তা হলে কি তুমি কখনো তার কাছে কোনো আমানত রেখেছ? এবারও লোকটি নেতিবাচক উত্তর দিয়ে বলল, জি না। ওমর (রা.) বললেন, না, তার ব্যাপারে তোমার কোনো ধারণাই নেই। মনে হয়, তুমি তাকে মসজিদে রুকু-সেজদা করতে দেখেছ! অর্থাৎ শুধু মসজিদের গণ্ডির মধ্যে দেখেই যে তাকে ধার্মিক ও সত্যবাদী মনে করছ এবং তার গুণের তারিফ করছ, এটা ঠিক নয়। প্রকৃত পরিচয় তো জানবে লেনদেনের পর। (কানজুল উম্মাল : ২৫৫৭০)
তা ছাড়া এই স্বচ্ছ লেনদেনই যাবতীয় আমলের রক্ষাকবচ। কেননা লেনদেন অস্বচ্ছ হলে এবং অন্যের হক অনাদায়ী থেকে গেলে আমলের বিরাট সঞ্চয়ও শেষ হয়ে যাবে এবং নিক্ষিপ্ত হতে হবে জাহান্নামের অতল গহ্বরে। একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে উদ্দেশ করে বললেন, আচ্ছা তোমরা কি জানো নিঃস্ব কে? সবাই উত্তর দিলেন, আমাদের মধ্যে নিঃস্ব সেই ব্যক্তি যার কাছে টাকা-পয়সা, মালামাল কিছুই নেই। নবীজি বললেন, না, আমার উম্মতের প্রকৃত নিঃস্ব ওই ব্যক্তি যে কেয়ামতের দিন নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি আমল নিয়ে আসবে কিন্তু দুনিয়াতে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কারও রক্তপাত ঘটিয়েছে, কাউকে প্রহার করেছে। তাই তার নেক আমল থেকে একে একে হকদারকে দেওয়া হবে। আর যদি হক পরিশোদের আগেই আমল শেষ হয়ে যায় তা হলে হকদারদের পাপ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহিহ মুসলিম : ২৫২১)
সময়ের আলো/আরএস/