ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের দফতরের ‘চাবি’ যাচ্ছে স্টারমারের হাতে
ক্ষমতায় আসছে লেবার পার্টি
প্রকাশ: শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০২৪, ১২:৫৫ এএম আপডেট: ০৫.০৭.২০২৪ ৭:৪৯ এএম  (ভিজিট : ২৭১)
রক্ষণশীলদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, অর্থনীতিতে উদ্বেগ-হতাশা আর ৮ বছরে পাঁচজন প্রধানমন্ত্রীর বদল; এমন টালমাতাল বাস্তবতায় গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের সাড়ে চার কোটি ভোটার। চৌদ্দ বছরের টোরি (রক্ষণশীল) শাসনের অবসান ঘটিয়ে লেবার পার্টির বিপুল বিজয়ের পূর্বাভাসের মধ্য দিয়ে এই নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন-পূর্ব সবগুলো জরিপে লেবার পার্টি বড় ধরনের জয়ের আভাস দেওয়া হয়েছে।

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, শুক্রবার সকালেই ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের দফতরের ‘চাবি হাতে পেয়ে যেতে পারেন’ লেবার নেতা কিয়ার স্টারমার। অবশ্য লেবার পার্টি ক্ষমতায় এলেও তাদের সঙ্গে রক্ষণশীলদের পার্থক্যের জায়গাটা এই মুহূর্তে অনেকটাই সঙ্কুচিত।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, নিজেদের পুরোনো জনবান্ধব আদর্শ থেকে সরে এসে লেবার পার্টি এখন ব্যবসা ও প্রাইভেট খাতের দিকে ঝুঁকেছে। তাই ক্ষমতায় এলেও কার্যত তারা রক্ষণশীলদের থেকে খুব বেশি আলাদা কিছু হবেন না। যুক্তরাজ্যের চার রাজ্য ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্দান আয়ারল্যান্ড মিলে ৬৫০টি সংসদীয় আসনের ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্রে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। চলে একটানা রাত ১০টা পর্যন্ত। ৯৮টি দল ও স্বতন্ত্র মিলে রেকর্ড ৪ হাজার ৫১৫ প্রার্থী এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৩৪ জন, যাদের প্রচার ঘিরে ১০ লাখের বেশি ব্রিটিশ-বাংলাদেশির মধ্যে দেখা গেছে উৎসবের আমেজ।

সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভোটে জিতে সরকার গঠনের জন্য যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের ৬৫০টি আসনের মধ্যে যেকোনো দল বা জোটের প্রয়োজন কমপক্ষে ৩২৬টিতে জয়। ২০১৯ সালে ৩৬৫ আসনে জিতে সরকার গড়েছিল রক্ষণশীলরা। লেবার পায় ২০২টি। তবে কয়েকটি উপনির্বাচনে আসন হারানোয় ৩০ মে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া পর্যন্ত টোরিদের দখলে ছিল ৩৪৪টি আর লেবারের আসন বেড়ে হয় ২০৫টি।

এবারের নির্বাচনের আগে প্রচারপর্বে সব প্রার্থীই প্রতিশ্রুতির ডালি মেলে ধরেন ভোটারদের সামনে। ব্যালট পেপারে পছন্দের প্রার্থীর ঘরে ক্রস চিহ্ন দিয়ে ব্রিটিশ নাগরিকরা এরইমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, কারা হবেন পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধি। এবার নাগরিকদের রায় কী হয়, তা দেখার অপেক্ষা।

বৃহস্পতিবার স্ত্রী আকশাতা মূর্তিকে সঙ্গে নিয়ে ভোট দিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। নিউ ইয়র্কশাহারে ভোট দিয়েছেন তারা। এদিকে স্ত্রী ভিক্টোরিয়াকে নিয়ে লন্ডনে নিজের ভোট দিয়েছেন বিরোধী প্রার্থী ও সম্ভাব্য নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। 

সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী স্টারমার : ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, এ নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের রক্ষণশীল দলকে সরিয়ে কিয়ার স্টারমারের লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় আনবে বলে সবগুলো জনমত জরিপেই আভাস মিলেছে। তবে জরিপের ফলে এটাও স্পষ্ট যে, রক্ষণশীলদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, অর্থনীতিতে উদ্বেগ আর আট বছরে পাঁচ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যে টালমাটাল সময়ের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যকে যেতে হয়েছে, অনেক ভোটার স্রেফ সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের আশাতেই ক্ষমতায় পরিবর্তন চাইছেন। 

বুধবার রাতে বাজার গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ইউ গভের প্রকাশ করা সম্ভাব্য ফলে জানানো হয়েছে, লেবার পার্টি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী দল থেকে ২১২টি আসন বেশি পেতে পারে। তেমনটা হলে দলটি নতুন ইতিহাস গড়বে।

রয়টার্স বলছে, ৬১ বছর বয়সি লেবার নেতা স্টারমারই হয়তো এবার ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, মূল্যস্ফীতি হ্রাস, অভিবাসনসহ বিপুল সমস্যার বোঝা তার কাঁধে চাপবে। তবে সংকট সমাধান করার জন্য যথেষ্ট অর্থের জোগান পাওয়া তার জন্য কঠিন হবে। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে স্টারমার ভোটারদের বলেন, ‘আজ ব্রিটেন একটি নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারে।রক্ষণশীলদের অধীনে আরও পাঁচ বছর থাকার সামর্থ্য আমাদের নেই। কিন্তু পরিবর্তন কেবল তখনই ঘটবে, যদি আপনারা লেবারকে ভোট দেন।’

ভোটের আগেই রক্ষণশীলদের পরাজয় : কনজারভেটিভ মন্ত্রী মেল স্ট্রাইড বিবিসিকে বলেছেন, ‘আমি মেনে নিচ্ছি, এ মুহূর্তে জরিপে যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে লেবারদের বিপুল জয় দেখতে হতে পারে, যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এই দেশ এর আগে দেখেনি।’

স্ট্রাইডের মন্তব্যের বিষয়ে সুনাকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি দ্বিমত করেননি। তবে আইটিভিকে তিনি বলেন, ‘আমি প্রত্যেকটি ভোটের জন্য কঠিন লড়াই করছি।’

গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অন্যান্য দলও : ঘুরে ফিরে যুক্তরাজ্যের শাসন-মসনদে থাকা লেবার ও টোরি পার্টিকে এবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ভোটের ফলের দিকে তাকিয়ে আছেন আরও কয়েকটি দলের জনপ্রিয় প্রার্থী এবং রেকর্ড ৪৫৯ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিরাচরিত প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর বাইরে এবার ভোটের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছে জাতীয় পর্যায়ে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টি, ইউকে রিফর্ম, গ্রিন পার্টি এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে স্কটল্যান্ডভিত্তিক স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি), নর্দান আয়ারল্যান্ড-ভিত্তিক ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টি (ডিইউপি) ওয়েলস-ভিত্তিক প্লেইড সিমরু।

ফল আজই : গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর ভোটগ্রহণের পর মধ্যরাতেই কয়েকটি আসনের ফল জানা যায়। শুক্রবার যুক্তরাজ্যের স্থানীয় সময় ভোরের দিকে, অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় শুক্রবার দুপুরের মধ্যে ফল স্পষ্ট হয়ে যাবে। 

লেবারের মোড়কে রক্ষণশীলতা : ২০১৫ সালে পুরোনো ধারার লেবার পার্টির রাজনীতিকে মূলধারায় ফিরিয়েছিলেন তৎকালীন শীর্ষ নেতা জেরেমি করবিন। ২০১৫ সালে তার স্বপ্নের মতো উত্থান। পার্টির বামপন্থি অংশ তাকে নামিয়েছিল নেতৃত্বের লড়াইয়ে। নেতা হয়ে করবিন দলকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন নব্য উদারবাদের বিষধারী অভিজাতদের হাত থেকে। কোনো ভেল্কিবাজি নয়, সত্যিকারের জনইস্যু, আর পার্টির তৃণমূলে নিরঙ্কুশ গণতন্ত্রের দর্শনে অন্তহীন বিশ্বাস ছিল তার যাদুকরী শক্তি। এই শক্তির কারণেই অখ্যাত মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন দলের শীর্ষ নেতা। 

