ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

সাত মাস বন্ধ যমুনা সার কারখানা
নষ্ট হওয়ার উপক্রম মূল্যবান যন্ত্রাংশ
প্রকাশ: সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০২৪, ২:৫২ এএম  (ভিজিট : ৩২৪)
গ্যাস সংকটসহ নানান কারণে খুঁড়িয়ে চলছে জামালপুরের অবস্থিত দেশের বৃহত্তম ও একমাত্র দানাদার ইউরিয়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যমুনা সার কারখানা। গ্যাস সংকটে ইউরিয়া উৎপাদন বন্ধ রয়েছে ছয় মাস ধরে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় কারখানার মূল্যবান যন্ত্রাংশ মরিচা ধরে নষ্ট হতে চলেছে। বিভিন্ন সময় কারখানা বন্ধ হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন শ্রমিক-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এভাবে কারখানা বন্ধ থাকলে আমন মৌসুমে যমুনার সার-নির্ভর এলাকাগুলোতে সার সংকটের শঙ্কা কৃষকদের।

কারখানা ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বিসিআইসির নিয়ন্ত্রণাধীন যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লি. ১৯৯১ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালুর পর ১৯৯২ সালের ১ জুলাই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যায়। কারখানার নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনের জন্য দৈনিক ৪২-৪৩ পিএসআই গ্যাসের প্রয়োজন। এতে প্রতিদিন ১ হাজার ৭০০ টন উৎপাদনে সক্ষম হয় কারখানাটি। গ্যাসের চাপ-স্বল্পতা ও বিভিন্ন ত্রুটির কারণে উৎপাদন কমে বর্তমানে ১ হাজার ২৫০ টন ইউরিয়া উৎপাদন হয় । 

এ ছাড়া উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কাঁচা মাল হিসেবে অ্যামোনিয়া দৈনিক ১ হাজার ৭৮ টন হারে বার্ষিক ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৭৪০ টন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে উৎপাদন শুরু হয়।

সম্প্রতি চালু হওয়া ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার কোম্পানিতে সার উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বিসিআইসি। ওই কারখানায় পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ রাখতে যমুনা সারকারখানায় গত ১৫ জানুয়ারি থেকে গ্যাসের চাপ কমিয়ে দেয় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশর কোম্পানি। গ্যাসের চাপ না থাকায় যমুনা সার কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে ছয় মাস ধরে ইউরিয়া উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। সার কারখানাটির জনবল ১ হাজার ৫১ জন নির্ধারিত থাকার কথা থাকলেও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সার্বক্ষণিক প্লান্টে কারিগরিতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ শতাধিক কর্মকর্তা-শ্রমিক-কর্মচারী সংকট রয়েছে বলে জানা যায়। সার্বক্ষণিক প্লান্টের মনিটরিং এবং এডজাস্টমেন্ট প্রয়োজন থাকলেও জনবল সংকটে রক্ষণাবেক্ষণ কাজ ব্যাহত এবং গ্যাস স্বল্পতায় কারখানার ৮০ থেকে ৫৫ শতাংশ লোড উঠানামা করায় দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টন সার উৎপাদন কম হওয়ায় রাজস্ব কমছে। 

বিগত কয়েক অর্থবছরে কারখানাটি বন্ধের কারণ বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে গ্যাস সংকটে ৭৪ দিন, যান্ত্রিক ত্রুটিতে ৩১ দিন ও প্রসেসিং সমস্যায় ১৫ দিনসহ মোট ১২০ দিন উৎপাদন বন্ধ ছিল। ১২০ দিন বন্ধ থাকার পর বার্ষিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৩৫ হাজার টন হলেও ৩ লাখ ২৭ হাজার ৫১২ টন  উৎপাদন হয়। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে  ৯২ হাজার ৫১২ টন বেশি সার উৎপাদন হওয়ায় লাভে থাকে কারখানটি। 

২০১২-১৩ অর্থবছরে যান্ত্রিক ত্রুটি, গ্যাস সংকটে  মোট-৩২ দিন বন্ধ থাকলেও কারখানাটিতে  ৪ লাখ ৬০ হাজার ৭১২ টন সার উৎপাদন হয় যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে  ৮০ হাজার ৭১২ টন বেশি ছিল। 

