ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

মেঘালয় আসামের অতিবৃষ্টিতে দেশে বারবার বন্যা
প্রকাশ: বুধবার, ১০ জুলাই, ২০২৪, ৫:৩৪ এএম  (ভিজিট : ৬২৬)
উজান থেকে নেমে আসা ঢল আর ভারী বৃষ্টিতে এ বছর দুই দফা বন্যার কবলে পড়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। চলমান দ্বিতীয় দফার বন্যায় উত্তর-পূর্বে সিলেট ও সুনামগঞ্জ এবং উত্তরে গাইবান্ধা, রংপুর ও কুড়িগ্রামসহ ১৮ জেলার ২০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় তিন হাজার আশ্রয়কেন্দ্রে ৪০ হাজারেরও বেশি লোক আশ্রয় নিয়েছে।

মে মাসের শেষ দিকে বন্যায় আক্রান্ত হওয়ার মাত্র এক মাসের মধ্যেই আবারও ভয়াবহ বন্যা হয়েছে সিলেট অঞ্চলে। চলমান বন্যা পরিস্থিতি সামাল দিতে যখন হিমশিম খেতে হচ্ছে তখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অফিস থেকে জানানো হয়েছে আগস্ট মাসে আরেকটি বন্যা আসতে পারে। সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় বারবার বন্যার পেছনে ভারতের আসাম ও মেঘালয়ের অতিবৃষ্টিকেই প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন নদী, পানি ও জলবায়ু গবেষকরা।

তারা বলছেন, আকস্মিক এই বন্যার পেছনে অতিবৃষ্টি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু উপাদানও কাজ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন দেশে উল্টাপাল্টা সময়ে অতিবৃষ্টিপাত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্প মেঘালয়ের পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ওপরে উঠে যায়। সেখানে ভারী হয়ে বৃষ্টি আকারে পড়তে শুরু করায় সিলেট অঞ্চল ভৌগোলিক কারণে ভয়াবহ বন্যাকবলিত হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমেলের প্রভাবে এ বছরও ভারতের মেঘালয় ও আসামে ভারী বর্ষণ হয়েছে। সেখানের পানি নেমে আসে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল সীমান্ত জেলা সিলেটে। এ কারণে আকস্মিক বন্যায় তলিয়ে গেছে সিলেট ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল। মেঘালয়ের পাদদেশে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের যাদুকাটা, কুশিয়ারা ও রক্তি নদীর পানি ফুঁসে ওঠে। যদিও সিলেট ও মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় রোববার থেকে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে পানি নামা শুরু হয়েছে।

আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সিলেট ও ভারতের মেঘালয়, এই দুই এলাকায় অন্যান্য জায়গার চেয়ে সাধারণত বেশি বৃষ্টিপাত হয়। এর কারণ হচ্ছে বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প গিয়ে ওখানে বাধা পায়। তারপর সেটি ওপরে উঠে গিয়ে বজ্রমেঘ তৈরি করে এবং ওই অঞ্চলে ভারী বৃষ্টি হয়।

তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে বাতাসে জলীয় বাষ্প এমনিতেই বেশি ছিল। পাশাপাশি মৌসুমি বায়ুও সেট হয়ে গেছে। এ কারণে ওখানে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি হওয়ায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত মে, জুন ও আগস্ট মাসে সিলেটে বছরে তিন থেকে চারবার ছোট-বড় বন্যা হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনার‌্যাবিলিটি স্টাডিজের সাবেক পরিচালক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরীন সময়ের আলোকে বলেন, সিলেট অঞ্চল ভৌগোলিক কারণে বন্যাকবলিত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশের অতিবৃষ্টির কারণে পানি বেড়েছে। এ রকম অতিবৃষ্টির কারণে বন্যা পরিস্থিতি ১৯৭৭ সালেও হয়েছিল। এ ছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট কিছু কারণও রয়েছে। যেমন নদী খনন ও বাঁধ রক্ষার কাজগুলো বছরজুড়ে করা হয়নি।
ভারতের চেরাপুঞ্জিতে অতিবৃষ্টির কারণে এবারও ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের ইমেরিটাস অধ্যাপক পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন দেশে উল্টাপাল্টা সময়ে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এবারও অতিবৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতেও এটি হবে। তবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পেতে শুধু নদী খনন করলেই হবে না। পুরো নদী ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক সময়ের আলোকে বলেন, সিলেট অঞ্চলের বন্যার প্রধান কারণ হচ্ছে অতিবৃষ্টিপাত। এ ধরনের অতিবৃষ্টির ঘটনা আগেও ঘটেছে। ৩০ থেকে ৪০ বছর পরপর এ ধরনের অতিবৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কারোরই কিছুই করার নেই। তবে আমরা যেটি করতে পারি তা হচ্ছে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে কমিয়ে আনা যায়। নদী খননের বিষয়ে তিনি বলেন, সিলেট অঞ্চলের নদীতে প্রচুর বালি ও পাথর আসে। তাই ড্রেজিং করার কয়েক দিন পরই দেখা যায় ফের ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

