মুন্সীগঞ্জের
গজারিয়ার মেঘনা নদীতে গ্রাম ঘেঁষে চলছে শতাধিক ড্রেজারের মাধ্যমে বালু
উত্তোলনের মহাযজ্ঞ। এতে বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে ভাঙ্গন আতংকে ভুগছেন কয়েক
শত পরিবার। জানা গেছে, মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলনের বৈধ ইজারা নিয়ে গ্রাম
ঘেঁষে বালু উত্তোলন চালাচ্ছেন একটি ইজারাদার প্রতিষ্ঠান। এতে সরকারি আশ্রয়ণ
প্রকল্পসহ বসতভিটে আর ফসলি জমি মেঘনায় বিলীন হওয়ার আশংকা করছেন
গ্রামবাসী।
মেঘনা
তীরের চর কালীপুরা গ্রামের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলি
জমি। বর্ষার সামনে ওই জমিতে জোয়ারের সময় হাঁটু পর্যন্ত পানি হয়। দিনের
বেলায় গ্রাম লাগোয়া ওই জমি থেকে কিছুটা দুরেই ড্রেজারের মাধ্যমে বালু
উত্তোলন করা হলেও রাতের আঁধারে জমি ঘেঁষেই বালু উত্তোলনের কর্মযজ্ঞ চলে।
সরেজমিনে
গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর ইউনিয়নের চরকালীপুরা গ্রামের নারী-পুরুষের সঙ্গে
কথা বলে বালু উত্তোলনের এ চিত্র পাওয়া গেছে। এ সময় তারা গ্রাম ঘেঁষে বালু
উত্তোলনে অভিযোগ করেন।
এদিকে,উপজেলার চরকালীপুরা, নয়ানগর, রমজানবেগ
ও ষোলআনি গ্রাম সংলগ্ন মেঘনার বালু মহাল ইজারা দিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ
বালু মহালের ১২৮ একর জুড়ে মেঘনা বক্ষে বালু উত্তোলন করা যাবে। এ বালু
মহালটি ইজারা পেয়েছে ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড।
সম্প্রতি ওই
মহালে শতাধিক ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন শুরু করে ইজারাদার
প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর দিলকুশার ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষে মেঘনায় বালু
উত্তোলনের কাজ দেখভাল করে আসছেন গজারিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মনসুর
আহমেদ খান জিন্নাহ। গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা হলে মেঘনা তীরের ওই
গ্রাম ঘেঁষে বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার পেছনে ওই উপজেলা চেয়ারম্যানের
নাম উঠে এসেছে।
উপজেলার চরকালী পুরা গ্রামের বাসিন্দা আব্বাস
প্রধানের স্ত্রী নার্গিস আক্তার (৫০) জানান, এ গ্রামের একেবারে নদী ঘেঁষে
রয়েছে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প। এ আশ্রয়ণ প্রকল্পে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে
১২০টি পরিবারের। এছাড়া এ গ্রামে আরো ২০০টি পরিবার বসবাস করে আসছে বংশ
পরম্পরায়। ৩ শতাধিক পরিবারের বসবাসের এ গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দার রোজগারের
একমাত্র উপায় মেঘনা নদীতে মাছ শিকার। এক কথায় অধিকাংশ পরিবার
হতদরিদ্র। গ্রামের ওই নারী বলেন, আমাগো চোখের সামনেই গ্রামের জমি গুলোর
ধারেই বালু উত্তোলনের জন্য ড্রেজার লাগাইতেছে। চোখে দেখতেছি, তয় বাঁধ সাধতে
পারি না। কিছু কইতে গেলেই মারতে আসে। ভয়েতো আছি কহন জানি গ্রাম সুদ্ধ
কাইটা নিয়ে যাইবো বালু খেকোরা। এমনে কইরা বালু কাটলেতো বর্ষায় আমাগো
ঘর-বাড়িই ভাঙ্গিয়া লইয়া যাইবো রাক্ষুসি মেঘনা।
গ্রামের জুলহাস
প্রধান (৫৫) বলেন, বর্ষা আইলেই নদীর ভাঙ্গনের ভয়ে আমাগো বুক কাপে। এহন আবার
গ্রামের কাছেই ড্রেজারে বালু কাটতাছে। আমাগো উপজেলা চেয়ারম্যান জিন্নাহ বড়
একটা কোম্পানির সঙ্গে মিলে এ বালু উত্তোলন করতাছে। যেভাবে ড্রেজার
লাগাইছে, তাতে গ্রামের জমি ও বসতভিটা এ বর্ষাতেই ভেঙ্গে যাইবো।
গ্রামের
আক্কাস প্রধান (৬০) জানান, গ্রাম লাগোয়া আমার ১২০ শতাংশ জমি রয়েছে। জমির
পরই মেঘনা নদী। আর ওই জমির কাছে মেঘনায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ড্রেজারের
মাধ্যমে এ বালু উত্তোলন করায় ভাঙ্গন আতংক বেড়েছে।তিনি বলেন, প্রতিবাদ করার
সাহস নেই আমাদের। প্রতিবাদ করলে ইজারাদারের লোকজন চড়াও হয়। এভাবে বালু
কাটলে এ বর্ষায় মেঘনায় ভাঙ্গন দেখা দিবে। আমার ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাবে।
গ্রামের মামুন প্রধানের স্ত্রী নাজনীন (২১) বলেন, রাতে ঘুম আহে না। কখন
জানি ড্রেজারে জমিসুদ্ধ আমাগো বসতভিটে কাইটা লইয়্যা যায়।
গ্রাম
ঘেঁষে ড্রেজারের বালু উত্তোলনের কথা অস্বীকার করেছেন গজারিয়া উপজেলা
পরিষদের চেয়ারম্যান মনসুর আহমেদ খান জিন্নাহ। তিনি বলেন, সরকারি ভাবে ইজারা
পেয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নির্দিষ্ট স্থানেই বালু কাটা হচ্ছে। তীর
ঘেঁষে নয়। আপনারা সরেজমিনে ঘুরে দেখে যান। তিনি আরো বলেন, এটা আপনাদের
গ্রাম না। এটা আমার গ্রাম, আমার ইউনিয়ন। আমার জন্মস্থান।বালু উত্তোলন কাজে
ইজারা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা-জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদ
চেয়ারম্যান বলেন, জড়িত থাকলে কি হইছে। ব্যবসা তো সবাই করে। তবে আমার গ্রাম
বিলিয়ে দিয়ে ব্যবসা করবোনা।
এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক
মো. আবুজাফর রিপন বলেন, সীমানা অতিক্রম করে বালু কাটার কথা শুনেছি।
তাৎক্ষনিক গজারিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। যাতে নির্ধারিত সীমানার বাইরে বালু কাটা না হয়।
টাকার ভাগ পেলে আমাকেও দিয়েন; একা খাইয়েন না।
সময়ের আলো/এএ/