ই-পেপার সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪
সোমবার ৭ অক্টোবর ২০২৪

নতুন নিয়মে মূল্যায়ন শুরু
পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন ফাঁস
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০২৪, ৪:০০ এএম  (ভিজিট : ৯৯৭৪)
দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে। চিরাচরিত নিয়মের পরীক্ষা আর নেই। বুধবার নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির ষান্মাসিক মূল্যায়ন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। প্রশ্ন আর উত্তর লেখার পদ্ধতির বদলে নতুন নিয়মে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। জোড়ায় জোড়ায় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রশ্নের সমাধান করেছে শিক্ষার্থীরা। এভাবে নতুন নিয়মে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন নিয়ে দিনভর ছিল আলোচনা। তবে আলোচিত এই শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন পরীক্ষার আগের রাতে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। এমনকি ইউটিউবে এসব প্রশ্নের সমাধানও পাওয়া গেছে। এ নিয়ে অভিভাবকরা তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন।

অভিভাবকরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করার পরিবর্তে পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন খোঁজাখুঁজি করছে। প্রশ্নপত্র দেখে বোঝার উপায় নেই এটি বাংলা পরীক্ষা ছিল। প্রশ্নপত্রে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিদ্যালয়ে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন এসেছে। এ থেকে বাংলা বিষয়ে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে আমার বোধগম্য হচ্ছে না। শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষার সময় আলোচনা করে কাল্পনিক চরিত্র সাজিয়ে লিখে দক্ষতা অর্জন করা যাবে না। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা নোট, গাইড বই মুখস্থ করে পরীক্ষা দেবে। নতুন এই পদ্ধতি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক সবার বুঝতে সময় লাগবে।

নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও এর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল ইসলাম চৌধুরী নওফেল।

গতকাল রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, পরীক্ষায় কী প্রশ্ন আসবে শিক্ষার্থীরা তা জানলেও কোনো সমস্যা হবে না। এখানে ফাঁস করার কিছু নেই। প্রশ্ন ফাঁস করে লাভ নেই। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে অংশ নিয়ে দক্ষতার স্তর পাস করতে হবে।

গত সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয় মাধ্যমিক স্তর এবং কারিগরি ও মাদরাসা স্তরের যৌথ জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) সভায় মূল্যায়নের খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার ফল আর জিপিএতে মূল্যায়ন করা হবে না। এর বদলে এখন থেকে ইংরেজি অক্ষর গ্রেড দিয়ে ফল প্রকাশ করা হবে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, লিখিত অংশের ওয়েটেজ হবে ৬৫ শতাংশ এবং কার্যক্রমভিত্তিক অংশের ওয়েটেজ ৩৫ শতাংশ। একেকটি বিষয়ের মূল্যায়ন হবে সর্বোচ্চ এক স্কুল দিবস (দিনে যতক্ষণ স্কুল চলে)। রিপোর্ট কার্ডে বিষয়টি সহজে বোঝার জন্য সাতটি স্কেলের ঘরে আলাদা ইংরেজি অক্ষর দিয়ে বোঝানো হবে।

নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, কোনো শিক্ষার্থী যদি এসএসসি পরীক্ষায় এক বা দুই বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হয়, তা হলে শর্ত সাপেক্ষে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পাবে। তবে তাকে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বিষয়ে পাস করতে হবে। আর তিন বা তার বেশি বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হলে একাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না। বর্তমানে মূলত দশম শ্রেণিতে নির্বাচনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ হয়। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে নির্বাচনি পরীক্ষা হবে না। কোনো শিক্ষার্থী যদি দশম শ্রেণিতে ৭০ শতাংশ কর্মদিবস উপস্থিত না থাকে, তা হলে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারবে না। নতুন নিয়মে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা।

নতুন শিক্ষাক্রমে গতকাল মাধ্যমিকের ষান্মাসিক মূল্যায়ন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তৈরি করা শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্নের ভিত্তিতে হচ্ছে এ মূল্যায়ন কার্যক্রম। বিষয় ও শ্রেণিভেদে চার থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টায় হচ্ছে এ মূল্যায়ন। যেমন অষ্টম ও নবম শ্রেণির জন্য পাঁচ ঘণ্টা এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য চার ঘণ্টায় হচ্ছে মূল্যায়ন। সময়সূচি অনুযায়ী নির্ধারিত দিনে একটি বিষয়ের মূল্যায়ন হচ্ছে। মূল্যায়ন হবে সপ্তাহের প্রতিদিন। তবে গ্যাপ দিয়ে এ মূল্যায়নের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে মাসব্যাপী চলবে মূল্যায়ন কার্যক্রম।

