ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

পার্সেন্টিজে জিম্মি চা চাষিরা, কে ভাঙবে সিন্ডিকেট!
প্রকাশ: সোমবার, ৮ জুলাই, ২০২৪, ৭:১২ পিএম  (ভিজিট : ৫৩০)
চা উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল পঞ্চগড় জেলা সারাদেশে বেশ পরিচিতি। কয়েক বছরের রেকর্ড হারে চা উৎপাদনে রেকর্ড গড়ালেও হাসি ফুটছে না সাধারণ চা চাষিদের। প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে গুনতে দিশেহারা তারা। বিগত কয়েক বছরে চা পাতার দাম না থাকায়, বিভিন্ন অজুহাতে চা পাতার ওজনে পার্সেন্টিজ কেটে রাখাসহ বিভিন্ন সিন্ডিকেটের অভিযোগ চা কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে। কারখানা মালিকদের কাছে যেন জিম্মি হয়ে আছেন এমন অভিযোগ চা চাষিদের।  

চলতি মৌসুমে দুই দফায় চা পাতার দামে কারখানায় পাতা বিক্রি করছে চা চাষিরা। কিছুদিন আগে পাতার দাম কেজি প্রতি ২২ টাকা গেলেও বর্তমানে ১৭ টাকা কেজি দরে কাচা চা পাতা বিক্রি করছেন চাষিরা। এতে দাম কিছুটা সহনশীলতায় থাকলেও কারখানা গুলো বিভিন্ন অজুহাতে ওজনে শতকরা ২৫ থেকে ৪০ পার্সেন্ট পাতা কেটে নেয়ায় বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। তারা বলছেন, চলমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কীটনাশক, সার, শ্রমিক, পাতা কর্তনসহ বিভিন্ন খরচের কারণে এমনিতে দাম উঠছে না, তার মধ্যে কারখানাগুলো ইচ্ছেমত পাতার পার্সেন্টিজ কেটে রেখে পাতা কিনছে। বিভিন্ন কারণে কারখানায় পাতা বিক্রি করতে বাধ্য হতে হচ্ছে চাষিদের। এ চা পাতার পার্সেন্টিজ কাটার কারণে অনেকেই চা গাছ তুলে ফেলছেন।  

সমতলের চায়ের ভরা মৌসুম মে থেকে জুলাই। তবে এপ্রিল থেকে থেকেই শুরু হয় পাতা কাটা। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকে পাতা উত্তোলন। এ সময়টা চাষিরা চা বাগানের পরিচর্যা করে চা পাতা উত্তোলনের উপযোগী করে তুলেন। মৌসুমের শুরুতে চা পাতা নিতে কারখানাগুলো পাতার দাম বাড়িয়ে পাতা কিনলে পরে সিন্ডিকেট তৈরি করে কমিয়ে দেন পাতার দাম। চা পাতার চাপ বাড়ানোর জন্য একেক দিন একেক কারখানা বন্ধ রেখে কমিয়ে দেওয়া হয় দাম। বর্তমানে প্রতি কেজি চা পাতা ১৭ টাকা কেজি দরে পাতা কিনলেও মোট ওজন থেকে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাদ দিয়ে পাতা কিনছেন তারা। এতে করে চাষিরা চা পাতা কারখানায় নিয়ে প্রায় অর্ধেক হারাচ্ছেন ওজনে। পাচ্ছেন অর্ধেকের দাম। এ কারণে পাতার দাম থাকলেও কর্তনে লোকসানে পড়তে হচ্ছে চাষিদের। লোকসান গুনতে গুনতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, চাষিদের কাছ থেকে কম দামে এবং ওজন বাদ দিয়ে নেওয়া চা থেকে দৈনিক কোটি টাকা ঢুকছে কারখানা মালিকদের পকেটে। চা বাগান ঘিরে কারখানার পরিধি বাড়লেও দাম বাড়েনি চাষিদের পাতার দাম। বিভিন্ন সিন্ডিকেট তৈরি করে অনেক কারখানা মালিক চাষিদের কাছ থেকে বাগান কিনে নিচ্ছেন। সমতলের হাজার হাজার ক্ষুদ্র চা চাষিদের ঘামঝরা চা চাষে পকেট ভরছে কারখানা মালিকদের। আরেকদিকে ভালো তৈরি চা অবৈধভাবে কালোবাজারে বিক্রি আর নিম্ন মানের চা পাতা নিলাম বাজারে সরবরাহের অভিযোগও রয়েছে কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময় কালোবাজারে পাতা বিক্রি করতে গিয়ে জব্দ হয়েছে অনেক চা পাতা।

