সরকারি চাকরির সব ধরনের গ্রেডে ‘কোটা’ সংস্কার করে সংসদে আইন পাস করার দাবিতে নতুন কর্মসূচি হিসেবে আজ গণপদযাত্রা ও রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে কোটার যৌক্তিক সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন তারা। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।
কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমাদের ‘বাংলা ব্লকেড’কে গণদুর্ভোগ দেখানো হয়েছে কিন্তু প্রসব বেদনা ছাড়া সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া সম্ভব নয়। আমরা যা করছি তা জাতির স্বার্থেই করছি।
আগামীকাল (আজ) বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে শিক্ষার্থীরা গণপদযাত্রায় অংশ নেবেন। এরপর শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সাত কলেজ ও ঢাকার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এতে অংশগ্রহণ করবে। এ ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা পদযাত্রা নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেবে।
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, সংসদে আইন পাসের মাধ্যমে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের আগ পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। শিক্ষকদের প্রতি তিনি দাবি জানান, আপনাদের দাবির প্রতি শিক্ষার্থীরা একাত্মতা পোষণ করেছিল। এখন আপনাদের সময় এসেছে ছাত্রদের আন্দোলনে আপনাদের একাত্মতা পোষণ করার। এমন পরিস্থিতি যেন না হয়, যেন শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের চাপ দিচ্ছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরেক সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, সরকারে উচিত ছিল প্রথম থেকেই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করা এবং যৌক্তিক সমাধানে আসা। কিন্তু সরকার তা না করায় আমাদের রাস্তায় নামতে হচ্ছে। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ও পুলিশের মাধ্যমে আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু ছাত্রসমাজ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত দমবে না। আমাদের ছাত্র ধর্মঘট অনির্দিষ্টকালের জন্য চলমান থাকবে। তিনি বলেন, মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক মামলার বিষয়ে পুলিশের জবাবদিহি চাই। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা এ মামলা প্রত্যাহার চাই। আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, পুলিশ আমাদের সংবিধানিক অধিকার আদায়ের পথে দেয়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। পুলিশ আন্দোলনে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে ছাত্রদের উসকে দিচ্ছে।
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে রমনা জোনের এক পুলিশ কর্মকর্তার কল রেকর্ড শুনিয়ে তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা সাঁজোয়া যানে কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি করেনি। মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের দিয়ে মামলা করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।’
পুলিশের মামলা : কোটাবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের যানবাহন ভাঙচুর, পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা এবং মারধরের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা অনেক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা করেছে পুলিশ। শুক্রবার রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পরিবহন বিভাগের গাড়িচালক খলিলুর রহমান বাদী হয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় এ মামলা করেন।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত ১১ জুলাই কোটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্ব ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল। সে অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে অজ্ঞাতপরিচয় ছাত্ররা জড়ো হয়ে বিভিন্ন হলের সামনে দিয়ে প্রদক্ষিণ করে বিকাল ৪টার সময় সেøাগান দিতে দিতে শাহবাগ মোড়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড় অতিক্রম করে বেআইনি জনতায় আবদ্ধ হয়ে দাঙ্গা সৃষ্টি করে সরকারি দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করেন। তারা শাহবাগ মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেন ও পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করেন। এ সময় কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের মারধর করে সাধারণ জখম করেন।
মামলার এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, ঘটনাস্থলে উপস্থিত সব সিনিয়র কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে অজ্ঞাতপরিচয় ছাত্ররা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাহবাগের আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিভিন্ন সেøাগান দিয়ে বারডেম হাসপাতালের গেটের ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশ সদস্যদের আহত করেন। তারা পুলিশকে উদ্দেশ করে বিভিন্ন ধরনের কটূক্তি করেন। ছাত্ররা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর হামলা এবং শাহবাগ থানায় ছাত্রদের ধরে নিয়ে গেছে বলে গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে পুলিশকে মারতে তেড়ে আসেন ও পুলিশকে বিভিন্ন ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে শাহবাগ মোড় ত্যাগ করেন।
‘ডোর টু ডোর’ ক্যাম্পেইন ছাত্রলীগের : কোটা সংস্কারে ‘ডোর টু ডোর’ ও ‘পলিসি অ্যাডভোকেসি’ ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে কোটার আনুপাতিক হার কেমন হতে পারে তার জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত গ্রহণ করবে সংগঠনটি। শনিবার বিকালে সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যুর ‘যৌক্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সমাধানের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ আয়োজিত এক মিট দ্য প্রেসে ক্যাম্পেইন উদ্বোধনের কথা জানায় সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, আমরা আজ থেকে ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইন এবং পলিসি অ্যাডভোকেসি ক্যাম্পেইন পরিচালনা করব। যৌক্তিক সংস্কারের অংশ হিসেবে কোটার আনুপাতিক হার কেমন হতে পারে তার জন্য আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত গ্রহণ করব। সেটির আলোকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে যথাযথভাবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরব।
সাদ্দাম হোসেন আরও বলেন, আমরা শঙ্কার সঙ্গে লক্ষ্য করছি সাধারণ শিক্ষার্থীরা একটি যৌক্তিক ইস্যুতে আন্দোলন করেছে, শান্তিপূর্ণ উপায় বেছে নিয়েছে এবং তারা ঘরে ফিরে গেছে। কিন্তু প্রফেশনাল আন্দোলনকারীরা ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের জন্য রাজপথে রয়েছে। আজকে তারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে, ব্লকেড ব্লকেড খেলা খেলছে সাধারণ মানুষ দুর্বিষহ যন্ত্রণায় পড়ছে। এ সময় তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যারা দিনের পর দিন নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চায়, ছাত্রসমাজকে যারা গণমানুষের প্রতিপক্ষ বানাতে চায়, বাংলাদেশের নারী সমাজের অগ্রগতি ও উন্নতিকে যারা বাধাগ্রস্ত করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।
মিট দ্য প্রেসে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান বলেন, যারা জনদুর্ভোগ তৈরি করছে, শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফিরতে দিচ্ছে না আমরা তাদের সাবধান করে দিতে চাই। তারা মূলত ষড়যন্ত্র করে ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনের নাম করে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাঁ হাত ঢোকানোর ফলাফল ভালো হবে না। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন, সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত এবং সংগঠনটির বিশ্ববিদ্যালয় ও হল শাখার নেতাকর্মীরা।
সময়ের আলো/আরএস/