ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

হুমায়ূন আহমেদের বৃষ্টিবিলাস
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই, ২০২৪, ৪:৫৭ পিএম  (ভিজিট : ৫১৬)
‘আমার জন্যে কিছু আনতে হবে না। আমি আজ বৃষ্টিতে ভিজব। অনেক দিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। বাবা বৃষ্টির সময় আমাদের ছাদে যেতে দেয় না। বাবার ধারণা ছাদে গেলেই- আমাদের বজ্রপাত হবে।’
‘শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিতে বজ্রপাত হয় না।’

‘তাই নাকি? জানতাম না তো! হলেও আজ আমি মনের সাধ মিটিয়ে ভিজব।’ মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘোর বর্ষণ।...

শাহানা এবার কিশোরীদের মতোই ছুটছে। তীরের ফলার মতো বৃষ্টি এসে তাকে বিঁধছে। হাওয়া উড়ছে শাড়ির আঁচল। সে ছুটে যাচ্ছে হাওড়ের দিকে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সে হাওড়ের পানি ছুঁয়ে দেখবে।
হাওড়ের দিক থেকে শোঁ-শোঁ শব্দ আসছে। বাতাস পেয়ে ফুলে ফেঁপে হাওড় হয়েছে সমুদ্রের মতো। ভয়ংকর আক্রোশে সে গর্জন করছে...’

এখানে হাওড়ের চিত্র দেখার পাশাপাশি আমরা বৃষ্টি সম্পর্কে শহুরে দৃষ্টিভঙ্গি এবং গ্রামের সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি উচ্ছ্বাস দেখতে পাই। 

‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ উপন্যাসে চিত্রলেখার মনের অবস্থা তুলে ধরার জন্যে তিনি মেঘকে আশ্রয় করেছেন।

‘চিত্রলেখা জানালা খুলে দিয়েছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিশাল একটা মেঘের স্তূপ ভেসে ভেসে আসছে। খুব সাবধানে চিত্রলেখা তার চোখ মুছল। তার কাছে মনে হলোÑ মেঘের সঙ্গে মানুষের খুব মিল। মানুষ যেমন কাঁদে মেঘও কাঁদে। বৃষ্টি হচ্ছে মেঘের অশ্রু। চিত্রলেখা মুগ্ধ হয়ে মেঘের স্তূপের দিকে তাকিয়ে আছে।’

আমরা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে এমন চরিত্রও পাই, যে কি না অনেক চেষ্টার পরে আমেরিকারও ভিসা পাওয়ার পর বৃষ্টি দেখে উপলব্ধি করে আমেরিকা গেলে এই বৃষ্টি আর দেখা হবে না। তাই আমেরিকা যাওয়ার ইচ্ছে ত্যাগ করে। 

বাংলার বৃষ্টি যে কতটা অপরূপ, অপূর্ব, তা একজন বিদেশির চোখ দিয়েও হুমায়ূন আহমেদ দেখিয়েছেন।
হুমায়ূন আহমেদের ‘হিজিবিজি’ বইয়ে ‘বর্ষাযাপন’ নামক একটি স্মৃতিচারণামূলক গদ্য রয়েছে। সেখানে দেখি, হুমায়ূন আহমেদ এক বিয়ের দাওয়াতে গেলে তার পাশে একজন বিদেশি ভদ্রলোক খেতে বসে। নাম পল অরসন। ভদ্রতাবশত পলকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, বাংলাদেশ কেমন লাগছে?

পল ‘ওহ, ওয়ান্ডারফুল’ বলে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। তিনি তখন আবার জিজ্ঞেস করেন, বাংলাদেশের কোন জিনিসটি তার কাছে ওয়ান্ডারফুল বলে মনে হয়েছে। তখন পল অরসন বলেন, ‘তোমাদের বর্ষা।’ সঙ্গে এও বলেন, ‘বৃষ্টি যে এত সুন্দর হতে পারে এদেশে আসার আগে আমি বুঝতে পারিনি। বৃষ্টি মনে হয় তোমাদের দেশের জন্যেই তৈরি করা হয়েছে। তুমি শুনলে অবাক হবে, আমি একবার প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে রিকশার হুড ফেলে মতিঝিল থেকে গুলশানে গিয়েছি। আমার রিকশাওয়ালা ভেবেছে, আমি পাগল।’