২০১৩-১৪ অর্থবছরে যান্ত্রিক ত্রুটিতে ৪০ দিন ও  ওভারহোলিং কাজে ৩৬ দিনসহ মোট ৭৬ দিন বন্ধ থাকে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ টন নির্ধারণ করা হলে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৩০৯  টন উৎপাদন করে কারখানাটি। এ বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৪০ হাজার টন কম সার উৎপাদন হয়। 

২০১৪-১৫ অর্থবছরে যান্ত্রিক ত্রুটিতে ৯ দিন এবং গ্যাস সংকটে ৩ দিন ও ওভারহোলিং ২৩ দিনসহ মোট ৩৫ দিন উৎপাদন বন্ধ থাকে।

এ বছরেও ৪ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়। এ বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭৪ হাজার ৭৭৭  টন সার উৎপাদন বেশি হয়। 

২০১৫-১৬  অর্থবছরে যান্ত্রিক ত্রুটিতে ১৪ দিন ও গ্যাস সংকটে ২৫ দিন ও ওভার হোলিং কাজে ১১ দিনসহ মোট ৫০ দিন বন্ধ থাকে। এ অর্থবছরে ৪ লাখ ৫০ হাজার  টন লক্ষ্যমাত্রা হলেও ৭ হাজার ৭০২  টন উৎপাদন বেশি হয়। 

২০১৬-১৭ অর্থবছরে যান্ত্রিক ত্রুটিতে ৫৪ দিন ও গ্যাস সংকটে ৫৭ দিনসহ মোট ১১১ দিন উৎপাদন বন্ধ থাকে। ৩ লাখ ৮০ হাজার টন লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এ অর্থবছরে ২৯ হাজার ৮৬১  টন সার উৎপাদন কম হয়।

২০১৭-২০১৮  অর্থবছরে যান্ত্রিক ত্রুটিতে ১৩.৭৬ দিন ও গ্যাস সংকটে ৯৮.৬৭ দিনসহ মোট ১৩৭.৪৩ দিন উৎপাদন বন্ধ থাকার মধ্যেও লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৮০ হাজার এর স্থলে ৩ লাখ ২ হাজার ৪১২ টন সার উৎপাদিত হয়। 

২০১৮-১৯ অর্থবছরে যান্ত্রিক ত্রুটিতে ২৩৪.০১ দিন  ও গ্যাস সংকটে ৫৭.৩৮ দিনসহ মোট ৩১১.৩৯ দিন উৎপাদন বন্ধ ছিল। 

২০১৯-২০  অর্থবছরে যান্ত্রিক ত্রুটিতে ২০৬ দিন উৎপাদন বন্ধ থাকে। ২ লাখ ৪০ হাজার টন নির্ধারণ করা হলেও ২ লাখ ১০ হাজার ১৫৯  টন উৎপাদন হয়। 

 ২০২০-২১ অর্থবছরে যান্ত্রিক ত্রুটি ৮৬.০২ দিন ও গ্যাস সংকটে ১৬.৫৯ দিন উৎপাদন বন্ধ থাকলেও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৪০ হাজার এর স্থলে ৩ লাখ ৪১ হাজার ৬০৬  টন সার উৎপাদিত  হয়। 
২০২১-২২ অর্থবছরে যান্ত্রিক ত্রুটি ৫৭.৯০ দিন ও গ্যাস সংকটে ৪৬.৮৩ দিন এবং বার্ষিক ওভার হোলিং ৬০ দিনসহ মোট ১৬৪.৭৩ দিন বন্ধ থাকার পর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখের স্থলে ৭২ হাজার ৩৮৯ টন হওয়ায় লোকসানের মুখে পড়ে  সারকারখানটি। 

২০২২-২৩  অর্থবছরের ২১ জুন থেকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোং লি.  কর্তৃপক্ষ যমুনা সারকারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। বন্ধের ৩৮৭ দিন পর উৎপাদন চালু করা হলেও পুনরায় বন্ধের ৪০ দিন বন্ধের পর ১১ ডিসেম্বর উৎপাদন চালু করা হয়। 

গেল ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর রাত ৯.৩০ মিনিটে যান্ত্রিক ত্রুটিতে বন্ধ হওয়ার পর চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি বিকাল ৩টা ৫০ মিনিটে যান্ত্রিক ত্রুটিতে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২৬ জানুয়ারি ৩টা ১০ মিনিটে উৎপাদন চালু হলে ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা থেকে যান্ত্রিক ত্রুটিতে সার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে ১৭ ফেব্রুয়ারি পুনরায় চালু করা হয়। 

