ই-পেপার রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪
রোববার ৬ অক্টোবর ২০২৪

যেভাবে শূন্য থেকে ঘুরে দাঁড়ান আকলিমা
প্রকাশ: বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪, ২:১৭ এএম  (ভিজিট : ২৪৬)
বিয়ের মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বর সাখাওয়াত হোসেন সেলিম। তার মৃত্যুর পর নিঃসন্তান আকলিমা বেগমের ঠাঁই হয়নি কোথাও। বিয়ের আগে সবকিছু ঠিক থাকলেও, বরের মৃত্যুর পর জীবনটা যেন একেবারে বদলে যায় তার। আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু-বান্ধব কাউকেই পাশে পাননি তিনি। আমাদের সমাজে সন্তানহীন বিধবার জীবন যে এত অসহনীয়, সেটি পরখ করে মন ভার হয়ে আসে তার। বরের মৃত্যুর পর আত্মীয়স্বজন তো দূরের কথা, বাবা-মা আর দুই ভাইও খোঁজ নেয়নি আকলিমার। 

আকলিমার দরিদ্র বাবা আয়েজ উদ্দিন পেশায় একজন কৃষক আর মা আয়েশা খাতুন একজন গৃহিণী। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে আকলিমাই বড়। আকলিমা বেগম ১৯৯৬ সালে জেলার মেলান্দহ উপজেলার ঝাউগড়া গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর বাবা-মায়ের অভাবের সংসারে হাল ধরতে ২০১৫ সালে ১৪শ টাকা দিয়ে দুটি থান কাপড় কিনে তা দিয়ে ১২টি ওয়ান পিস জামা তৈরি করেন আকলিমা। সেই জামাগুলো বাড়ির পাশে জেসমিন আক্তারের কাছে বিক্রি করে ২৪শ টাকা লাভ করেন তিনি।

লাভের মুখ দেখে আরও অনুপ্রাণিত হন আকলিমা। টাকার অভাবে কাপড় কিনতে না পেরে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২০ হাজার টাকা নেন আকলিমা। পরে ওই টাকা দিয়ে ১০টি থান কাপড় ও ২০টি শাড়ি কেনেন। তার কেনা ১০টি থান থেকে ৬০টি ওয়ান পিস জামা ও ২০টি শাড়িতে বাহারি ডিজাইনে হাতের কাজ করে সেগুলো বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন আকলিমা।

হাতের কাজের মান ভালো থাকায় এই জামা ও শাড়িগুলো বিক্রি করতে বেগ পেতে হয়নি। একটা সময় এই কাজেই থিতু হন তিনি। ধীরে ধীরে ব্যবসা বুঝে নেওয়া শুরু করেন আকলিমা। এভাবেই পর্যায়ক্রমে জামা আর শাড়ি বিক্রি করে আকলিমা ভালো আয় করতে থাকেন। 

এ সময় পরিবারের ইচ্ছায় জামালপুর সদর উপজেলার রশীদপুর এলাকায় মৃত মোহাম্মদ আলীর ছেলে বেকার সাখাওয়াত হোসেন সেলিমের সঙ্গে ২০১৮ সালে বিয়ে হয় আকলিমার। বিয়ের পর বরের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আকলিমা আরও জোরেশোরে হাতের কাজের জামা-কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। দুজনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে তাদের ব্যবসা বিস্তৃত হয়। চার বছর পর, ২০২২ সালে জামালপুর পৌর শহরের পূর্ব নয়াপাড় এলাকায় একটি দোকান ভাড়া নিয়ে তাতে লিমা হস্তশিল্প নামের একটি শোরুম খুলে বসেন আকলিমা।

হাতের কাজের জামা-কাপড়ের পাশাপাশি আকলিমা নানা ধরনের পাটজাত পণ্য দোকানে রাখা শুরু করেন। পাট দিয়ে তিনি টিফিন ব্যাগ, বড় ব্যাগ, পার্টস, টেবিল ম্যাট, ভ্যানিটি ব্যাগ, চাবির রিংসহ নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন পণ্য তৈরি করে থাকেন। ধীরে ধীরে পোশাকের পাশাপাশি পাটপণ্যের ক্রেতা ও শুভানুধ্যায়ীদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হন এই নারী উদ্যোক্তা। 

জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার ঝাউগড়া, মানকী, দেবেরছড়া, ভাবকী ও রশীদপুরে আকলিমার প্রায় ৫০ জন সূচিকর্মী রয়েছে। ট্রেসিং পেপারে ছাপ দেওয়া ডিজাইন করা কাপড় পৌঁছে দেওয়া হয়। কর্মীরা সেই কাপড়ে বাহারি সুতোয় ফুটিয়ে তোলে কারুকাজ।

ফোঁড়ের পর ফোঁড়ের মিশেলে রঙিন কাপড় এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে। হাতের কাজ শেষ হলে সেসব সংগ্রহ করা হয়। এরপর তাদের ঠাঁই হয় আকলিমার শোরুমে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শোরুমে চলে পণ্য কেনাবেচা। ঈদ-পূর্জা ইত্যাদি উৎসবে দোকানে বিক্রি বাড়ে কয়েকগুণ। তখন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খোলা রাখতে হয় শোরুমটি। মূলত নয়াপাড়, পাঁচরাস্তা, কলেজ রোড, হাই স্কুল রোড, আমলাপাড়া, ইকবালপুর, সর্দারপাড়া, কাচারীপাড়াসহ শহরের আশপাশের এলাকাগুলোতে রয়েছে আকলিমার পরিচিত অসংখ্য নারী ক্রেতা। এরাই মূলত আকলিমার তৈরি পণ্যের প্রধান গ্রাহক। এ ছাড়া আকলিমার তৈরি পোশাক ঢাকার মিরপুর ও নারায়ণগঞ্জ শহরের বিভিন্ন শোরুমেও বিক্রি হয়ে থাকে। স্থানীয়দের চাহিদা অনুযায়ী আকলিমা তার শোরুমে বিভিন্ন রঙের সুতা, টেইলারিঙের যন্ত্রাংশ বিক্রিসহ নারীদের প্রয়োজনীয় নানা উপকরণও বিক্রি করে থাকেন।

আকলিমা বেগম এসএমই ফাউন্ডেশন, জেডিবিসি, সমবায় অধিদফতর, যুব উন্নয়ন ও বিসিক শিল্প নগরী থেকে পাটজাত পণ্য তৈরি, হস্তশিল্প, ব্লক-বাটিক, হ্যান্ড পেইন্ট ও স্ক্রিনপ্রিন্ট ইত্যাদি বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ঢাকা, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও জামালপুর জেলায় বছরের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত মেলায় নিয়মিতভাবে অংশ নিয়ে নেন তিনি।

আকলিমা যখন কিছুটা সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেন ঠিক সেই সময় ২০২৩ সালের ৩০ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎই মারা যায় বর সাখাওয়াত হোসেন সেলিম। স্বামীর মৃত্যুর পর দুচোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেন আকলিমা। শোকে-দুঃখে আর নিদারুণ কষ্টে কিছুদিন ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন আকলিমা। ওই সময় নিজের চরম একাকিত্ব আর দুর্দিনে কাউকেই পাশে পাননি তিনি। বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন হিসেবে তাই তো আবারও শুরু করেন নিজের চেনা হস্তশিল্পের ব্যবসা। সবার ওপর ভরসা হারিয়ে ব্যবসা-কর্মী-ক্রেতাকেই নিজের পরিবার বানিয়ে নিয়েছেন তিনি। 

পরম যত্নে নিঃসন্তান আকলিমা তার ব্যবসাকে নিজের সন্তানের মতো করেই আরও বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্ত বর্তমান বাজারে ব্যবসা করতে হলে টাকার প্রয়োজন। নিজের ব্যবসায় সুদিন ফেরাতে এখন ঋণ সহায়তা দরকার তার। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ছোট ব্যবসার ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তাদের স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার বিষয়টি এখনও সহজ নয়। 

বর্তমানে আকলিমার ব্যবসার মূলধন ৫ লাখ টাকা। এই ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো আয়ের পথ নেই উল্লেখ করে আকলিমা বলেন, সরকারি সহায়তা পেলে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে সুবিধা হতো। আর স্বল্প 
সুদে ঋণের দেখা পেলে আরেকটু সহজ হয়ে উঠবে জীবন।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close