চলতি বছরের গত ২৯ মে অবৈধ পথে নিলাম ছাড়াই উৎপাদিত চা কুরিয়ারের মাধ্যমে বিক্রির চেষ্টায় ৫০০ কেজি বস্তা চা জব্দ করেছে চা বোর্ড। গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে পাচারের সময় অর্ধশতাধিক চায়ের বস্তাসহ একটি পিকআপ জব্দ করে সদর থানা পুলিশ। এর আগে ২০২২ সালের ২২ আগস্ট রাতে জেলার শহরের ফায়ার সার্ভিস স্টেশন রোডের সদাগর এক্সপ্রেস কুরিয়ার সার্ভিসে অভিযান চালিয়ে ২১২ বস্তা চা জব্দ এসব জব্দ করা হয়। গত কয়েক বছর ধরে চলছে ভরা মৌসুমে চায়ের কৃত্রিম সংকট। জেলা প্রশাসন টাস্ক ফোর্স গঠন, মনিটরিং টিম গঠন করলেও দুই একটি কারখানায় নামমাত্র জরিমানা করা ছাড়া কার্যকরী তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। কারখানা মালিকদের এই দৌরাত্ম্যকে অনেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে তুলনা করছেন।

চা পাতার দাম না পেলেও উৎপাদনে রেকর্ড গড়ছেন চাষিরা। টানা তৃতীয়বার চা উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থান দখলে রেখেছে উত্তরাঞ্চল। চলতি মৌসুমে জাতীয় উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে ১৭ শতাংশ চা। সিলেট ও পার্বত্যাঞ্চলের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ২০২৩ সালে রেকর্ড ১ কোটি ৭৯ লাখ ৪৭ হাজার ২৪০ কেজি চা পাতা উৎপাদন হয়েছে। গত ২০২২ মৌসুমে চা উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ ৮১ হাজার ৯৬৮ কেজি। এ হিসেবে ২০২২ সালের চেয়ে চলতি মৌসুমে ১ লাখ ৬৫ হাজার কেজি বেশি উৎপাদন হয়েছে। এর আগের ২০২১ মৌসুমে ৭ কোটি ৩৫ লাখ ৬৮ হাজার কেজি সবুজ চা পাতা উত্তোলনের মাধ্যমে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়, যা বাংলাদেশে জাতীয় উৎপাদনের ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। চা শিল্প ঘিরে এ জেলায় ২৭টি চা কারখানা গড়ে উঠেছে। চা উৎপাদনে টানা রেকর্ড হলেও চাষিদের কাঁচা চা পাতার দাম না পাওয়া, সিন্ডিকেট তৈরি করে কর্তন করে পুঁজিবাদীদের পকেট ভরলেও চরম হতাশায় অনেকেই গত দুই বছরে অনেকে চা বাগান উঠিয়ে ভিন্ন আবাদের দিকে ছুটছেন।

চাষিদের চা পাতার ন্যায্য মূল্য পেতে ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর এ জেলায় দেশের তৃতীয় চা নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সরকার। তার ফলশ্রুতিতে গত বছর ২ সেপ্টেম্বর নিলাম কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও রেলপথ মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন। পরের মাস অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে জেলায় প্রথম অনলাইনে চা নিলাম কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। প্রথম নিলামে বিক্রি হয়েছিল ২১২ টাকা দরে প্রতি কেজি চা। এ চা নিলাম কেন্দ্র চালুতে চাষিরা উৎপাদিত চা পাতার ন্যায্যমূল্য পাওয়ার স্বপ্ন দেখলেও বাস্তবায়নের পথ দেখছেন না তারা।