করবিনের নেতৃত্বে ২০১৭ সালের নির্বাচনে পাশ্চাত্য ইতিহাসের এক অনন্য নির্বাচনি ইশতেহার রচনা করেছিল লেবার পার্টি।  বিদ্যুৎ ও জ্বালানি শিল্পের অংশবিশেষ জাতীয়করণ, শিক্ষা ব্যয় কমানো,  সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় বৃদ্ধি, ট্রেড ইউনিয়ন জোরদার, অভিবাসনকে ইতিবাচক ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা এবং খুবই বিদ্রোহী অবস্থান থেকে শীর্ষ ধনীদের আয়কর বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ ঘোষণা করেছিলেন করবিন। জিততে না পারলেও তার নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি রক্ষণশীলদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ভেঙে দিয়েছিল। তবে এবারের নির্বাচনে করবিন স্বতন্ত্র প্রার্থী। তার মতো বামপন্থিরা দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। 
বিকল্প ধারার সংবাদমাধ্যম পিপলস ডিসপাচের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, কর্মসূচি ও আদর্শভিত্তিক দুই ধারার রাজনীতিতেই লেবার ও রক্ষণশীলদের মধ্যে পার্থক্য অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়েছে। করবিন যেখানে শিল্পের আংশিক জাতীয়করণ ও সামাজিক সুরক্ষার মতো পদক্ষেপ ঘোষণা করেছিলেন; সেখানে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রক্ষণশীলদের কাটছাঁট সত্তে¦ও লেবার বিকল্প কোনো প্রস্তাব হাজির করেনি। উল্টো স্টারমারের লেবার জোর দিয়ে বলে যে স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি খাতের ভূমিকা রয়েছে। 

পিপলস ডিসপাচ বলছে, ব্যবসাপন্থি, প্রাইভেট সেক্টর সমর্থক হয়ে উঠেছে লেবার পার্টি। এভাবে তারা কিছু রক্ষণশীল ভোটারের সমর্থন নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। একই সময়ে এটি শ্রমিক-শ্রেণি এবং অভিবাসী সম্প্রদায়সহ তার ঐতিহ্যবাহী ভিত্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে হারিয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রশ্নে স্টারমারের অবস্থান, যেখানে দলটি প্যালেস্টাইনের সঙ্গে সংহতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ করবিন ছিলেন ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের একজন সোচ্চার কণ্ঠ।

ফিলিস্তিনের প্রতি শান্তি ও সংহতির পক্ষের লেবার সমর্থকরা দল থেকে ছিটকে পড়েছেন।  ৪০ বছরের বেশি সময় যিনি লেবার পার্টির ছিলেন, সেই করবিন এবার স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছেন। ইসলিংটন নর্থে নিজের প্রচারাভিযানের সময়, করবিন লেবার নেতা হিসেবে তার যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল, তারই পুনরুক্তি করেছেন। এরমধ্যে রয়েছে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার বাণিজ্যিকীকরণ না করা ও ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সংহতি।  

বড় বড় বিলিওনার, করপোরেট সেক্টর করবিনের শত্রু। তবে কমিউনিটির সদস্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচার কর্মীদের কাছে তিনি ব্যাপক সমর্থন পান। ফিলিস্তিন ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভের একজন চিকিৎসক এবং কর্মী মুস্তাফা বারঘৌতি। তিনি করবিনকে এমন একজন মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যারা অধিকারের জন্য লড়াই করে এবং সব ধরনের শান্তি ও ন্যায়বিচারকে সমর্থন করে।

লেবার পার্টি করবিনের এসব নীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে রক্ষণশীলতারই প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close