জানা যায়, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শুরুর আগের দিন গত মঙ্গলবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মেইলে প্রশ্ন পাঠায় এনসিটিবি। সেই প্রশ্নের ফটোকপি করে গতকাল পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপের মাধ্যমে দেওয়া হয়, শিক্ষকরা এটি পরিচালনা করেন। নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অগ্রগতির রেকর্ড রাখার জন্য শিক্ষকরা এই অ্যাপটির অ্যাক্সেস পান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, মঙ্গলবার ওয়েবসাইটে প্রশ্ন পেয়েছি। আমাদের বলা হয়েছিল, সেই প্রশ্নগুলো প্রিন্ট করে ছাত্রছাত্রীদের দিতে। এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে পরীক্ষার আগেই শিক্ষার্থীদের হাতে প্রশ্ন এসেছে।

রাজধানীর পোগোজ স্কুল পরীক্ষার হলে দেখা যায়, একসঙ্গে গোল হয়ে বসেছে কয়েকজন শিক্ষার্থী। নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে। আলাপে প্রমিত ভাষা ব্যবহার করতে হচ্ছে। এর ভিত্তিতে খাতায় লিখছে। এমনকি সঙ্গে আছে পাঠ্যবই। প্রয়োজনে সেখান থেকেও সহায়তা নেওয়ার সুযোগ আছে। অন্যদিকে হলে দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা তাৎক্ষণিকভাবেও পরীক্ষার কিছু অংশের মূল্যায়ন করে নির্ধারিত শিটে লিখে ফেলছেন। পরে উত্তরপত্রের ভিত্তিতে হবে বাকি মূল্যায়ন। যেমন বাংলা বিষয়ের মূল্যায়নে একটি অনুষ্ঠান কীভাবে আয়োজন করতে হবে, তাতে শিক্ষার্থীরা কীভাবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে ইত্যাদি জানতে চাওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা জোড়ায় জোড়ায় আলোচনা করে এর ভিত্তিতে নিজ নিজ উত্তরপত্রে লিখেছে। আছে দলগত কাজও। ওই অনুষ্ঠান আয়োজন ঘিরে ব্যানার, আমন্ত্রণ ও পোস্টার ইত্যাদির নমুনা তৈরির বিষয়ও আছে।

নতুন নিয়ম হওয়ায় এবার এনসিটিবি থেকে মূল্যায়নে শিক্ষার্থী নির্দেশিকা বা প্রশ্ন তৈরি করে তা পরীক্ষার আগের দিন প্রতিষ্ঠান প্রধানের কাছে অনলাইনে পাঠানো হচ্ছে। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা প্রশ্নপত্র ডাউনলোডের পর ফটোকপি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করছেন। এ ব্যবস্থায় পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের আগে কোথাও কোথাও নির্দেশিকা বের হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

এ বিষয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন অভিভাবক জানান, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ষান্মাসিক মূল্যায়নের বাংলা পরীক্ষা ছিল। প্রশ্নপত্র দেখে বোঝার উপায় নেই এটি বাংলা পরীক্ষা ছিল। প্রশ্নপত্রে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বিদ্যালয়ে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন এসেছে। এ থেকে বাংলা বিষয়ে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে আমার বোধগম্য হচ্ছে না।

ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস বলে, আমি প্রশ্ন পাইনি। তবে অনেকেই প্রশ্ন পেয়েছে। দলগতভাবে পরীক্ষায় প্রশ্নের সমাধান করেছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর নামকরা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান বলেন, নতুন একটি পদ্ধতি চালু হয়েছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক সবার বুঝতে সময় লাগবে। তিনি বলেন, ভালো-মন্দ এখনই বলা যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, শুধু কথোপকথনের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দক্ষতা অর্জন সম্ভব নয়। জোড়ায় জোড়ায় যে দুজন মিলে প্রশ্নের উত্তর লিখবে তাদের মূল্যায়ন কি একসঙ্গে হবে, না আলাদা হবে এটি ষ্পষ্ট নয়। তাই এ বিষয়ে পুরোপুরি মন্তব্য করা যাবে না। তিনি বলেন, পরীক্ষার সময় আলোচনা করে কাল্পনিক চরিত্র সাজিয়ে লেখা এসবের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করা যাবে না। ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা নোট বই মুখস্থ করে আসবে। এ ধরনের প্রশ্নপত্রে অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট কিংবা গ্রুপ ওয়ার্ক হতে পারে। কিন্তু পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা যায় না।

প্রশ্নপত্রে নানা দুর্বলতা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধান অতিথির জন্য দুজনে তালিকা তৈরি করবে। তারপরে একজনকে প্রধান অতিথি নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু প্রধান অতিথি নির্ধারণে কী যোগ্যতা থাকতে হবে তা প্রশ্নে নেই।

কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করে উত্তর লিখে সঠিক অর্থে মূল্যায়ন হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. মশিউজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, প্রশ্নটি গতানুগতিক প্রশ্ন নয়। প্রধান শিক্ষকদের আইডিতে প্রশ্ন পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবে প্রধান শিক্ষকরা ভুল করে সেসব প্রশ্ন শেয়ার করেছেন। এভাবেই এসব প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি হয়তো বড় কোনো সমস্যা হতো না, যদি না এটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে। পরবর্তী পরীক্ষায় প্রয়াজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

সময়ের আলো/আরএস/ 




এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close