হিমু, আব্দুল করিম ও নজরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন চা চাষি জানান,  বর্তমানে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার দর ১৭ টাকা দরে বিক্রি হলেও কারখানা মালিকরা ওজন থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাদ দিয়ে পাতা বিক্রি করতে বাধ্য করছেন। আমরা কষ্ট করে চা আবাদ করি আর কারখানা মালিকরা বিনাশ্রমে অর্ধেক চা নিয়ে নেয়। তারা চাষিদের মানুষ মনে করে না। বর্তমানে চা পাতা বিক্রি করে যে টাকা পাচ্ছি তা দিয়ে কামলা খরচ আর পথ খরচই উঠে না। বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে চা বাগান পরিচর্যা করতে হয়েছে। অনেক সময় এনজিও লোক ঋণের কিস্তির জন্য বাড়িতে বসে থাকে। কিস্তি টাকা দিতে পারিনা। সার কীটনাশকের দোকানে বাকি সেই টাকাও পরিশোধ করতে পারছি না। এরকম অভিযোগ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার অনেক ক্ষুদ্র চা চাষিদের।

পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলায় এখন পর্যন্ত ৯টি নিবন্ধিত ও ২১টি অনিবন্ধিত বড় চা বাগান (২৫ একরের বেশি) রয়েছে। এ ছাড়াও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চা বাগান রয়েছে প্রায় ৮ হাজার ৩৫৫টি এ নিয়ে উত্তরের ৫ জেলায় ১২ হাজার ৭৯ একর সমতল ভূমিতে চা চাষ হচ্ছে এবং এসব চা বাগানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৮ হাজার শ্রমিকের।

তেঁতুলিয়া গ্রিন কেয়ার এগ্রো লিমিটেড এর ম্যানেজার মো. মঞ্জুর আলম (মঞ্জু) জানান, আমাদের কারখানায় চা পাতা বিক্রি করতে এসে ৩০-৪০ পার্সেন্ট কাটা হয়েছে এরকম কোন অভিযোগ নেই। তবে বৃষ্টির সময় ভেজা পাতার কারণে আমরা ১০-১৫ শতাংশ কাটা হয়ে থাকে। আর অবশ্যই চাষিদের কারখানায় ভালো মানের পাতা দিতে হবে। কিন্তু অনেক চাষি কারখানার নিয়ম মেনে পাতা না আনায় অনেক কারখানায় হয়তো এরকম পাতা কাটছে। আর আমাদের কারখানার নির্দিষ্ট করা চা চাষি রয়েছে, তারা নিয়মিত পাতা দিচ্ছেন। একই কথা জানান তেঁতুলিয়ার বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরির ব্যবস্থাপক মতিয়ার রহমান।

তেঁতুলিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন খাঁন বলেন, এখানকার চা চাষিদের কাছ থেকে শুনছি তারা কারখানা চা পাতা বিক্রয় করতে গিয়ে ৩০-৪০ শতাংশ কেটে নিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে কারখানার মালিকদের সাথে কথা বলার পরেও তারা শুনছেন না। বিষয়টি নিয়ে আমাদের এমপি মহোদয় ব্যবস্থা নিবেন।

চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, কারখানা মালিকরা চা চাষিদের কাছ থেকে চা পাতা কর্তন করে নেয়ার অভিযোগ শুনেছি। বিষয়টি নিয়ে আমাদের পঞ্চগড় ১ আসনের সংসদ সদস্য নাঈমুজ্জামান ভুইয়া মুক্তার মহোদয়ের সাথে কথা বলেছি। এছাড়াও জেলা প্রশাসক, চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মহোদয়সহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করেছি। আশা করছি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে কাঁচা চা পাতার কম দাম ও কর্তন করার অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। শীঘ্রই চা সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সময়ের আলো/আরআই


আরও সংবাদ   বিষয়:  কারখানা মালিক সিন্ডিকেট   চা চাষিরা জিম্মি   তেঁতুলিয়া-পঞ্চগড়  




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close