নদ-নদী, নৌপথ ও পানি সম্পদ বিষয়ক গবেষক আশীষ কুমার দে সময়ের আলোকে বলেন, কয়েকটি কারণে এবার সিলেট অঞ্চলে বারবার বন্যা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে নদীর নাব্য সংকট, হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ ও সøুইসগেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, হাওর বিল ঝিল ভরাট, নির্বিচারে পাহাড়-টিলা কাটা। প্রতি বছর উজান থেকে পানির সঙ্গে পলি আর পাথর নেমে এসে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর বাংলাদেশ অংশের তলদেশ ভরাট করে ফেলে। এতে নদীগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। তখন এসব নদীতে বেশি পানি এলে তা উপচে আশপাশের এলাকা ভাসিয়ে ফেলে। সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত থেকেই ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকার শুরু হয়েছে। ফলে সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে এসে মেশে। ভৈরব বা মেঘনা নদী হয়ে সাগরে চলে যায়। হঠাৎ বন্যার পেছনে চেরাপুঞ্জির এই প্রবল বৃষ্টিপাত প্রধান কারণ। তিনি বলেন, ভারতের উজানে পাথর উত্তোলনের ফলে মাটি আলগা হয়ে নদীতে চলে আসে। ফলে নদীর তলদেশ ভরে যায়। সেখানে নাব্য সংকট তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, অনিয়ম, দুর্নীতির কারণে যথাযথভাবে নদী খনন হয় না। সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারাসহ কালনী ও অন্যান্য নদ-নদী খনন করা এবং সিলেট নগরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছড়াগুলো সংস্কার করে সংকট নিরসন করা সম্ভব।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান জানিয়েছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে থাকা বেড়িবাঁধগুলোর সবশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়ে যদি কোনো বাঁধ নতুন করে নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ বা সংস্কার করতে হয় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, দেশের অধিকাংশ সাইক্লোন শেল্টার হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে এগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কাজে ব্যবহার করা হয়। দুর্যোগের সময় সেগুলো আবার আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান জানিয়েছেন, বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। আমরা সবসময় দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকি। প্রথম দফায় বন্যার সময় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তারা সিলেট অঞ্চলে পরিদর্শন করেছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় দফায় বন্যার বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। এখন দ্বিতীয় দফায় বন্যা চলছে। এখন দুর্যোগ কার্যালয় থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে যে, আরেকটি বন্যা আসতে পারে। তিনি বলেন, পানিটা তো প্রাকৃতিকভাবে আসে। আমাদের কিছু করার নেই। পানি যাতে দ্রুত নিষ্কাশন হয়ে যতটা কম প্লাবিত হয় সেভাবে সরকার কাজ করছে। বন্যা পরিস্থিতি স্থায়ী সমাধানে নদীগুলো ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটা রয়েছে তিস্তা নদীর ড্রেজিং। চীন ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি করেছে। এমনকি ভারত ও চীন একসঙ্গে কাজ করতে চাচ্ছে।

সময়ের আলো/আরএস/




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close