পল অরসন জানায়, এক গরমের দিনে এসে বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়। যে হোটেলে রুম বুকড করা ছিল, সেখানেও এসি নষ্ট। ফ্যানের বাতাসও গরম। গরমে যখন নাভিশ্বাস অবস্থা, তখন বিকেলে মেঘ করে আসে। পল অরসন বলেছেন, ‘বিকেলে এক মিরাকল ঘটে গেল। দেখি, আকাশে মেঘ জমেছে। ঘন কালো মেঘ। আমার বাবুর্চি ইয়াছিন দাঁত বের করে বলল, কালবোশেখি কামিং স্যার। ব্যাপার কিছুই বুঝলাম না। মনে হলো, আনন্দজনক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। হঠাৎ ঝপ করে গরম কমে গেল। হিমশীতল হাওয়া বইতে লাগল। শরীর জুড়িয়ে গেল। তারপর নামল বৃষ্টি। প্রচণ্ড বর্ষণ, সেই সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। বাবুর্চি ইয়াছিন ছুটে এসে বলল, স্যার, শিল পড়তাছে, শিল। বলেই ছাদের দিকে ছুটে গেল। আমিও গেলাম পেছনে পেছনে। ছাদে উঠে দেখি, চারদিকে মহা আনন্দময় পরিবেশ। আশপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করে শিল কুড়াচ্ছে। আমি এবং আমার বাবুর্চি আমরা দুজনে মিলে এক ব্যাগ শিল কুড়িয়ে ফেললাম। আমি ইয়াছিনকে বললাম, এখন আমরা এগুলো দিয়ে কী করব?
ইয়াছিন দাঁত বের করে বলল, ফেলে দিব।

আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। প্রথম তুষারপাতের সময় আমরা তুষারের ভেতর ছোটাছুটি করতাম। তুষারের বল বানিয়ে একে অন্যের গায়ে ছুড়ে দিতাম। এখানেও তা-ই হচ্ছে। সবাই বৃষ্টির পানিতে ভিজে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।’

হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের নামগুলোর দিকে লক্ষ্য করলেও তার বর্ষাপ্রীতি আমরা দেখতে পাই। কয়েকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করছি। ‘শ্রাবণমেঘের দিন’, ‘আকাশ জোড়া মেঘ’, ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’, ‘বৃষ্টিবিলাস’, ‘বৃষ্টি ও মেঘমালা’, ‘মেঘের দিন’, ‘মেঘের ওপারে বাড়ি’ ‘এই মেঘ, রৌদ্রছায়া’, ‘বাদলদিনের প্রথম কদমফুল’ প্রভৃতি।

ছোটবেলা থেকেই ছিল হুমায়ূন আহমেদের এই বর্ষাপ্রীতি, বৃষ্টিবিলাস, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘কিছু শৈশব’ তা-ই সাক্ষ্য দেয়। অন্যান্য স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থেও বৃষ্টির প্রতি তার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ নবজাত পুত্রকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজার ফলে, ছেলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল। নুহাশ পল্লীতে তিনি যে বাড়ি নির্মাণ করেছেন, সেখানে বৃষ্টি দেখার জন্যে একটি ঘর তৈরি করেছেন। সেই ঘরের নাম রেখেছেন বৃষ্টিবিলাস। 

হুমায়ূন আহমেদ এক লেখায় মৃত্যু নিয়ে তার ভাবনার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আমি থাকবো না। এই পৃথিবী পৃথিবীর মতোই থাকবে। বর্ষা আসবে, জোছনা হবে। কিন্তু সেই বর্ষা দেখার জন্য আমি থাকবো না, জোছনা দেখার জন্য আমি থাকব না। 

এই জিনিসটা আমি নিতে পারি না।’ মৃত্যু মানুষের অমোঘ নিয়তি। হুমায়ূন আহমেদও প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলে গেছেন। তবে তিনি যখন চলে গেছেন, তখন বাংলার ক্যালেন্ডারে চলছে শ্রাবণ মাস। শ্রাবণ মাসের বজ্রপাত না হলেও, তাঁর মৃত্যু বজ্রপাতের মতোই আমাদের বুকে আঘাত হেনেছে। এই প্রজন্মকে একক ভাবে হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টিতে ভিজতে শিখিয়েছেন। জ্যোৎস্না দেখতে শিখিয়েছেন। যদি হারিয়ে যাওয়া কারো শূন্যতায় বুক কেঁদে ওঠে, বলতে শিখিয়েছে, ‘যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো এক বরষায়’।

সময়ের আলো/জিকে




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close