ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

যশোরে হরিলুট ঢাকতে মরিয়া দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা
উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সেকেন্ড চান্স এডুকেশন
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৯ জুলাই, ২০২৪, ১:৩৫ এএম  (ভিজিট : ৩৯৪)
উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় যশোরে ‘সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি’র হরিলুট ঢাকতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এনজিও ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’। অভিযোগকারী শিক্ষক, কর্মকর্তাদের ভয়-ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সরকারি এ কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী এনজিও দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার হরিলুটের অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

অভিযোগকারীদের দাবি, যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী সংস্থা দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা এ প্রকল্পে অন্তত ১০ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে। ঝরে পড়া শিশুদের জন্য এ প্রকল্পের স্কুলগুলোর বাড়ির মালিকদের সিংহভাগই অর্ধেক ভাড়া পাননি; বেতন বকেয়া রয়েছে শিক্ষক, সুপারভাইজারদের। শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের পোশাক, ব্যাগ। নিয়োগ দেওয়া হয়নি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর, সরবরাহ করা হয়নি উপকরণ। ব্যাংকের মাধ্যমে এসব অর্থ পরিশোধের কথা থাকলেও তা করা হয়নি। শিক্ষক, কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পাওনা দেওয়া হয়েছে হাতে হাতে। উপরন্তু প্রকল্পের যাবতীয় বিল-ভাউচার তৈরি করে টাকা উত্তোলন করে নেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের যে ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে; সেটিও নিজেদের তৈরি করা। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশে যশোর দুদক অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোটা দেশের ঝরেপড়া শিশু কিশোরদের শিক্ষার আওতায় আনতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় ২০২০ সালে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন (সাব-কম্পোনেন্ট ২.৫ আউট অব স্কুল চিল্ড্রেন-(ওওএসসি) প্রোগ্রাম, পিইডিপি-৪) কর্মসূচি গ্রহণ করে। কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক জেলা থেকে একটি লিড এনজিও নির্বাচন করা হয়। 

যশোরে লিড এনজিও হিসেবে দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা ৬টি উপজেলা ও যশোর পৌরসভায় (দুটি এরিয়ায় বিভক্ত করে ১ ও ২) প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকেই দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। 

সম্প্রতি দুদক দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করায় হরিলুট ঢাকতে মরিয়া হয়ে উঠেছে এনজিওটি। তারা শিক্ষক কর্মকর্তাদের দিশার প্রধান কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে ২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সব পাওনা পরিশোধ মর্মে লিখিত আদায়ে বাধ্য করছে। লিখিত দিতে অস্বীকৃতি জানানো ১৭ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন।

তারা জানিয়েছেন, গত ৪ এপ্রিল মিটিংয়ের নামে তাদের অফিসে ডেকে নিয়ে প্রথমে তাদের মোবাইল ফোন জমা নিয়ে নেওয়া হয়। এরপর মুদ্রিত কাগজে সব পাওনা বুঝে পেয়েছে মর্মে স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তাদের হুমকি ধমকি ও ভয়ভীতি দেখানোয় সিংহভাগই ওই কাগজে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। অল্প কয়েকজন স্বাক্ষর করেননি। একটি সভার অডিও রেকর্ডও অভিযোগকারীরা সরবরাহ করেছেন। যেখানে তাদের দাবির পক্ষে প্রমাণ রয়েছে। 

অভিযোগকারীরা জানান, কার্যক্রম শুরুর পূর্বে ঝরে পড়া শিশুর তথ্য সংগ্রহে জরিপকারীদের ৮০ ভাগ টাকা পরিশোধ করা হয়নি। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে স্কুলকেন্দ্রের (শিখন কেন্দ্র) ভাড়া বরাদ্দ হলেও শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়েছে জুলাই মাস থেকে। যশোর পৌরসভাসহ ৬টি উপজেলার ৪৮১টি স্কুলকেন্দ্রের (শিখন কেন্দ্র) শিক্ষকরা ওই সময়ের বেতন পাননি। এ খাতেই প্রায় দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। স্কুলকেন্দ্রের ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা করে স্বাক্ষর করানো হলেও শুরু থেকেই দেওয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। সেই টাকাও অনেক কেন্দ্রের বকেয়া রয়েছে। এ খাতে অনিয়মের অভিযোগ প্রায় ১ কোটি টাকা। ৪৮১ কেন্দ্রের প্রত্যেক শিক্ষককে দুই বছরে চারটি সোশ্যাল বেনিফিট হিসেবে মোট ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা থাকলেও একটি বেনিফিটের ৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এই খাতে অনিয়মের অভিযোগ ৭২ লাখ টাকা। প্রতিটি শিখন কেন্দ্রে পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ ও উপকরণ সরবরাহ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। পরিচ্ছন্নতা কর্মীর খাতে দুই বছরে ১২ হাজার টাকা হিসেবে ৪৮১টি শিখন কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে ৫৭ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ, স্কুল ড্রেস, স্কুলসহ যেসব সুবিধা দেওয়ার কথা সেখানেও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এসব টাকাই ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি করে এনজিও কর্তৃপক্ষ তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগকারীদের দাবি। সবমিলিয়ে অন্তত ১০ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ তাদের। 

অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের দেখভালের দায়িত্বে থাকা যশোর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাসও দিশার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। 

বাঘারপাড়া উপজেলার দক্ষিণ শ্রীরামপুর কেন্দ্রের শিক্ষক সুজন মাহমুদ জানান, তিনি প্রথম সাড়ে ৫ মাসের বেতন পাননি। কেন্দ্র ভাড়া ৫০০ টাকা করে দেওয়া হলেও স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয় ১ হাজার ২০০ টাকায়। দুই বছরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বরাদ্দ বা উপকরণ সরবরাহ করা হয়নি। এখন ওইসব কিছু বুঝে পেয়েছি- এমন প্রত্যয়নে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। অনেককে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে; প্রলোভনও দেখাচ্ছে। রোস্তমপুর কেন্দ্রের শিক্ষক ফিরোজা খাতুনও একই অভিযোগ করে বলেন, মিটিংয়ে ডেকে অনেকের কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। 

বাঘারপাড়া উপজেলার প্রোগ্রাম সুপারভাইজার আবদুর রহিম জানান, শিক্ষকদের অনেক মাসের বেতন বাকি; শিখন কেন্দ্রের ভাড়া বাকি। কেন্দ্রের ভাড়া ৫০০ টাকা দিয়ে মালিকদের শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে তদন্তে গেলে ১ হাজার ২০০ টাকা ভাড়া পান বলে জানাতে। তা হলে পরে ওই টাকা ভাড়া দেওয়া হবে। মিটিংয়ে এ ধরনের বক্তব্যের অডিও রেকর্ডও রয়েছে। শিক্ষকদের সোশ্যাল বেনিফিটের টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। কোনো কেন্দ্রে কোনো পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তিনি নিজেও ১১ মাসের বেতন পাবেন। অথচ এসব টাকা প্রকল্প থেকে তুলে নিয়েছেন দিশার কর্মকর্তারা। এখন দুদক ও সচিব বরাবর যারা অভিযোগ করেছেন, তাদের হুমকি ধমকি দেওয়া হচ্ছে; ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। 

বলা হচ্ছে, স্বাক্ষর না করলে চাকরি থাকবে না; বকেয়া টাকা পাওয়া যাবে না। তিনি দিশার অনিয়ম দুর্নীতির বিচার চান। 

যশোর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক হিরামন কুমার বিশ্বাস বলেন, দিশার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক তদন্ত করছে। দুদক তার কাছে যেসব কাগজপত্র চেয়েছিল, তিনি তা সরবরাহ করেছেন। ইতিপূর্বে তিনি কয়েকটি অভিযোগের তদন্ত করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। তবে দিশার সহযোগী হিসেবে যে অভিযোগ তা সত্য নয় বলে তিনি দাবি করেন। 

এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগের পর দুদক সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয় এসব অভিযোগে অনুসন্ধান করেছে। ইতিমধ্যে সংস্থার কার্যক্রমের নথিপত্র-তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে পর্যালোচনা করছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করছে। ব্যাংকের নথিপত্রও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।  

দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক যশোর সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আল-আমিন জানান, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচি বাস্তবায়নে এনজিও ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তারা অনুসন্ধান করছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা প্রকল্পের কাগজপত্র পর্যালোচনা, সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য ও তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধান করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেবেন। এরপর আইন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।  

সর্বশেষ অভিযোগ নিয়ে বক্তব্যের জন্য দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাহিমা সুলতানার ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে তিনি দাবি করেন, অনিয়ম-দুর্নীতির সব অভিযোগ মিথ্যা। একটি চক্র তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

প্রসঙ্গত, উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় যশোরে সেকেন্ড চান্স এডুকেশন কর্মসূচিতে ‘দিশা সমাজ কল্যাণ সংস্থা’র অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে ইতিপূর্বে গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

সময়ের আলো/জিকে




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close