২০২২-২৩ আর্থিক বছরের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৬০ হাজার টনের মধ্যে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ৫৪ হাজার ৯৯২ টন। 

জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড়সহ ২১ জেলার ১৬২টি উপজেলায় এই কারখানার সার ডিলারদের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এতে তালিকাভুক্ত প্রায় ১ হাজার ৯০০ ডিলার ২১ জেলার কৃষকের কাছে সার সরবরাহ করে।

বর্তমানে দীর্ঘ ৬ মাস ধরে কারখানাটি বন্ধ থাকায় দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার শ্রমিক ও পরিবহন শ্রমিকরা কাজ হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেনাবেচা বন্ধ হয়েছে স্থানীয় হাট-বাজারসহ ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে। সার পরিবহনে ৫ শতাধিক ট্রাকের অন্তত ২ হাজার শ্রমিক ও কারখানায় ছাঁটাই করা শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যমুনার সার উৎপাদন বন্ধ থাকলে চলতি মৌসুমে সার সংকটের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। কারখানা বন্ধ থাকলে দাম আরও বাড়তে পারে বলে মনে করেছেন ডিলার ও কৃষকরা।

ট্রাকচালক ও হেলপাররা জানান, আমাদের পরিবহন কারখানা এলাকার তালিকাভুক্ত। কারখানার সার পরিবহন ছাড়া অন্যকোনো কিছু পরিবহন করি না। কারখানা বন্ধ থাকায় আমরা বেকার বসে আছি। প্রতি বছর ৩০-৪০ হাজার টাকা দিয়ে গাড়ির কাগজ নবায়ন করতে হয়। কারখানা বন্ধ থাকলে নিজেদের পরিবার পরিজন নিয়ে মানবতের জীবনযাপন করতে হয়। এ ছাড়া গাড়ি না চলার কারণে যন্ত্রাংশও নষ্ট হয়ে যায়।
স্থানীয় কৃষকরা জানান,  যমুনার সার জমিতে ব্যবহারে ফসল বৃদ্ধি পায়। গাছও সতেজ হয়। 

কারখানা বন্ধ থাকলে একসময় চিনি, পাট শিল্পের মতো এ শিল্পও বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

জেএফসিএল সিবিএ সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী বলেন, যমুনার এক টন সার উৎপাদন করতে খরচ লাগে ১৮-২০ হাজার টাকা। আর দেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে এক টনের খরচ লাগে প্রায় ১ লাখ টাকা। আমদানি নির্ভরতা থেকে সরে দাঁড়িয়ে দেশীয় শিল্পকে সচল রাখা হলে দেশের রাজস্ব বাড়বে। এতে বাইরে থেকে সার আনতে সরকারের ভর্তুকি-ভার বহন করতে হবে না। কারখানা বন্ধ থাকায় প্রতিদিন সাড়ে ৩ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব ঘাটতি হচ্ছে। 

তারাকান্দি ট্রাক ও ট্যাঙ্ক লরি মালিক সমিতির সহ-সভাপতি মশিউর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী যমুনা সার কারখানায় গ্যাস সংযোগ দিয়ে পরিবহন শ্রমিক, ব্যবসায়ীদের মানবেতর জীবনযাপন থেকে উদ্ধার করবেন বলে আমার বিশ্বাস।

যমুনা সার কারখানার উপপ্রধান প্রকৌশলী (রসায়ন) ফজলুল হক জানান, গ্যাস সংযোগ না থাকায় দীর্ঘ ৬ মাসের বেশি সময় ধরে কারখানা বন্ধ, কারখানায় বড় ধরনের কোনো ত্রুটি নেই, ছোট ছোট যা ছিল তা মেইনটেন্স করা হয়েছে আগেই। গ্যাস পেলে কারখানা চালু করা হবে বলে জানান যমুনা সার কারখানার এই কর্মকর্তা।

উৎপাদনের সময় ১৯৯২-৯৩ ও ১৯৯৩-৯৪ দুই অর্থবছরে উৎপাদিত সার বিদেশে রফতানি হয়েছিল। পরে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর থেকে বিদেশে সার রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। 

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close